ইউএস টপোগ্রাফি ম্যাপ, রাশিয়ান টপোগ্রাফি ম্যাপ, গুগল ম্যাপ, গুগল আর্থ, ভ্রমণ বাংলাদেশ, অ্যাডভেঞ্চার বিডিসহ বিভিন্ন অভিযাত্রীদের নেওয়া জিপিএস রিডিংয়ের মাধ্যমে জানা গেছে এখন সাকহাফং-ই বাংলাদেশের অন্যতম সর্বোচ্চ পর্বত শৃঙ্গ।
মাপজোকের হিসাব অনুসারে কোনোটা ৩৪৫৪, ৩৪৪৫ বা ৩৪১০ ফুট। সে যাই হোক দেশের অন্যতম উঁচু জায়গা জয় করার ইচ্ছেটা আর দমিয়ে রাখা গেল না।
তাই তো এক শুভ দিনে যাত্রা হল শুরু। টানা সাত দিনের ট্যাকিং মুখর পথ শেষ করে মেঘের গ্রাম থানচি পৌঁছায় অভিযাত্রীর দল।
থানচি বাজার থেকেই সকালে যাত্রা শুরু করি। কাঁধে পাহাড় সমান ওজনের ব্যাগ। থানচি বাজার ছেড়ে যখন পা বাড়ালাম পাহাড়ের পথে, সকালের সূর্য তখনও পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে আছে।
বসতি মনুষ্যহীন এমন জনপথে সঙ্গী কেবল পাহাড়ের কালো-সাদা মেঘ, হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি, জুমের ক্ষেত, সবুজ ঘ্রাণ আর পাহাড়ি ঝিরির মিষ্টি জল! সকাল গড়িয়ে দুপুরের দিকে অভিযাত্রীর দল পৌছায় ঝিরি তীরের বসতি বোডিং পাড়ায়। এখানে ম্রো আদিবাসিদের বসবাস।
পাড়ার পাশের বয়ে চলছে পাথুরে ঝিরি। সেখানে কিছুক্ষণের জন্য ক্লান্ত শরীরটা ভিজিয়ে আবার উঁচু পাহাড়ের পথ ধরে যাত্রা শুরু। এরিমধ্যে পাহাড়ে বৃষ্টির হানা। বৃষ্টির মধ্যেও কাঁধে ব্যকপ্যাকটা ভিজে পাহাড়ের মতোই ভারি হয়ে উঠল! পাহাড়ের চূড়ায় উঠতেই ভিজিয়ে দিল দলছুট মেঘের দল।
তাজিংডং পাহাড়ের পাদদেশে সুন্দর ছোট্ট এই পাড়া। বম আদিবাসীদের বসবাস। কথা হয় কারবারির সঙ্গে। রাতের থাকার ব্যবস্থা করলেন। শেরকর পাড়ার চারপাশে কেবল সবুজ পাহাড়ের দেয়াল।
সকাল ঘুম ভাঙতেই দেখি দ্বীপের মতো পাহাড় ঘিরে রেখেছে সাদা মেঘের দল। সকলের রোদের আলোয় পাহাড়ে সাদা মেঘের নাচন! পাড়া ছেড়ে আবার রওনা হলাম অরণ্যের পথে।
অরণ্যের পর অরণ্যে পা ফেলছি একের পর এক। পথে পথে মিলছে নগর সভ্যতাহীন এক অন্য কোনো জনপদ। কখনও বুনো প্রজাপতি, কখনও বা অচেনা পতঙ্গ কিংবা বিলুপ্ত প্রায় পাখির ঝাঁক। উড়ে যাচ্ছে চোখের সামনে। শুনশান বাতাসের শব্দ যেন এই পবর্তঘেরা পরিবেশের চিরকালীন সঙ্গী!
এসব না থাকলে হয়ত এত দীর্ঘ ট্র্যাকিং একঘেয়েমিতে পেয়ে বসতো।
পথ যেন শেষই হয় না। সকাল গড়িয়ে দুপুর কোনো এক পাহাড়ি ঝিরির কাছে কিছুক্ষণের বিশ্রাম।
বলে রাখা ভালো— ব্যক্তিগতভাবে ট্রেইলে আমার সবচেয়ে পছন্দের সময় সকাল আর বিকাল। দুপুরটাকে বিদায় জানাতে চায় বিশ্রামের অবসরে। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই, ঝিরিপথ, বুনোফুলের দল এসব পেরিয়ে দীর্ঘ পাহাড় বেয়ে নেমে পৌঁছাই তান্দুই পাড়া।
পাহাড়ের উপর থেকে এই পাড়া দেখতে কেমন জানি বিভ্রম লেগেছিল। যেন গভীর অরণ্যের মাঝে দলবদ্ধ মানুষের বসতি। বিকেল হয়ে যাওয়ায় আজকের রাতটা পাড়ায় থাকতে হবে। পথের ক্লান্তি ভুলতে ঝিরিতে প্রাকৃতিক স্পা শ্রেষ্ঠ মাধ্যম!
ভোরের আলোয় পাড়া থেকে পা ফেললাম সাকাহাফং’য়ের পথে। গাইড হিসেবে সঙ্গী হলেন পাড়ার কারবারি। তিনি জানাল এই পাড়া থেকে একটানা আট ঘন্টা ট্র্যাকিং করলেই পৌঁছানো যাবে।
ঘন জঙ্গলের ভেতরে একের পর এক পাহাড়, জুমের ক্ষেত, বুনো ট্রেইল ঘন মেঘের ভিতর যেন পথ চলা। সকালের ব্যপ্তি পেরিয়ে দুপুর নাগাদ পৌঁছে যায় নেপিউ পাড়ায়। এরপর বাংলাদেশের এই অংশে আর কোনো পাড়া নেই। আছে শুধু পাহাড় আর পাহাড়। পাহাড় পেরিয়ে শুরু মিয়ানমারের সীমান্ত।
সাকাহাফং’য়ের পাদদেশে এই নেপিউ পাড়া। সেখান থেকে বাঁশের ট্রেইল ধরে চূড়ায় উঠতে হবে। পথটা খুব কঠিন হয়ে উঠল। ট্রেইলের পথ বলতে কিছু নেই। বাঁশ আর জঙ্গল কেটে কেটে উঠতে হচ্ছিল উপরের দিকে। গয়ালের ট্রেইল ধরে কোনো রকমে ট্রেক করছি।
চূড়া থেকে এই সভ্যতার কোনো কিছুই চোখে পড়ে না। চোখ জুড়ে কেবল পাহাড় আর পাহাড়। রং বদলানো মেঘের দৃশ্যপট, সবুজের অমলিন রূপ, মিয়ানমারের আরও উঁচু উঁচু বিরতিহীন বন্ধন পাহাড়, শরীর ভিজিয়ে দেওয়া মেঘের শিহরণ!
চূড়ায় কেবল মনে হচ্ছিল— মেঘ বৃষ্টিতে সিক্ত সবোর্চ্চ চূড়ায় দেশের পতাকা নিয়ে ক্যামেরা বন্দি হওয়ার দারুন স্পর্ধা; প্রেরণা হয়ে থাকবে আরও কঠিন পথ চলার!
যেভাবে যাবেন
বিভিন্ন পরিবহনের বাসে ঢাকা/চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি বান্দরবানে যাওয়া যায়। সপ্তাহের প্রতিদিন বান্দরবান থেকে থানচি পযর্ন্ত বাস যায়। অথবা রির্জাভ জীপে করেও থানচি যাওয়া যাবে।
থানচি থেকে সাকাহাফং যাওয়ার একমাত্র পথ ট্র্যাকিং অর্থাৎ হাঁটা। থানচি থেকে গাইড নেওয়া বাধ্যতামুলক। যাওয়ার পথে থানচি ক্যাম্পে নিজেদের নাম-ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করে নিতে হবে।
প্রয়োজনীয় তথ্য
সাকাহাফং’য়ের পথ বেশ দুর্গম তাই প্রস্তুতিও নিতে হবে। ট্র্যাকিং ‘সু’ সম্ভব না হলে প্ল্যাস্টিকের জুতা, প্রয়োজনীয় ওষুধ, ওডোমাস ক্রিম(মশা পোকামাকড় প্রতিরোধক মলম), ফাস্ট এইড, পযার্প্ত খাবার, স্যালাইন এবং ট্রেকিংয়ে রান্না করতে চাইলে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিজেদের সঙ্গে করে নিতে হবে।
বান্দরবানের পাড়াগুলোতে রাতে থাকার ব্যবস্থা আছে। তারপরও চাইলে তাবু নিতে পারেন।
পাহাড়ের পথগুলো সুন্দর থাকুক। পথে কোনো বোতল, প্যাকেট, প্ল্যাস্টিক ইত্যাদি ফেলবেন না। এসব কিছু নিজেদের সঙ্গে বহন করে নিয়ে আসবেন। প্রকৃতিকে সুন্দর রাখুন।
সাকাহাফং ভ্রমণে যেকোনো তথ্য ও সহযোগিতার জন্য যোগাযোগ করতে পারেন ০১৫৫৬৭১০০৪৩, ০১৮১৫৮৫৬৪৯৭ নম্বরে।
ছবি: লেখক।