বিজ্ঞানের গল্প

যারা বয়সে আমার চাইতে বেশ খানিকটা ছোট, তাদের সঙ্গে বিজ্ঞানের গল্প বলতে যাওয়ার মেলা বিপদ! প্রথম বিপদটা হচ্ছে, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা সবাই জানে যে বিজ্ঞানের গল্প একেবারে খাঁটি সত্যি হতে হয়। ওই গল্পে কোনো ফন্দিতেই একটুখানি ফাঁকি মিলিয়ে দেওয়া যায়না।

>> রজিউদ্দীন রতনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 July 2014, 02:10 PM
Updated : 24 July 2014, 03:23 PM

তারমানে হচ্ছে, ওদেরকে বিজ্ঞানের কথা বলতে গেলে আগে ভালোমত জেনে নিয়ে তারপর বলতে হয়! সেইখানে আরেক বিপত্তি! আজকালকার ছেলেমেয়েদের কাছে নতুন কিছু বলতে গেলেই বুঝতে পারা যায়, সব তারা আগে থেকে জেনে বসে আছে!

এই যেমন আমি যদি বলতে যাই, সৃষ্টিতে শুধু আলোর গতি হচ্ছে ধ্রুব। তারমানে, আলোর দৌড়বার যে গতি, সেই গতিটার কোনো পরিবর্তন হয়না। ধরো, যে দৌড়বিদ; মানে যার কাজ হচ্ছে দৌড়ে দৌড়ে বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় প্রথম হওয়া, তারও গতি বদলায়। কখনো তার পায়ে ব্যথা অথবা তার পেট গুড়গুড় করছিল দৌড়বার সময় কিংবা সেদিনই তার বউ তাকে ইচ্ছেমত বকুনি দিয়েছে! এতসব ঝামেলা নিয়ে তার দৌড়বার গতি গেল কমে। আর সে মনে মনে ভাবতে লাগল, ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাই বুদ্ধিমান, তারা কেউ বোকাদের মতো বিয়ে করে বসে থাকে না!

যা বলছিলাম, আমি যদি তোমাদের বলতে যাই আলোর গতি কখনও বদলায় না। তাহলে তোমরা বলবে সে তো স্কুলে যাওয়ার আগে থেকেই তোমরা জানো। আমি যদি বলতে যাই, কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যকর্ষণ শক্তি এতো বেশি যে তার ভেতর থেকে আলোও বাইরে বের হয়ে আসতে পারেনা। বরং তার আশেপাশে যেই যায় তাকে কৃষ্ণগহ্বর গিলে খেয়ে ফেলে। তাহলেও আমি নিশ্চিত, তোমরা বলবে এসব শিশুদের বিজ্ঞান তোমরা সেই অনেককাল আগে থেকেই জেনে বসে আছ!

আমি কয়েকবার কয়েকজন ছোট ছেলেমেয়েকে ধমক দিয়ে থামিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ওরা এত বুদ্ধিমান যে তাদেরকে থামিয়ে রাখা গেল না। সবকিছু নিয়ে যে প্রশ্ন করা যায় আর সবকিছু নিয়ে যে প্রশ্ন করতে হয় সে তারা জানে। তারা জানে যে বুদ্ধিমানেরা প্রশ্ন করে, জানতে চায়। বোকারা গায়ের জোরে প্রশ্নকে থামিয়ে রাখতে চায়। মানুষের মধ্যে যদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রশ্ন করার মতো বুদ্ধিমানেরা না জন্মাত তাহলে বোকারা এই পৃথিবীর সব গাছ কেটে ফেলত, সব পশুপাখি মেরে ফেলত, আর সবার চেয়ে বেশি বোকা যারা, তারা নানারকম অস্ত্রপাতি বানিয়ে নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেত।

কিন্তু তোমাদের মতো বুদ্ধিমান মানুষেরা জন্মেছিল বলেই মানুষ বড়ো বাঁচা বেঁচে গেছে। হয়তো তোমাদের মতো বুদ্ধিমান কেউ প্রশ্ন করেছিল, এতো যে লক্ষ্মী প্রাণি কুকুর, এরা কোথা থেকে এল? তারপর হয়তো তোমাদের মতো বুদ্ধিমান অনেকে মিলে খুঁজে খুঁজে ভেবে চিন্তে দেখল, ধূসর রঙের নেকড়ের থেকে কুকুরের উদ্ভব হওয়ার সম্ভাবণা সবচে বেশি। তারপর হয়তো কেউ প্রশ্ন করল, এরকম একটা প্রাণি থেকে আরেকটা প্রাণির উদ্ভব হতে পারে? সবাই মিলে তখন অনেক গবেষণা করে আর অনেক তথ্য জোগাড় করে দেখল যে, একেবারে খুব খুউব সম্ভব। সকল প্রাণির উদ্ভব হয়েছে আসলে সেভাবেই।

প্রাণির কোষে একটা প্রাকৃতিক নিয়মাবলী লেখা থাকে তা তো তোমরা জানোই। ওই নিয়মাবলীকে বলে ডিএনএ। ডিএনএ হচ্ছে লম্বা। আর তার কাজও অনেক। ডিএনএ বলে দেয় প্রাণিটা কুকুর হবে নাকি শেয়াল; টুনটুনি পাখি হবে নাকি ব্যাঙ! ডিএনএ-কে কীভাবে ভাগ করে জানো? তার কাজের হিসেবে। যেমন ধরো তোমার পেন্সিলের বাক্স। দেখতে সে একটাই পেন্সিলের বাক্স, আর তাতে থাকে কেবল কলম-পেন্সিল। কিন্তু তুমি জানো, দেখতে খানিকটা একরকম মনে হলেও আসলে সব এক নয়। তাতে লাল রঙের পেন্সিল আছে, নীল রঙের পেন্সিল আছে, দাগ মুছে ফেলার রাবার আছে, পেন্সিল কাটার কল আছে, সরু নিবের কলম আছে, মোটা দাগের মার্কার আছে, এমনকি হয়তো দুয়েকটা কলম আছে যাতে দাগই পড়েনা! প্রাণি কোষের ডিএনএও ওইরকম। তার একেকটা কাজের অংশকে বলে জিন। তোমার ডিএনএ-তে আছে ২০ হাজারেরও বেশি জিন। তারমানে তোমার ডিএনএ যদি একটা পেন্সিলের বাক্স হয় তাহলে তাতে কলম-পেন্সিল আছে অন্তত ২০ হাজার। 
তোমার একটা জিনে হয়তো লেখা আছে তোমার চোখের রঙ বাদামি হবে। একটাতে লেখা আছে তোমার চুলের রঙ হবে কালো। একটাতে হয়তো লেখা আছে তোমার থাকবে টুকটুকে নাক। তোমার হাজারো জিনের হাজারো কাজ। আর সবগুলো জিনের কাজের ফলাফল হচ্ছ তুমি। এইখানে একটুখানি বলে রাখি, মানুষের যতগুলো জিন রয়েছে তাদের সবগুলো কী কী কাজ করে তা বুদ্ধিমান মানুষেরা এখনও খুঁজে বের করতে পারেননি। তারা এখনো চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখন যেহেতু তোমাদের মতো বুদ্ধিমান ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা জন্ম নিয়েছ, এখন আর আমাদের কোনো চিন্তা নেই। আরেকটু বড় হয়েই তোমরা খুঁজে বের করে ফেলবে মানুষের সবগুলো জিনের কোনটা কী কাজ করে। হয়তো দেখবে দুয়েকটা জিন বেয়াড়াভাবে খানিকটা বদলে গেলে মানুষের খুব কঠিন অসুখ হয়। পেন্সিলের বাক্সের দুয়েকটা বেয়াড়া কলম যেমন কালি ছড়িয়ে সব নষ্ট করে ফেলে সেরকম! তোমরা নিশ্চয়ই সেসব বদলে যাওয়া বেয়াড়া জিনকে সারিয়ে তুলে অনেক মানুষকে বাঁচিয়ে তুলবে। আর কয়েকটা বছর পর জিনের কাজকারবার তোমরা আরেকটু শিখে গেলেই আমরা তখন নিশ্চিন্ত হয়ে বাঁচব।
সেই পুরনো গল্পে ফেরত যাই। বলছিলাম, একটা প্রাণি থেকে প্রকৃতিতে আরেকটা প্রাণির উদ্ভব হতে পারে আর সেরকমই হয়। ধরো একটা নেকড়ে। তার বড়বড় দাঁত আর লম্বা লম্বা লোম আর সে শুধু হাউকাউ করে ভয় দেখায়। তোমরা তো জানোই, তার রয়েছে বড়বড় দাঁতের জন্য নির্দিষ্ট জিন, লম্বা লম্বা লোমের জন্য নির্দিষ্ট জিন, আর হাউকাউ স্বভাবের জন্যও এটাসেটা জিন। এখন যদি দুম করে তার বড়োবড়ো দাঁতের জিনটা বদলে গেল, হয়ে গেল খানিকটা ছোট ছোট দাঁত। আর তার বড়োবড়ো লোমের জিনটা দমে গিয়ে হল ছোট ছোট লোম। আর তার হাউকাউ স্বভাবের জিনগুলোও চাপা পড়ে গেল আর স্বভাব হল ভালো ভালো মানুষদের মতো নরম সরম। এরকম অল্পকিছু পরিবর্তন হয়ে গেলে একটা নেকড়ে হয়ে যায় একটা কুকুর। তুমি যদি একটা নেকড়ে আর কুকুরকে মিলিয়ে দেখ, তাহলে দেখবে তাদের মধ্যে পার্থক্য ওই সামান্যই। তুমি যদি একটা নেকড়ের ডিএনএ আর একটা কুকুরের ডিএনএ আলাদা করে মিলিয়ে দেখ, তাহলে দেখবে ঠিক যেকরম হওয়ার কথা, তাদের ডিএনএ-তেও পার্থক্য ওই সামান্যই।

তোমরা তো জানোই ডিএনএ সহসা বদলায় না। কিন্তু একটু একটু করে বদলায় ঠিকই। একটু একটু করে বদলায় বলে পরিবর্তনগুলো আমাদের চোখে ঝট করে ধরা পড়েনা। সেইজন্য প্রকৃতিতে একটা প্রাণির থেকে আরেকটা প্রাণির উদ্ভব হতে হাজার-লক্ষ বছর সময় লাগতে পারে। এই হিসেব খুব সহজ। একটা আস্ত প্রাণি বদলে যেতে তার অনেকগুলো জিন বদলে যেতে হয়। জিন আবার বদলালেই হয়না, তাকে মানানসইভাবে বদলাতে হয়। ধরো, একটা নেকড়ের দাঁতের জিন বদলে গিয়ে হয়ে গেল খুব ছোট দাঁত। সেটা তখন

হয়তো মানানসই পরিবর্তন হবেনা, কারণ তখন সে শিকার না করতে পেরে না খেয়ে মরবে। অথবা তার পায়ের জিন বদলে গিয়ে হয়ে গেল ছোট ছোট পা। তখন সে দৌড়তে না পেরে মরবে। এমন যদি হয়, ওই ছোট ছোট পা আর দাঁতওয়ালা নেকড়েটা ঘাস-পাতা খাওয়া শিখে ফেলল আর জোড়ে না দৌড়ে বরং ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে বাঁচতে শিখল, তখন হয়তো আমরা সেটাকে একটা নতুন নামে ডাকব। তার অনেক বছর পর ওই ঘাস-পাতাখেকো নতুন প্রাণিটা যখন ছানাপোনা দিয়ে একটা বংশ হয়ে যাবে তখন হয়তো কেউ জানবেও না ওদের আদি-মা ছিল একটা নেকড়ে। তারও অনেক বছর পর তোমাদের মত বুদ্ধিমান মানুষেরা হয়তো অনেক হিসেব করে, গবেষণা করে, তার ডিএনএ পড়ে দেখে তারপর বলতে পারবে আসলে কী হয়েছিল, কেন হয়েছিল!

কখনও কখনও দেখবে, একেবারে খাঁটি বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ থাকার পরেও বোকারা বলবে, না! সে কী করে হয়! এ আমরা মানব না। তখন তোমাদের নিশ্চয়ই হাসি পাবে। তোমাদের নিশ্চয়ই অনেক কষ্টও হবে। কিন্তু তোমরা থেমে থাকবে না। তোমাদেরকে সাহস দেওয়ার জন্য বলছি না। তোমাদেরকে সাহস দেয়ার কী আছে! তোমরা এমনিতেই সাহসী।বলছি, কারণ আমি জানি তোমরা থেমে থাকবে না। তোমরা প্রশ্ন করবে বুদ্ধিমানের মতো। তোমরা জবাব খুঁজবে যৌক্তিক। আর সত্য, সে যতই অবিশ্বাস করতে ইচ্ছে করুক, সেই সত্যকে তোমরা জানাবে। আর আমরা তখন নিশ্চিন্ত হয়ে জানব, তোমরা বুদ্ধিমান ছিলে বলেই মানুষেরা বেঁচে গেল।