পূজায় মন্দির ভ্রমণ

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে রয়েছে সনাতন ধর্মালম্বীদের উপাসনালয়। ধর্মীয়ভাবে সেগুলো যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি ইতিহাস ও স্থাপত্যকলার অনন্য উদাহরণ হিসেবে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Oct 2015, 12:05 PM
Updated : 21 Oct 2015, 09:45 AM

ঢাকেশ্বরী মন্দির

পুরান ঢাকার প্রাচীন স্থাপনাগুলোর অন্যতম একটি ঢাকেশ্বরী মন্দির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের প্রায় ৬০০ মিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে বকশিবাজারে জাতীয় এই মন্দিরের অবস্থান।

কিংবদন্তি আছে রাজা বল্লাল সেন বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ের জঙ্গলে দেবী দুর্গার একটি মূর্তি পান। মূর্তিটি স্থাপন করে তিনি সেখানে একটি মন্দির নির্মাণ করেন। আর এর নাম দেন ঢাকেশ্বরী মন্দির।

অনেক ঐতিহাসিকের মতে ঢাকেশ্বরী থেকেই ঢাকা নামের উৎপত্তি। মূল মন্দির ছাড়াও বর্তমানে এখানে চারটি শিবমন্দির আছে। এর নির্মাণশৈলী অনেকটা বৌদ্ধ মন্দিরের মতো। এগুলো তৈরি করেছিলেন সেনাপতি মান সিংহ।

কিংবদন্তী আছে ষোড়শ শতকে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের জরাজীর্ণ অবস্থা দেখে তিনি এর সংস্কারের ব্যবস্থা করেন। সে সময়ে তিনি এখানে চারটি শিবলিঙ্গ স্থাপন করে মন্দির চারটি শিবমন্দির নির্মাণ করেন।

সীতাকুণ্ডের মন্দির

চন্দ্রনাথ মন্দির।

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড বাজার ভেতর থেকে ছোট্ট একটি সড়ক চলে গেছে চন্দ্রনাথ পাহাড়ের দিকে। বাজার থেকে প্রায় দুই কিলোমিটারেরও বেশি দূরে এর সর্বোচ্চ চূড়া। চন্দ্রনাথ পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার দুর্গম এ পথে আছে বেশ কয়েকটি হিন্দু মন্দির।

বাজার ছেড়ে একটু সামনে গেলেই কিছুটা পাহাড়ি পথে ওঠার পরে ভবানী মন্দির। এখান থেকে কিছু দূর গেলেই রয়েছে শয়মভুনাথ মন্দির। সেখান থেকে কিছুটা সামনে উঠলে ছোট্ট পাহাড়ি ঝরনা। এরপরে সামনের পথ বেশ দুর্গম।

পাহাড় কেটে বানানো সিঁড়ির ধাপগুলো বেশ উঁচু। সিঁড়িগুলো ভেঙে উপরে উঠলে প্রাচীন দুটি বটগাছের পাশে দুটি মন্দির।

পুরানো মন্দিরের নাম বিরূপাক্ষ মন্দির। এই জায়গার উচ্চতা প্রায় ২০০ মিটার। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে বিস্তীর্ণ বঙ্গোপসাগর।

দুই মন্দিরের পাশ থেকে পূবে পাহাড়ি পথ চলে গেছে এর চূড়ায় চন্দ্রনাথ মন্দিরে। এখানে দাঁড়িয়ে চারপাশের দৃশ্য বড়োই মনোহর।

ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের বাসে চড়ে সীতাকুণ্ড যাওয়া যায়। জায়গাটিতে থাকার ভালো ব্যবস্থা নেই। কাছাকাছি দূরত্বে ভালো থাকার ব্যবস্থা আছে চট্টগ্রাম শহরে।

আদিনাথ মন্দির

আদিনাথ মন্দির।

মহেশখালীর গোরখঘাটা ইউনিয়নের ঠাকুরতলা গ্রামে মৈনাক পাহাড়ের চূড়ায় আদিনাথ মন্দির। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পায় ৮৫ মিটার উচ্চতায় মন্দিরটির অবস্থান। মন্দিরটির দৈর্ঘ্য ১০.৫০ মিটার, প্রস্থ ৯.৭৫ মিটার এবং উচ্চতা প্রায় ৬ মিটার।

মন্দিরের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাকে তিনভাগে ভাগ করা হয়েছে। উত্তরের অংশ সবচেয়ে পুরানো। আদিনাথ মন্দিরের পাশেই অষ্টভূজা নামে আরেকটি বিগ্রহের মূর্তি আছে। উত্তরের অংশের প্রথম ভাগে বর্গাকারের দুটি পূজাকক্ষে আদিনাথ বাণলিঙ্গ শিবমূর্তি এবং অষ্টভূজা দুর্গামূর্তি রয়েছে। সামনের দিকের প্রবেশ পথ ধনুকাকৃতির।

কক্সবাজারের কস্তুরীঘাট থেকে স্পিড বোটে মহেশখালী যেতে সময় লাগে প্রায় ত্রিশ মিনিট। জনপ্রতি ভাড়া ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। এছাড়া ইঞ্জিন নৌকায় গেলে সময় লাগে এক ঘণ্টার মতো। যারা সরাসরি আদিনাথ মন্দিরে যেতে চান কস্তুরীঘাটে থেকে তাদের যেতে হবে গোরখঘাটা।

হটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির

সিরাজগঞ্জ জেলায় প্রায় পাঁচশ বছরের পুরানো প্রত্নতাত্তিক নিদর্শন হাটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির। জেলার উল্লাপাড়া উপজেলার হাটিকুমরুল ইউনিয়নে্‌ এই মন্দিরের অবস্থান।

হটিকুমরুল নবরত্ন মন্দির

তিনতলা বিশিষ্ট এ মন্দিরের চারপাশের দেয়ালে পোড়ামাটির অলঙ্করণে ভরপুর। বাইরে থেকে দেখতে অনেকটাই কান্তজিউ মন্দিরের মতো। স্থানীয়ভাবে দোলমঞ্চ নামে পরিচিত এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবরত্ন মন্দির।

উঁচু একটি বেদীর উপর নবরত্ন পরিকল্পনায় নির্মিত মন্দিরটির প্রতিটি বাহু দৈর্ঘ্যে ১৫. ৪ মিটার এবং প্রস্থে ১৩.২৫ মিটার। ক্রমহ্রাসমান তিনতলা বিশিষ্ট তিলতলা বিশিষ্ট এ মন্দির। উপরের রত্ন বা চূড়াগুলো প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। মূল মন্দিরের বারান্দায় সাতটি এবং ভেতরের দিকে পাঁচটি প্রবেশপথ আছে।

দ্বিতীয় তলায় কোনো বারান্দা নেই। মন্দিরের বহিবারণ পোড়া মাটির অলঙ্করণে ঢাকা। এসব অলঙ্করণে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে নানান দেব দেবীর মূর্তি, লতা-পাতা ইত্যাদি।

মন্দিরটির নির্মাণ সময় সম্পর্কিত কোনো শিলালিপি পাওয়া যায়নি। আনুমানিক ১৭০৪ থেকে ১৭২৮ সালের মধ্যে নবাব মুর্শিদকুলি খানের শাসনামলে রামনাথ ভাদুরী নামে জনৈক তহসিলদার নির্মাণ করেন বলে জানা যায়।

ঢাকা থেকে দিনে দিনে বেড়িয়ে আসতে পারেন হাটিকুমরুল মন্দির থেকে। বগুড়াগামী যে কোনো বাসে উঠে নেমে পড়তে পারবেন হাটিকুমরুল।

কান্তজিউ মন্দির

দিনাজপুর শহর থেকে ২১ কিলোমিটার দূরে কাহারোল থানার কান্তগর গ্রামে অবস্থিত কান্তজিউ মন্দির। জনশ্রুতি আছে, শ্রী-কৃষ্ণের বিগ্রহ অধিষ্ঠানের জন্য এ মন্দির নির্মিত হয়েছিল।

দিনাজপুরের তৎকালীন জমিদার প্রাণনাথ রায় ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে পোড়ামাটির অলঙ্করণ সমৃদ্ধ এ মন্দির নির্মাণ কাজ শুরু করেন। তবে তার জীবদ্দশায় এ মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করে যেতে পারেন নি। পরে ১৭৫২ খ্রিস্টাব্দে তারই পালক পুত্র রাম নাথ রায় মন্দিরের নির্মাণ কাজ শেষ করেন। এর পরে তিনি এ মন্দিরটি শ্রী কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করেন।

কান্তজিউ মন্দির।

প্রায় তিন ফুট উঁচু এবং ৬০ ফুট বাহু বিশিষ্ট পাথর নির্মিত বর্গাকৃতি জায়গার উপর এই মন্দির স্থাপিত। তিন ধাপে নির্মিত মন্দিরটি দেখতে বড় একটি রথের মতো। মন্দিরের প্রত্যেক বাহুর দৈর্ঘ্য ৫২ ফুট এবং উচ্চতা ৭০ ফুট।

১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ায় উপরের গম্বুজ ঘরের আকৃতি ধারণ করেছে। ভূমিকম্পে ভেঙে যাওয়ার আগে গম্বুজের উপরে নয়টি সুদৃশ্য চুড়া ছিল। বারান্দার সামনে রয়েছে ইটের তৈরি দুটি করে স্তম্ভ। এই স্তম্ভের সাহায্যে দেয়ালের সঙ্গে প্রত্যেক পাশে সংযুক্ত রয়েছে তিনটি করে খোলা দরজা।

দ্বিতীয় তলার দক্ষিণ পাশের দরজা দুটি বেশি লক্ষ করা যায়। এই দরজার পরে, ভেতরে মূল কামরা, সেখানে আছে মোট ১৮টি কক্ষ। বড় কামরাগুলোর চারিদিকে আছে ছোট কামরা।

মন্দিরের বেদির নিচে এবং দেয়ালের গায়ে পোড়ামাটি খচিত প্রায় লক্ষাধিক ছবি রয়েছে। পৌরণিক চিত্র সংবলিত টেরাকোটা ছাড়াও মন্দিরের দেয়ালের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মূর্তির টেরাকোটাও রয়েছে। এসব টেরাকোটার মধ্যে নারী-পুরুষ, দেবতা ও কিন্নর, গায়ক ও বাদক, যোদ্ধা ও শিকারী, গৃহিনী, নৌকার মাঝি, নৃত্যরতা রমণী, পালকি বাহক, গাছ-পালা, ফল ও ফুল, লতা-পাতা ইত্যাদির ছবি মূর্তমান।

দিনাজপুর কেন্দ্রীয় বাস স্টেশন থেকে পীরগঞ্জের বাসে কান্তগর নামতে হবে। ভাড়া জনপ্রতি ৩০ থেকে ৩৫ টাকা। সেখানে নেমে ঢেপা নদী পার হয়ে একটু সামনেই মন্দিরটি।

পুঠিয়ার মন্দির

রাজশাহী শহর থেকে প্রায় ৩২ কিলোমিটার পূর্ব দিকে মন্দিরের শহর পুঠিয়া। রাজশাহী থেকে ঢাকা মহাসড়কের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত পুঠিয়া রাজবাড়ির বিশাল চত্বরে রয়েছে বেশ কয়েকটি নজর কাড়া প্রাচীন মন্দির। 

পুঠিয়া রাজবাড়ীর প্রবেশপথে পুকুর পাড়ে বড় আকৃতির স্থাপনাটি শিব মন্দির। পুঠিয়ার রাণী ভুবন মোহিনী দেবী ১৮২৩ সালে এটি প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিদিকে ৬৫ ফুট দীর্ঘ শিব মন্দিরটি একটি উঁচু ভিতের উপরে নির্মিত এবং এর চার কোণায় চারটি আর কেন্দ্রে একটি রত্ন আছে। মন্দিরের দোতলায় একটি মাত্র কক্ষ এবং কক্ষের চারপাশে দুই স্তরে বারান্দা বিদ্যমান। মূল কক্ষের অভ্যন্তরে অধিষ্ঠিত আছে কষ্ঠি পাথরের বিশাল এক শিব লিঙ্গ। পুরা মন্দিরের দেয়াল পৌরণিক কাহিনি চিত্র খচিত।

এশিয়ার অন্যতম বড় শিব মন্দির বলা হয় পুঠিয়ার এ মন্দিরকে। এর লাগোয়া পূর্ব পাশে গোল গম্বুজ আকৃতির আরেকটি ছোট মন্দির আছে।  

শিব মন্দির।

শিব মন্দির ছাড়িয়ে একটু দক্ষিণে গেলেই চোখে পড়বে চার তলা বিশিষ্ট দোলমন্দির। দোলমঞ্চের আকারে মন্দিরটি ধাপে ধাপে ওপরে উঠে গেছে। চতুর্থ তলার ওপরে আছে গম্বুজাকৃতির চূড়া। প্রত্যেক তলার চারপাশে আছে টানা বারান্দা। ঊনবিংশ শতাব্দির শেষ দশকে পুঠিয়ার রাণী হেমন্ত কুমারী দেবী এ মন্দির নির্মাণ করেন

পুঠিয়া রাজবাড়ির প্রাচীরের ভেতরে পোড়ামাটির অলঙ্করণে সমৃদ্ধ মন্দিরটির নাম গোবিন্দ মন্দির। বর্গাকারে নির্মিত এ মন্দিরের প্রত্যেক পাশের দৈর্ঘ্য ১৪.৬ মিটার। কেন্দ্রীয় কক্ষ ছাড়াও মন্দিরটির চারপাশে বার্গাকার চারটি কক্ষ আছে। মন্দিরটি ২৫০ বছরের পুরানো বলে প্রচলিত থাকলেও এর গায়ে চিত্র ফলক দেখে ধারণা করা হয় যে এটি ঊনবিংশ শতাব্দিতে নির্মিত।

এ মন্দিরের দক্ষিণ পাশে প্রাচীরের বাইরে অলঙ্করণ সমৃদ্ধ ছোট আরেকটি মন্দির আছে।

পুঠিয়া রাজবাড়ির পশ্চিম পাশে দিঘির পশ্চিম তীরে রয়েছে পূর্বমূখী বড় আহ্নিক মন্দির। কারুকার্য মণ্ডিত এ মন্দিরের নির্মাণ শৈলী বেশ আকর্ষণীয়। বড় আহ্নিক মন্দিরের পাশে দড়্গিণমূখী অবস্থানে আছে আরও আকর্ষণীয় গোপাল মন্দির।

রাজশাহী শহরের প্রায় ত্রিশ কিলোমিটার আগে পুঠিয়া। রাজশাহীগামী যে কোনো বাসে গেলে পুঠিয়া নামা যায়। আবার রাজশাহী থেকে লোকাল বাসে পুঠিয়া যেতে সময় লাগে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা।

রাজশাহী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে নাটোরগামী বাসে চড়ে পুঠিয়া নামা যায়। ভাড়া ৪০ থেকে ৫০ টাকা। পুঠিয়ায় থাকার ব্যবস্থা নেই। ভ্রমণ শেষে রাজশাহী শহরে এসে থাকা যাবে।