বর্ষা শেষের চা বাগানে

চায়ের রাজধানী মৌলভী বাজার জেলার শ্রীমঙ্গলের চা বাগানগুলো ভ্রমণের জন্য উৎকৃষ্ট। সবুজে সবুজে ভরা চা বাগানে বেড়ানোর আসল সময় এটাই।

মুস্তাফিজ মামুনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 August 2015, 09:57 AM
Updated : 30 August 2015, 11:53 AM

এসেছে শরৎ। তবে চা বাগানের বর্ষা এখনও শেষ হয়নি। মে মাস থেকে শুরু হওয়া পাতা তোলার মৌসুম এখনও চলছে চা বাগানগুলোতে। চলবে মূলত অক্টোবরের শেষ অবধি।

সাদা ধবধবে এক নারী, পিঠে ঝোলানো ঝুড়ি, কোমল হাতে তুলে চলছেন চা পাতা। ঢাকা-শ্রীমঙ্গল মহাসড়কে রশিদপুর ছাড়িয়ে একটু সামনে গেলেই এক বাঁকে এই চা কন্যার দেখা মেলে।

সাতগাঁও চা বাগানের সহায়তা নিয়ে দৃষ্টিনন্দন এই ভাস্কর্য তৈরি করেছে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন। এর নাম ‘চা কন্যা’।

হবিগঞ্জ জেলার শেষ প্রান্তে এবং মৌলভীবাজার জেলার প্রবেশদ্বারে প্রায় চব্বিশ ফুট উঁচু ভাষ্কর্যটি চায়ের রাজধানীতে সব পর্যটককে যেন স্বাগত জানাতেই ঠাঁয় দাঁড়িয়ে আছে। ২০১০ সালের শুরুতে এ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন শিল্পী সঞ্জিত রায়। ‘চা কন্যা’ ভাস্কর্যের পাশেই সাতগাঁও চা বাগান। পাহাড়ের গায়ে গায়ে এ চা বাগানের সৌন্দর্য অপূর্ব। চা কন্যাকে দেখে ঢুঁ মারতে পারেন এই বাগানেও।

তারপর সোজা চলে যান শ্রীমঙ্গল শহরে। শহরের মৌলভীবাজার সড়ক ছেড়ে হাতের ডানে ভানুগাছ সড়ক। এপথে কিছুটা সামনে গেলেই সড়কের দুই পাশে দেখা যাবে চা বাগান আর চা বাগান। এগুলো ফিনলের বাগান।

শ্রীমঙ্গলে মৌলভীবাজার জেলার প্রবেশদ্বারে অনিন্দ সুন্দর ভাস্কর্য ‘চা কন্যা’। সাতগাঁও চা বাগানের সহায়তায় মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসন ২০১০ সালে নির্মাণ করে ভাস্কর্যটি। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন

শ্রীমঙ্গল শহরের আগে সাতগাঁও চা বাগান। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন

সড়কের পাশে গাড়ি থামিয়ে দুদণ্ড সময় কাটাতে পারেন। এ পথে আরও সামান্য সামনে গেলে হাতের বাঁয়ে চা বাগানের ভেতর থেকে একটি পাকা সড়ক সোজা দক্ষিণে চা গবেষণা কেন্দ্রের দিকে চলে গেছে। এ সড়কের আরেকটু ভেতরে গেলে মাইলের পর মাইল ফিনলের চা বাগান।

এই বাগান থেকে বেড়িয়ে আবারও চলে আসুন ভানুগাছ সড়কে। চলতে থাকুন লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের দিকে। এ পথে প্রায় ১২ কিলোমিটার গেলে কমলগঞ্জ শহর। সেখান থেকে আবারও হাতের বায়ের সড়কে কয়েক কিলোমিটার গেলে মাধবপুর। এখানে বিশাল এক হ্রদ ঘিরে আছে সরকারী প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল টি কোম্পানির চা বাগান।

মাধবপুর লেকের আশপাশের এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এ বাগানের সৌন্দর্য একেবারেই আলাদা। একটু সময় নিয়ে ঘুরতে পারেন। মাধবপুর লেকের দক্ষিণ পাশের পাহাড়েও আছে চা বাগান। এ পাহাড়ে উঠে দেখে নিতে পারেন লেকের অন্যরকম সৌন্দর্য।

মাধবপুর লেক থেকে বেড়িয়ে হাতের বাঁয়ে পিচঢালা পথে চলুন এবার। আঁকাবাঁকা এ পথ চলে গেছে একেবারে ধলই সীমান্তে। পথের দুই পাশে শুধুই চা বাগান। তবে এ পথের সম্ভবত সবেচেয়ে সুন্দরতম বাগানের নাম ‘শ্রীগোবিন্দপুর’।

বেসরকারি মালিকানাধীন এ চা বাগান একেবারেই ছবির মতো সাজানো। আরও দক্ষিণে গেলে বাংলাদেশ সীমান্ত। আর সীমান্ত ঘেঁষেই আছে বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান স্মৃতিসৌধ। এখানে থেমে শ্রদ্ধা জানাতে পারেন দেশের শ্রেষ্ঠ এ সন্তানের প্রতি।

শ্রীমঙ্গলে ফিনলে চা বাগানে বৃষ্টি। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন

শ্রীমঙ্গলে ভানুগাছ সড়কের পাশে ফিনলে চা বাগান। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন

এবার একটু পেছনে এসে ইট বাঁধানো একটি পথ চলে গেছে হাতের বাঁয়ে। এ পথে চলতে প্রথমে ভয় লাগতে পারে। একবারেই নির্জন চারপাশ। চলতে চলতে নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে কষ্ট হবে। এটিই ধলই চা বাগান।

এখানে উঁচু উঁচু পাহাড়ের গায়ে কেবল চা বাগানেরই সৌন্দর্য। চলতে থাকুন এ পথে। চা বাগান দেখতে দেখতে একসময় চলে আসবেন আবারও ফিনলে চা বাগানে। একেবারে শ্রীমঙ্গল শহরের পাশেই।

চা বাগান ভ্রমণ শেষে ঢুঁ দিতে পারেন ঐতিহ্যবাহি নীলকণ্ঠ কেবিনে। সাত রঙের চা ছাড়াও নানান বাহারি চা পাওয়া যায় এখানে। শ্রীমঙ্গল শহরের অনেক জায়গায় সাতরঙা চা পাওয়া গেলেও বিজিবি দপ্তরের পাশেই হল আসল নীলকণ্ঠ কেবিন।

কীভাবে যাবেন

শ্রীমঙ্গলের এ চা বাগানগুলো ভালোভাবে ভ্রমণের জন্য নিজস্ব গাড়ি নিয়ে গেলে ভ্রমণ সহজ হবে।

তবে ঢাকা থেকে বাসে কিংবা ট্রেনে শ্রীমঙ্গল পৌঁছে সেখান থেকেও গাড়ি ভাড়া করে চা বাগানে বেড়াতে পারেন।

ঢাকার ফকিরাপুল ও সায়দাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজ, শ্যামলী পরিবহন, সিলেট এক্সপ্রেস ইত্যাদি পরিবহনের নন এসি বাস যায় শ্রীমঙ্গল। ভাড়া ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা।

এছাড়া ঢাকার কমলাপুর থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। দুপুর ২.০০ মিনিটে প্রতিদিন ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।

শ্রীমঙ্গলে ভানুগাছ সড়কের পাশে ফিনলে চা বাগানে পাতা তোলায় ব্যস্ত নারী শ্রমিক। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন

বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ১০.০০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস এবং শুক্রবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন বিকেল ৪ টায় কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া ১১৫ থেকে ৭৬৫ টাকা।

রেলপথে সাধারণত ঢাকা থেকে শ্রীমঙ্গল পৌঁছুতে সময় লাগে প্রায় পাঁচ ঘন্টা। এছাড়া চট্টগ্রাম রেলপথে সরাসরি শ্রীমঙ্গল যাওয়া যায়।

চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯.০০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ২৩০ থেকে ৯৪৩ টাকা।

কোথায় থাকবেন

শ্রীমঙ্গলে পর্যটকদের থাকার জন্য সবচেয়ে ভালো ব্যবস্থা ভানুগাছ সড়কে টি রিসোর্ট (০৮৬২৬-৭১২০৭, ০১৭১২৯১৬০০১)।

এছাড়া এই রাস্তায় আছে আধুনিক মানের গ্র্যান্ড সুলতান গলফ রিসোর্ট। পাঁচ তারকা মানের এ রিসোর্ট বেশ ব্যয়বহুল (০২-৯৮৫৮৮২৭, ০১৭৩০৭৯৩৫৫২-৭)।

শ্রীমঙ্গলের অন্যান্য থাকায় জায়গা হল: হবিগঞ্জ সড়কে রেইন ফরেস্ট রিসোর্ট (০২-৯৫৫৩৫৭০, ০১৯৩৮৩০৫৭০৭) ও টি টাউন রেস্ট হাউস (০৮৬২৬-৭১০৬৫)। কলেজ রোডে হোটেল প্লাজা (০৮৬২৬-৭১৫২৫) ইত্যাদি।

এছাড়া শ্রীমঙ্গলের রাধানগরে চমৎকার দুটি রিসোর্ট হল: নিসর্গ নিরব ইকো রিসোর্ট (০১৭১৫০৪১২০৭) এবং নিসর্গ লিচিবাড়ি ইকো রির্সোট (০১৭১৬৯৩৯৫৪০)।

প্রায়োজনীয় তথ্য

শ্রীমঙ্গলের চা বাগানগুলো বেড়ানোর জন্য পূর্ণ একদিনই যথেষ্ঠ। যে কোনো চা বাগানে প্রবেশের আগে কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিন। চা শ্রমিকদের ছবি তোলার আগেও অনুমতি নিন।