ছোটবেলায় এই পদ্যটি পাঠ্যপুস্তকে পড়ে কবি আহসান হাবীব নামটি আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল। অবশ্য পাঠ্যপুস্তকে পড়া সকল কবি-লেখকই প্রিয় হয়ে উঠেছিল। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ আমার অন্তরে অধিক জায়গা করে নিতে সক্ষম হয়েছিলেন, যেখানে কবি আহসান হাবীব অন্যতম।
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল ১৯৮৪ সালের শেষ দিকে। তখন আমি দু-চারটি কবিতা লেখা শুরু করেছি। দৈনিক বাংলার ডাকসাঁইটে সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের কাছে গিয়ে সেগুলো দেখবার দুঃসাহস দেখালাম। তাঁর ব্যবহার এত মুগ্ধ করল যে আমার ভয়ভীতি কখন কোথায় উধাও হয়ে গেল টের পাইনি। তিনি মনোযোগ দিয়ে কয়েকটি কবিতা পড়ে ছন্দের ত্রুটি, শব্দের ত্রুটি, বাক্যের ক্রটি ধরিয়ে সেগুলির নিচে দাগ টেনে দিলেন।
বললেন, “প্রতিভা আছে, চেষ্টা করলে তুমি বড় কবি হতে পারবে।”
১৯৮৫ সালের এপ্রিল / মে মাসের দিকে ১০টি কবিতা নিয়ে আবার দেখা করলাম প্রিয় কবির সঙ্গে। তিনি সযত্নে রেখে দিয়ে বললেন, “দু-তিনদিন পরে এসো, আমি দেখে রাখব।”
সাভারে গিয়ে দুলাভাইয়ের বাসায় উঠলাম। সেখান থেকে দুদিন পর এসে যখন দৈনিক বাংলার সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কবির কক্ষে প্রবেশ করলাম, তিনি তখন বের হবার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। সালাম দিয়ে দাঁড়াতেই আমার কবিতাগুলো হাতে নিয়ে বললেন, “আমি একটু বেরুচ্ছি, তুমি আমার সঙ্গে এসো।” বলে পাশের রুমে কবি নাসির আহমেদের কাছে নিয়ে গিয়ে বললেন, “এই ছেলেটির কবিতাগুলো আমি সংশোধন করে রেখেছি, তুমি একটু বুঝিয়ে দ্যাও।”
তিনি যাওয়ার পর কবি নাসির আহমেদ আমাকে বসিয়ে আমার কবিতার প্রতিটি শব্দ ও বাক্য ধরে ধরে বোঝালেন, যেগুলোতে কবি আহসান হাবীব দাগ দিয়ে রেখেছেন।
শুরুতেই তিনি আমার নামের নিচে লম্বা দাগ দিয়েছেন দেখে আমি অবাক। নাসির ভাই বুঝিয়ে বললেন, কবির নাম হতে হবে আধুনিক। ‘রাত্রি’ শব্দটিকে করেছেন ‘রাত’। ইত্যাদি।
ভাবলাম ‘রাত্রিশেষ’ দিয়ে যিনি শুরু করেছেন তিনিই ‘রাত্রিকে’ বর্জন করতে যাচ্ছেন। বুঝে নিতে কষ্ট হল না আধুনিকের পরও আধুনিকতা থাকে। একজন কবিকে আধুনিক হওয়াটা জরুরি। বাড়ি ফিরে আমি আধুনিকতার দিকে মনোনিবেশ করলাম যেভাবে কবি নাসির আহমেদ আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল শুভ্র কেশধারী আধুনিক মানুষটির ছবি, যেন কবিতার মতো তাঁর মুখ।
নিজ গ্রামে আমার প্রতিষ্ঠিত একটি সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ছিল। জরুরি সভা ডেকে ১২ জুলাই বিকালে কবি আহসান হাবীব স্মরণে শোকসভা করলাম। প্রত্যন্ত অঞ্চল হলেও শতাধিক লোক উপস্থিত হয়েছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। একজন কবিকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পেরে বুকটা অনেক হালকা হয়েছিল।
আমি মনে করি, এখন আর কবি আহসান হাবীবের মতো কোনো সাহিত্য সম্পাদক নেই, যিনি অজপাড়াগাঁ থেকে আসা কোনো তরুণকে স্বপ্ন দেখাতে পারেন। তাঁর লেখার ভুলত্রুটি শুধরে দিতে পারেন।
কবি আহসান হাবীবের জন্ম ১৯১৭ সালের ২ জানুয়ারি পিরোজপুর জেলার শংকরপাশা গ্রামে। পিতা হামিজউদ্দিন হাওলাদার ও মাতা জমিলা খাতুন। কবি হওয়ার একান্ত বাসনা থাকায় ও তাঁর পিতার সঙ্গে সামান্য মনোমালিন্য হয়।
তিনি ১৯৩৬ সালের শেষ দিকে কলকাতা চলে যান। এসএসসির পর আর লেখাপড়া এগোয়নি। শুরু থেকেই সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত হন। আকাশবাণী কলকাতায়ও কিছুদিন কাজ করেছেন।
১৯৫০ সালে ঢাকা প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯৬৪ সালে তৎকালীন দৈনিক পাকিস্তানে (পরবর্তীতে দৈনিক বাংলা) যোগ দেন। এই পত্রিকাটির সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে তিনি কিংবদন্তিতুল্য খ্যাতি অর্জন করেন।
কবি আহসান হাবীবের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘রাত্রিশেষ’ প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালে কলকাতার কমরেড পাবলিশার্স থেকে, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ। বইটির প্রচ্ছদ করেছিলের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন। এছাড়াও প্রকাশিত কবিতার বইগুলোর মধ্যে রয়েছে-- ছায়াহরিণ, সারাদুপুর, আশায় বসতি, মেঘ বলে চৈত্রে যাব, দুহাতে দুই আদিম পাথর, বিদীর্ণ দর্পণে মুখ ইত্যাদি। আরও লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। অনুবাদ করেছেন ছোটদের ও বড়দের জন্য।
ছোটদের জন্য ছড়া-কবিতা লিখেছেন প্রচুর। ছোটদের জন্য লেখা তার বইগুলো হল-- ‘ছুটির দিনদুপুরে’, ‘রেলগাড়ি ঝমাঝম’, ‘রাণীখালের সাঁকো’ এবং ‘পাখিরা ফিরে আসে’।
বাংলা সাহিত্যে কবি আহসান হাবীবের অবদান চিরদিন অমর-অক্ষয় থাকবে প্রত্যাশা করি। তিনি স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। খ্যাতিমান এই কবির মৃত্যুদিবসে গভীর শ্রদ্ধা।