পাখির স্বর্গ টাঙ্গুয়ার হাওর

বাংলাদেশের পাখির এক স্বর্গরাজ্যের নাম টাঙ্গুয়ার হাওর। শীতের শুরু থেকে শেষ অবধি এ হাওরে বসে পাখিদের মিলনমেলা। আর এসব পাখির বেশিরভাই পরিযায়ি।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2016, 06:53 AM
Updated : 5 Feb 2016, 06:55 AM

টাঙ্গুয়ার হাওরে সম্ভবত পাখিদের সবচেয়ে বেশি দেখা যায় ফেব্রুয়ারি মাসে। পাখি দেখতে চাইলে টাঙ্গুয়ার হাওরে কমপক্ষে দুই দিন দুই রাতের একটি ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে বেড়িয়ে পড়ুন।

টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে যাওয়ার আগে আগে জেনে নিন এ হাওরের কিছু তথ্য।

সুনামগঞ্জের তাহিরপুর ও ধর্মপাশা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের অবস্থান। পরিযায়ী পাখি আর মাছের অভয়ারণ্য বিস্তীর্ণ এ জলাশয় জুড়ে। বর্ষায় এর পুরোটাই পানিতে ডুবে থাকলেও শীতে পানি কমতে থাকে। এর বড় একটা অংশ তখন শুকিয়ে যায় যায়।

টাঙ্গুয়ার হাওরে মাছ ধরছে জেলেরা।

টাঙ্গুয়ার হাওরে জেলে নৌকা।

সুনামগঞ্জ জেলার ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের দশটি মৌজা নিয়ে টাঙ্গুয়ার হাওরের বিস্তৃতি। ছোট বড় ১২০ টি বিল আছে এ হাওরে। ৪৬ গ্রামসহ পুরো হাওর এলাকার আয়তন প্রায় ১০০ বর্গকিলোমিটার, যার মধ্যে ২,৮০,২৩৬ হেক্টর জলাভূমি।

প্রতি বছর এ হাওরে প্রায় ২০০ প্রজাতির পরিযায়ি পাখির সমাগম ঘটে। এছাড়াও হাওরে প্রায় ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ৩৪ প্রজাতির সরিসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণীর আবাস।

টাঙ্গুয়ার হাওরে আছে ১৪০টিরও বেশি প্রজাতির স্বাদু পানির মাছ। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো রুই, কাতল, আইড়, বোয়াল, গাং মাগুর, বাইম, তারা বাইম, গুলশা, গুতুম, টেংরা, তিতনা, গজার, গরিয়া, বেতি, কাকিয়া ইত্যাদি। টাঙ্গুয়ার হাওরের রুই মাছের স্বাদ অপূর্ব।

সূর্যাস্তের অপরূপ দৃশ্য দেখা যায় টাঙ্গুয়ার হাওরে।

টাঙ্গুয়ার হাওরের পানির নিচে লতা-পাতা।

শীতে টাঙ্গুয়ায় যেসব পাখি বেশি দেখা যায় সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- সাপ পাখি, পানকৌরি, বড় পানকৌরি, ছোট পানকৌরি, ছোট ডুবুরি, বড় খোপা ডুবুরি, বড় বক, ছোট বক, ধুপনি বক, বেগুনি বক, মেটে রাজহাঁস, চখাচখি, ছোট সরালি, বড় সরালি, লেনজা হাঁস, খুনতে হাঁস, পাটারি হাঁস, ফুলুরি হাঁস, গিরিয়া হাঁস, সিথি হাঁস, পাতি হাঁস, বালি হাঁস, লাল ঝুটি ভুতি হাঁস, পাতি ভুতিহাঁস, পান্তা ঝিলি, মেটেবুক ঝিলি, জল মোরগ, লালবুক গুরগুরি, নেউ পিপি, কায়েম, দলপিপি, কুট, লাল ঢেঙ্গা, মেটেমাথা টিটি, তিলা লালপা, লালপা, সবুজপা, বিল বাটান, সোনালি বাটান, কালোমাথা তাঙচিল, খয়রামাথা গাঙচিল, কুরা, বড় চিত্রা ঈগল, তিলা নাগ ঈগল ইত্যাদি। 

টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রধান দুটি পাখির অভয়ারণ্য হল লেউচ্ছামারা ও বেরবেড়িয়ার বিল।

টাঙ্গুয়ার হাওরে বড় বক।

টাঙ্গুয়ার হাওরে পাতি হাঁস যুগল।

এছাড়াও যে বিলগুলোতে পাখিদের আনাগোনা বেশি থাকে সেগুলো হল রৌয়ার বিল, গজারিয়ার বিল, আলমের ডোয়ার, সাংসার বিল, কৈখালি বিল, ছুনখোলা বিল, জিততলার গোপ, ফইল্লার বিল, রূপাভুই বিল, সত্তার বিল, মইষের গাতা, বালোয়ার ডোবা, আমছারের বিল, কাউয়ার বিল, আনসারের বিল, খাজুরী বিল, আইন্নার বিল, নলকাঠির বিল ইত্যাদি।

টাঙ্গুয়ার হাওরের ঠিক মাঝখানটায় সুন্দর বিল হাতিরগাতা। এর চারপাশে রয়েছে বিলগুলো। শীতে হাতিরগাতার বেশিরভাগ এলাকাই শুকিয়ে যায়। কথিত আছে ব্রিটিশ শাসনামলে ইংরেজরা শীতে শুকিয়ে যাওয়া মাঠে হাতি চড়াতে আসতেন বলেই এই নাম পেয়েছে জায়গাটি।

কীভাবে যাবেন

প্রথমে যেতে হবে সুনামগঞ্জ জেলা শহরে। ঢাকা থেকে সড়ক পথে সুনামগঞ্জ যাওয়া যায়। সায়দাবাদ থেকে শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, এনা পরিবহন, মামুন পরিবহনের নন এসি বাস যায় সুনামগঞ্জ। ভাড়া এসি ৫শ’ থেকে সাড়ে ৫শ’ টাকা।

সুনামগঞ্জ শহরের আগে শুরমা সেতু থেকে লেগুনা কিংবা মোটরবাইকে যেতে হবে তাহিরপুর কিংবা সোলেমানপুর। তবে ফেব্রুয়ারি মাসে সোলেমানপুর যাওয়াই উত্তম।  কারণ তাহিরপুর থেকে সোলেমানপুরের বৌলাই নদীতে এ সময়ে নাব্যতা কমে যায়।

টাঙ্গুয়ার হাওরে এক জোড়া কুট।

টাঙ্গুয়ার হাওরে কালেম।

সুনামগঞ্জ থেকে সোলেমানপুর যেতে একটি লেগুনার ভাড়া পড়বে ৮শ’ থেকে ১ হাজার ২শ’ টাকা। যাওয়া যাবে কমপক্ষে আটজন।

মোটরবাইকে দু’জনের খরচ পড়বে ৩শ’ থেকে ৪শ’ টাকা। সোলেমানপুর থেকে ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া করে পাতলাই নদী ধরে যেতে হবে টাঙ্গুয়ার হাওরে।

সেখানে বিভিন্ন রকম ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া পাওয়া যায়। প্রতিদিনের জন্য একটি নৌকার ভাড়া পড়বে ১ হাজার ২ হাজার ৫শ’ টাকা। এসব নৌকায় রাতেও থাকা যাবে। 

প্যাকেজ ভ্রমণ

টাঙ্গুয়ার হাওরে ঝামেলামুক্ত আরামদায়ক ভ্রমণ করতে হলে যেতে হবে প্যাকেজ ভ্রমণে।

হাউস বোট ‘রূপাবই’ বিভিন্ন মেয়াদের প্যাকেজ ভ্রমণ পরিচালনা করে থাকে এ হাওরে। ছয় থেকে আট জনের থাকার উপযোগী কাঠের তৈরি এ নৌকাতে  পর্যটকদের গাইডসহ থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া নৌকায় আছে সৌর বিদ্যুতেরও ব্যবস্থা। যোগাযোগ ০১৯৭৫০৪১৩২৫।

টাঙ্গুয়ার হাওরে মেটে মাথা তিতি।

টাঙ্গুয়ার হাওরে পানকৌড়ির দল।

 

প্রয়োজনীয় তথ্য 

টাঙ্গুয়ার হাওরে ভ্রমণে গিয়ে পাখিদের বিরক্ত করবেন না। পাখি শিকার করবেন না। হাওরে প্লাস্টিকের বোতল, চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট, কোনো রকম পলিথিন ফেলে পরিবেশ দূষণ করবেন না।

হাওরে পানি কমে যাওয়ায় এসময়ে মশা ও পোকা মাকড়ের উপদ্রব বেশি থাকে। তাই সঙ্গে মশারি, পতঙ্গ নাশক ক্রিম কিংবা স্প্রে নিয়ে নেবেন। জায়গাটিতে বিদ্যুৎ নেই। তাই মোবাইল ফোন ক্যামেরার পর্যাপ্ত ব্যাটারি, মেমোরি কার্ড সঙ্গে নিয়ে নিন। হাওর এলাকার কয়েক কিলোমিটারের মধ্যে ওষুধের দোকান নেই। প্রয়োজনীয় জরুরি ওষুধপত্র পর্যাপ্ত পরিমাণে অবশ্যই সঙ্গে নেবেন।

ছবি: লেখক।