‘বিবাহিত, তবুও শিশু’

মেয়ে শিশুর বিয়ে হওয়া রোধবিষয়ক সেমিনার।

শরীফ আহমেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Nov 2015, 10:02 AM
Updated : 29 Nov 2015, 10:02 AM

অপ্রাপ্ত বয়স্ক মেয়েদের বিয়ের হওয়ার পরিসংখ্যানে আন্তর্জাতিক তালিকায়, উপরের সারিতে নাম বাংলাদেশের। জাতীয় পর্যায়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার প্রসার ঘটলেও, খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই সমস্যা। বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় একটি বড় বাধা।

কিছুদিন আগেও বিয়ের সর্বনিম্ন বয়স নির্ধারনে বড় বিতর্কও হয়েছে দেশজুড়ে। এমনই সময়ে বুধবার ২৫ নভেম্বর ঢাকার বাংলামোটরের বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে ‘বিবাহিত, তবুও শিশু’ শিরোনামে জাতীয় সেমিনারের আয়োজন করা হয়।

আয়োজনকারীদের মধ্যে রয়েছে কাউন্টার ফটো, বাংলাদেশস্থ নেদারল্যান্ডস দূতাবাস- তেরে দে হোমস নেদারল্যান্ডস, তেরে দে হোমস লুসান, রেড অরেঞ্জ মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স, এসকেএস ফাউন্ডেশন ও পল্লীশ্রি (Pollisree)।

আয়োজনে অংশগ্রহণকারীদের মাঝে ছিলেন উন্নয়ন কর্মী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি, শিল্পী গোষ্ঠীসহ সমাজের নানা অঙ্গনের প্রতিনিধিরা।

শুরুতেই কার্টুনিস্ট বিপ্লব চক্রবর্তীর পরিকল্পনা এবং শিল্পী মাসুদ হাসানের অঙ্কনে বিষয়ভিত্তিক একটি চিত্রকর্ম উন্মোচন করা হয়। অপ্রাপ্ত বয়সে বিয়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা একটি চিঠি পাঠ করে শোনান বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সঙ্গীতা ইমাম।

এরপর মত বিনিময় সভায় অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে উন্মুক্ত আলোচনায় যোগ দেন অভিনয়শিল্পী জ্যোতিকা জ্যোতি, কার্টুনিস্ট শিশির ভট্টাচার্য, আলোকচিত্রী সাইফুল হক অমি, গায়ক অরুপ রাহী ও উন্নয়নকর্মী ফারহানা জেসমিন হাসান।

বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আলোচনা করার মাঝেই, ‘রোশনী’ শিরোনামে অপ্রাপ্ত বয়সে বিবাহিত মেয়েদের নিয়ে আলোকচিত্রীদের নেওয়া উদ্যোগের কথা জানান আলোকচিত্রের স্কুল কাউন্টার ফটোর প্রিন্সিপাল সাইফুল হক অমি।

মূলত কাউন্টার ফটো ও যোগাযোগ বিষয়ক পরামর্শ দাতা প্রতিষ্ঠান কন্সালটেন্সি হাউজ ফর মিডিয়া অ্যান্ড কমিউনিকেশন্স এবং রেড অরেঞ্জের নেওয়া এই যৌথ উদ্যোগ নিয়ে তিনি বলেন, “অপ্রাপ্ত বয়সে বিবাহিত মেয়েদের সমস্যা নিয়ে ছয়মাস একসঙ্গে কাজ করবে কাউন্টার ফটো এবং রেড অরেঞ্জ।”

তিনি আরও বলেন, “এই ছয় মাসে আমি, আবীর আবদুল্লাহ ও আরেকজন আলোকচিত্রী ভৌগলিকভাবে ভিন্ন তিনটি বাংলাদেশের তিনটি অঞ্চলে এই বিষয়ের উপর ছবি তুলবো। পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী বছর কাউন্টার ফটোর ফটোগ্রাফি বিভাগের বর্ষপূর্তিতে একটি প্রদর্শনীরও আয়োজন করা হবে এই কাজ নিয়ে।”

উন্মুক্ত আলোচনায় ভয়াবহ এই সমস্যা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে উন্নয়ন বিতর্ক, সরকারের ও শিল্পীদের ভূমিকা, সুশীল সমাজের করণীয়সহ পরিবারের অংশগ্রহণের মতো বিষয় নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন অংশগ্রহণকারী এবং আলোচকেরা।    

এ প্রসঙ্গে শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য বলেন, “অনেক বিষয়ে কাজ করবার জন্যই তো বিদেশি সহায়তা আসছে এত বছর ধরে। কিন্তু কতটুকু পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে এই অর্থ সাহায্যগুলো? বরঞ্চ এমনভাবেই কাজগুলো হচ্ছে যেন আমাদের মানুষেরা শুধু বেঁচে থাকে। কারণ, তা না হলে হয়তো কাজ করবার জন্যও বিষয় খুঁজে পাওয়া যাবে না। সুতরাং প্রশ্ন হওয়া উচিত আমরা নিজেরা কতটা সৎ।”

অংশগ্রহণকারীদের মাঝ থেকে নিজের অভিজ্ঞতার উপর আলোকপাত করে বাংলাদেশ নারী প্রগতি সংঘের প্রতিনিধি নাসরিন বেগম।

“মডেলে না সমস্যা মানসিকতায়। যেভাবে মানুষেরা বেড়ে উঠছে সেটাই সমস্যা বলে মনে হয়, কেননা এখনও বাবা-মায়ের সিদ্ধান্তে বিয়ে হয় আমাদের এখানে।”

অন্যদিকে নৃ-তত্ত্ববিদ ও গবেষক নিকোলেত্তা দেল ফ্রাঙ্কো অবশ্য গুরুত্ব দিয়েছেন ঐতিহাসিক ক্ষমতা কাঠামোকে।

তিনি বলেন, “সংস্কৃতিকে নয়, মূল ঝামেলা ক্ষমতার কাঠামোতে। আমাদের বরঞ্চ পুরো বিষয়টা নিয়ে আরও গভীরভাবে চিন্তা করা উচিৎ।”

আয়োজনের মাঝেই প্রদর্শিত হয় দু’টি প্রামাণ্যচিত্র, সমাজের নানা স্তরের মানুষের ভিডিও বার্তা ও প্রচারাভিযানের অংশ হিসেবে তৈরি করা একটি টেলিভিশন বিজ্ঞাপন। অনুষ্ঠানে আলোচকদের পাশাপাশি নিজেদের অভিজ্ঞতা ও মতামত জানান অংশগ্রহণকারীরা।         

সবশেষে কন্ঠশিল্পী মাহমুদা রহমান শুচী ও যন্ত্রশিল্পী অপূর্ব পাল অর্ক’র পরিবেশনায় যেখানে গানের কথায় উঠে আসে বকুল নামের প্রতীকি চরিত্রের অব্যক্ত কথা।

অংশগ্রহণকারী সবাই দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, বকুলের মত আর কোনো শিশুর প্রস্ফুটিত শৈশব যেন চুরি হয়ে না যায়, সেজন্য একটি জোরালো প্রচারাভিযান চালাতে সহায়তা করবেন তারা। একই সঙ্গে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণের আশা নিয়ে শেষ হয় এই সামাজিক আয়োজন।

ছবি: ফায়হাম ইবনে শরীফ।