ছুটির দিনগুলোতে বিদেশের পার্কে দেখা যায় উৎসাহী পাখি-প্রেমিকদের ভিড়। শুধু বিদেশে কেন? আমাদের দেশে যখন শীতকালীন অতিথি পাখি আসে, তখন চিড়িয়াখানার দর্শনার্থীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে লেকের দিকে। মানুষ উৎসাহ নিয়ে দেখে এসব উড়ন্ত অতিথিদের। যাদের পাখনার ছন্দে, কণ্ঠের ছন্দোময় গানে গানে মুখরিত আমাদের চিড়িয়াখানা, আমাদের বনবনানি, হাওর-বাঁওড়, নদীনালা, বিল আর চরাঞ্চল।
পাখির প্রতি মানুষের আকর্ষণ হাজার বছর আগের। প্রাচীন মিশরের রহস্যময় পিরামিডের দেয়ালে-দেয়ালে পাখি, মোগল চিত্রকলার বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে পাখি, ‘পঞ্চতন্ত্র’-এ রয়েছে অসংখ্য পাখির বর্ণনা-- যে বইটি লেখা হয়েছে যিশু খ্রিস্টের জন্মের দুশ’ বছর আগে।
মানুষের প্রত্যেকটি সৃজনশীল সৃষ্টিই উঠে এসেছে শখ থেকে। স্বাভাবিকভাবেই মানুষের পাখি দেখার শখ ধীরে ধীরে পাখিপর্যবেক্ষণে রূপ নেয়। আর এই পাখিপর্যবেক্ষণের প্রথম ধাপ হল যে কোনো অঞ্চলের সাধারণ পাখিকে ঠিকমতো চিনতে পারা। অক্ষর পরিচয় ছাড়া যেমন জ্ঞানার্জন সম্ভব নয়, তেমনি পাখি চিনতে না পারলে পাখি দেখার শখ দৃষ্টি-নন্দনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যাবে।
যে তিনটি প্রয়োজনীয় জিনিসের কথা উল্লেখ করলাম, পাঠক এবং পাখি-প্রেমিকদের সুবিধার জন্য প্রথম দুটি জিনিস সম্পর্কে একটু তথ্য দিয়ে রাখি। ৮ x ৩০ অথবা ৭ x ৫০ মাপের বাইনোকুলারই পাখি দেখবার জন্য সবচেয়ে উপযোগী। যন্ত্রটি এমন হওয়া দরকার, যাতে পাখির শরীরের খুঁটিনাটি সবকিছু যথেষ্ট বড় আকারে দেখা যায়। আশপাশে যেসব পাখি চোখে পড়ে সেগুলোকে চেনার জন্য একটি ভালো বইয়ের প্রয়োজন। হুইসলারের ‘পপুলার হ্যান্ডসবুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস’ এবং সালিম আলীর ‘দ্য বুক অভ ইন্ডিয়ান বার্ডস’ বই দুটি এই কাজে বিশেষ উপযোগী। বাংলায় অনুবাদ করা সালিম আলীর ‘সাধারণ পাখি’ বইটি এ ব্যাপারে সবার বিশেষ কাজে লাগতে পারে। সালিম আলীর বইয়ে পাখিদের আকৃতি, বর্ণনা ও বিশেষ বিশেষ লক্ষণীয় বস্তুর ছবি এঁকে তালিকা প্রস্তুত করে দেওয়া হয়েছে। এতে পাখি চেনা বেশ সহজতর হবে। পাখি চেনার জন্য আরও বেশ কয়েকটি বই পাওয়া যায় বাজারে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে অজয় হোমের ‘বাংলার পাখি’ ও ‘চেনা-অচেনা পাখি’।
হাজারও পাখির হাজারও স্বভাব। এক-একটি পাখির আচরণ এক-এক রকম। যেমন-কোনো পাখি ডিম পাড়ে গাছে। আবার কোনোটি মাটিতে। কোনো পাখি বছরের কিছু সময় কাটায় গাছের ডালে ডালে, আবার বিশেষ-বিশেষ সময়ে বাসায় ঘুমিয়ে কাটায়। এমন পাখিও দেখা যায়, যারা সারাটি বছর কাটায় গাছের ডালে বা আকাশে উড়ন্ত অবস্থায়। কেবল ডিম পাড়ার সময় নেমে আসে ঘাসে। কোনো কোনো পাখি মাটিতে হাঁটে বেশ সাবলীলভাবে, কোনো পাখি হাঁটে লাফিয়ে লাফিয়ে। এক-একটি পাখির ওড়ার ভঙ্গিও এক-এক রকম। খাবারের রুচিও আলাদা আলাদা।
কোন্ পাখিকে কোথায় দেখা গেল, মাটির উপরে না ঘন পাতার ফাঁকে, গাছের গুঁড়ির উপর না জলের কাছে এবং সেই সময় পাখিটি কেমন করছিল বা কোন্ ধরনের নড়াচড়া করছিল-- এসব ভালো করে নজর দেওয়া উচিত। পাখিকে ঠিকমতো চেনার জন্য এটি একটি বড় সুবিধা।
মানুষের মধ্যেও যেমন এক পরিবারভুক্ত লোকদের অনেক সময় দেখলেই চেনা যায়, ঠিক সে রকমই একেবারে অজানা পাখিরও কিছু কিছু ধরন-ধারণ আর অভ্যাস দেখে অনায়াসেই বলে দেওয়া যায় সে কোন্ গোষ্ঠীভুক্ত। ইগ্রেট গোষ্ঠীর পাখিরা পেছন দিকে ঘাড় হেলিয়ে ওড়ে। মাছরাঙা পাখির ঠোঁট, বাজপাখির মাথা ও ঠোঁট সব এমন এক-একটি সুস্পষ্ট চিহ্ন। এই ধরনের বৈশিষ্ট্য যেসব পাখির মধ্যে দেখা যাবে তাদের সঠিক প্রজাতিটির নাম না জানলেও, সে কোন্ গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত তা বলে দেওয়া কিছুমাত্র কঠিন হবে না। তবে এর জন্য প্রয়োজন দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও অভিজ্ঞতা। কোনো একটি পাখির বাসা যদি ভালো করে দেখার সুযোগ এসে যায়, তাহলে সেই পাখিটি সম্বন্ধে প্রচুর জ্ঞান লাভ করা সম্ভব।
এখানে একটি কথা বলে রাখা প্রয়োজন, পাখির ডিম বা বাচ্চাকে হাত দিয়ে নাড়াচাড়া করা উচিত নয়। আহত পাখিকে শুশ্রূষা করতে হলে খুব যত্নের সঙ্গে ঠিকভাবে পাখিটিকে নাড়াচাড়া করতে হবে। কোনো কোনো পাখি এতই ক্ষীণজীবী যে, বুকের উপর সামান্য চাপ পড়লেই মারা যেতে পারে। কোনো পাখিকে ভালো করে পরীক্ষা করে দেখতে হলে তাকে হাতের তালুর উপর উল্টিয়ে শুইয়ে রাখলে সুবিধে হয়। কারণ, উল্টিয়ে রাখলে পাখিরা একদম নড়াচড়া করতে পারে না। নড়াচড়া করার চেষ্টাও করে না।
পাখিদের উপর যে কেউ হুট করে কিছু আবিষ্কার করে ফেলতে পারে না। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে পাখি দেখতে দেখতে পাখিদের সঙ্গে সত্যিই একটা যেন ঘনিষ্ঠ প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। পাখি দেখার শখ যাদের আছে, তারা যে কোনো সময়, যে কোনো অবস্থায় পাখিচর্চার মাধ্যমে প্রচুর আনন্দ লাভ করতে পারে। যেভাবে মানুষ হাজার-হাজার বছর ধরে করে আসছে। আর এ আনন্দ মানুষের জ্ঞানের পরিধিকে সুপরিসরও করবে।
এই সঙ্গে এই কথাটিও বলে রাখা ভালো যে, একটা তথ্যে দেখা গেছে, এ পর্যন্ত পৃথিবীতে যাঁরা প্রাথমিকভাবে পাখি দেখাকে শখ হিসেবে নিয়েছেন, তাঁদের অনেকেই পরবর্তী সময়ে পাখিবিশারদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।