কাছে যাওয়া না গেলেও দুটি ঝরনারই শীতল পানির পরশ নেওয়া যায় সহজেই। কারণ ঝরনার স্রোতধারা সে দুই দেশের সীমান্তের বাঁধা মানে না। দিনেরাতে তার প্রবাহমান জল এসে ঠিকই মিশে পিয়াইনের গতিপথে।
আর এ ঝরনা দুটির আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে যেতে হবে বর্ষায়।
পান্তুমাই
পান্তুমাই ঝরনার রূপ দেখতে হলে গোয়াইনঘাটের হাদারপাড় হয়ে নৌকায় যেতে হবে। পাহাড়ি নদী পিয়াইনের আসল সৌন্দর্য দেখা যাবে এই ভ্রমণে।
গোয়াইনঘাট উপজেলার পশ্চিম জাফলং ইউনিয়নের একটি গ্রাম পান্তুমাই। এর পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে আঁকাবাঁকা পিয়াইন নদী। শীতে পাহাড়ি এ নদী শুকিয়ে গেলেও বর্ষায় জলে টইটম্বুর থাকে।
শীতে এ ঝরনায় পানি থাকেনা বললেই চলে। বর্ষা এবং বর্ষা পরবর্তী দুই মাস ঝরনায় প্রাণ ফিরে পায়। পান্তুমাই গ্রাম থেকে পাহাড়ি এ ঝরণা মায়াবি রূপ দেখে যে কোনো পর্যটকেরই মন খারাপ হতে পারে। এত কাছে এসেও তাকে আরও কাছে থেকে না দেখতে পারার আফসোস নিয়েই তাই ফিরতে হবে সবাইকে। তবে পিয়াইনের স্বচ্ছ পানিতে অপরূপ এ ঝরনার প্রতিবিম্ব ছুঁয়েই সে আফসোসের কিছুটা হলেও দূর করা সম্ভব।
লক্ষণছড়া
পান্তুমাই থেকে পিয়াইন নদী ধরে হাদারপাড়ের উদ্দেশ্যে ফিরতি পথে দেখা যাবে আরেকটি পাহাড়ি ঝিরি। এর নাম লক্ষণছড়া। এটিও ঝিরিও ভারতের মেঘালয়ের পাহাড় থেকে এসে বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়েছে। ভারতের ঝিরিটি দেখতে হলে পিয়াইন নদী ধরে চলতে চলতে পূর্ব রুস্তমপুর গ্রামে নামতে হবে। সেখান থেকে লক্ষণছড়া প্রায় বিশ মিনিটের হাঁটাপথ।
তবে ভরা বর্ষায় এলাকার নিচু জমি ডুবে গেলে একেবারে লক্ষণছড়ার খুব কাছাকাছি ছোট ইঞ্জিন নৌকায়ই যাওয়া যায়।
এখানে রুস্তমপুর গ্রামে ১২৬৬ নং সীমানা পিলারের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে লক্ষণছড়া। পিলারের কাছে দাঁড়িয়ে একটু দূরে সবুজের মাঝে একটি বাঁকানো সেতু দেখা যায় ঝিরির উপরে। সেটা ভারতের মধ্যে।
পিয়াইন নদীর পাড়ে রুস্তমপুর গ্রামের মেঠো পথ ধরে লক্ষণছড়ায় হেঁটে যেতে ভালো লাগবে। ভারতের আকাশছোঁয়া পাহাড়ের পাদদেশে এই গ্রাম ছবির মতো সাজানো। চলতি পথে এ গ্রামের পাশে দেখা যেতে পারে ভারত বাংলাদেশের একটি হাট।
স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা গেল সপ্তাহে দুই দিন এই হাট বসে। পর্যটকদের এ হাটে যাওয়া নিরাপদ নয়। তাতে অবৈধ অনুপ্রবেশের দায়ে পড়তে পারেন। ভারতের খাসিয়ারা তাদের উৎপাদিত পান, সুপারি আর বাংলাদেশিরা মাছ, সবজি নিয়ে আসেন এ বাজারে।
কীভাবে যাবেন
পান্তুমাই ও লক্ষণছড়া ঢুঁ দিতে প্রথমে যেতে হবে সিলেট শহরে। সড়ক, রেল ও আকাশ পথে ঢাকা থেকে সরাসরি সিলেট যাওয়া যায়। চট্টগ্রাম থেকেও সিলেটে পৌঁছান যায়।
ঢাকার ফকিরাপুল, সায়দাবাদ ও মহাখালী বাস স্টেশন থেকে সিলেটের বাসগুলো ছাড়ে। এ পথে গ্রীন লাইন পরিবহন, সৌদিয়া এস আলম পরিবহন, শ্যামলি পরিবহন ও এনা পরিবহনের এসি বাস চলাচল করে। ভাড়া ৮শ’ থেকে ১ হাজার ১শ’ টাকা।
এছাড়া শ্যামলী পরিবহন, হানিফ এন্টারপ্রাইজ, ইউনিক সার্ভিস, এনা পরিবহনের পরিবহনের নন এসি বাস সিলেটে যায়। ভাড়া ৪শ’ থেকে সাড়ে ৪শ’ টাকা। এনা পরিবহনের বাসগুলো মহাখালী থেকে ছেড়ে টঙ্গী ঘোড়াশাল হয়ে সিলেট যায়।
ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে মঙ্গলবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে ছেড়ে যায় আন্তঃনগর ট্রেন পারাবত এক্সপ্রেস। সপ্তাহের প্রতিদিন দুপুর ২টায় ছাড়ে জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস। বুধবার ছাড়া সপ্তাহের প্রতিদিন রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ে উপবন এক্সপ্রেস। শুক্রবার ছাড়া প্রতিদিন বিকাল ৪টায় ছাড়ে কালনী এক্সপ্রেস। ভাড়া দেড়শ থেকে ১ হাজার ১৮ টাকা।
এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে সোমবার ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস এবং শনিবার ছাড়া প্রতিদিন রাত ৯টা ৪৫ মিনিটে উদয়ন এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৪৫ থেকে ১ হাজার ১৯১ টাকা।
সিলেট শহর থেকে পান্তুমাই ও লক্ষণছড়ায় পৌঁছাতে প্রথমে যেতে হবে হাদারপাড়। তবে হাদারপাড়ে যাওয়ার সহজ পথ হল শহর থেকে মালনিছড়ার পথে ওসমানী বিমান বন্দরের পেছনের ভোলাগঞ্জের সড়ক।
তবে এ সড়ক বর্তমানে বেহাল। পাথর বোঝাই ট্রাক চলাচলের কারণে রাস্তায় প্রচুর গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। তাই এ পথে সেডান কার কিংবা মাউক্রো বাস নিয়ে যাওয়া দুষ্কর। এ পথে সবচেয়ে সহজ ও সুবিধা হল অটো রিকশা।
সিলেট শহর থেকে হাদারপাড়ের যাওয়া আসার অটো রিকশা ভাড়া ১ হাজার ৫শ’ থেকে ২ হাজার টাকা। হাদারপাড় বাজারের পোস্ট অফিস ঘাট থেকে পান্তুমাই ও লক্ষণছড়া যাওয়ার রিজার্ভ পর্যটক নৌকা পাওয়া যায়। ১০ থেকে ২০ জন চলার উপযোগী একটি নৌকার ভাড়া ১ হাজার ২শ’ থেকে ২ হাজার টাকা।
হাদারপাড় থেকে পান্তুমাই ও লক্ষণছড়া ভ্রমণে পর্যটক নৌকা ভাড়া নিয়ে যোগাযোগ করতে পারেন এই নম্বরে ০১৭১২৯৭২৫৯৮।
কোথায় থাকবেন
এ ভ্রমণে রাতে থাকতে হবে সিলেটে। এ শহরে থাকার জন্য বেশ কিছু ভালো মানের হোটেল আছে। শহরের শাহজালাল উপশহরে হোটেল রোজ ভিউ (০৮২১-৭২১৪৩৯), দরগা গেইটে হোটেল স্টার প্যাসিফিক (০৮২১-৭২৭৯৪৫), ভিআইপি রোডে হোটেল হিলটাউন (০৮২১-৭১৬০৭৭), বন্দরবাজারে হোটেল মেট্রো ইন্টারন্যাশনাল (০৮২১-৭২১১৪৩), নাইওরপুলে হোটেল ফরচুন গার্ডেন (০৮২১-৭১৫৫৯০), জেল সড়কে হোটেল ডালাস (০৮২১-৭২০৯৪৫), লিঙ্ক রোডে হোটেল গার্ডেন ইন (০৮২১-৮১৪৫০৭), আম্বরখানায় হোটেল পলাশ, (০৮২১-৭১৮৩০৯), দরগা এলাকায় হোটেল দরগাগেইট (০৮২১-৭১৭০৬৬), হোটেল উর্মি (০৮২১-৭১৪৫৬৩), জিন্দাবাজারে হোটেল মুন লাইট (০৮২১-৭১৪৮৫০), তালতলায় গুলশান সেন্টার (০৮২১-৭১০০১৮) ইত্যাদি।
এসব হোটেলে ১ হাজার থেকে ১০ হাজার টাকায় বিভিন্ন মানের কক্ষ আছে।
পান্তুমাই এবং লক্ষণছড়া দুটি জায়গাই সিমান্ত ঘেঁষা। তাই ভ্রমণে যেয়ে কোনোভাবেই সিমান্ত অতিক্রম করা যাবেনা। জায়গা দুটির সৌন্দর্য কেবল বাংলাদেশ অংশে থেকেই উপভোগ করতে হবে। এছাড়া বর্ষায় পিয়াইন নদী বেশ খরস্রোতা। তাই সাঁতার না জানলে সঙ্গে লাইফ জ্যাকেট নিতে হবে।
জায়গা দুটিতে কোনো রকম প্লাস্টিক প্যাকেট কিংবা বর্জ্য ফেলে নস্ট করবেন না।