অতন্দ্রিলা পরি হয়ে গেল

দারুণ আনন্দ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল অতন্দ্রিলা। আজ সারাদিন ওর মন ভালো ছিল।

>> শাহনেওয়াজ চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2014, 10:41 AM
Updated : 8 July 2014, 10:41 AM

আগামীকাল অতিন্দ্রিলার জন্য খুবই আনন্দের দিন। কাল ওর জন্মদিন। অতন্দ্রিলার স্কুলের আর ওদের আশপাশের বাসার বন্ধুদের দাওয়াত দেওয়া হয়ে গেছে। কেউ বাদ পড়েনি। গুনে গুনে সবইকে দাওয়াত দেওয়া হয়েছে। আরও আছে অতন্দ্রিলার খালাতো, চাচাতো, মামাতো ভাইবোনেরা। তবে ওর জন্য সবচেয়ে আনন্দের ব্যাপার, নীরু ম্যাডাম আসছেন ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে।

নীরু ম্যাডামের আসার পেছনে একটা চমৎকার কারণ রয়েছে।

নীরু ম্যাডাম অতন্দ্রিলার ক্লাস টিচার। আম্মু গিয়েছিলেন অতন্দ্রিলার জন্য এক দিনের ছুটি চাইতে। জন্মদিনের আনন্দ মাটি করে নিশ্চয় স্কুলে যেতে ভালো লাগবে না ওর।-- একথা ভেবেই আম্মু ওর স্কুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু মজার ব্যাপার হল, ছুটির কারণ জানতে পেরে নীরু ম্যাডাম ওদের বাসার ঠিকানা রেখে দিলেন। বললেন, “আমিও আসব অতন্দ্রিলার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে।”

এ খবর পেয়ে অতন্দ্রিলার আনন্দ যেন ধরে না! আবার সন্দেহ জাগে, সত্যি কি নীরু ম্যাডাম ওর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আসবেন! আম্মুর কথা মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না অতন্দ্রিলার।

আব্বু-আম্মু ভীষণ ব্যস্ত। দুদিন আগে থেকে এটাসেটা কত কী আয়োজন! বড়সড় একটা কেকের অর্ডার দেওয়া হয়েছে।

আম্মু বললেন, “রাতে কাউকে না খাইয়ে ছাড়া যাবে না।”

সব মিলিয়ে দারুণ আনন্দ হবে।-- এসব ভাবতে ভাবতে ঘুমাতে গেল অতন্দ্রিলা।

আম্মু বললেন, “তাড়াতাড়ি ঘুমাতে যাও। সকাল সকাল ঘুম থেকে জাগতে হবে। জন্মদিনের সকালে দেরিতে ঘুম থেকে উঠতে নেই।”

লক্ষ্মীমেয়ের মতো ঘুমিয়ে পড়ল অতন্দ্রিলা। সকাল সকাল ঘুম ভাঙল ওর।        

ঘুম ভাঙলেও একটুক্ষণ চোখ বুজে বিছানায় থাকার অভ্যেস অতন্দ্রিলার। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। কিন্তু আজ বেশিক্ষণ বিছানায় থাকতে পারল না। ঘুম ভাঙতেই ফুলের মিষ্টি গন্ধ ভেসে এল নাকে। বুক ভরে গন্ধ নিল অতন্দ্রিলা। এমন মিষ্টি গন্ধ কী ফুলের হতে পারে?

চোখ মেলে তাকাতেই অবাক হল অতন্দ্রিলা। এত এত ফুল ওর ঘরে কোত্থেকে এল? অবাক দৃষ্টিতে পুরো ঘরটাতে দৃষ্টি বুলাল। দেখল নানান রঙের ফুল ছড়িয়ে আছে সারাঘরে। নীল, হলুদ, বেগুনি, সাদা রঙের ফুলে ঘরটা রঙিন হয়ে উঠেছে। ফুলগুলো যেন ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে!

একেক করে ফুলগুলোতে দৃষ্টি বুলোয় অতন্দ্রিলা। একটি ফুলও চিনতে পারছে না ও। সবগুলো অচেনা ফুল। অবাক ব্যাপার। ঘরময় শুধু ফুলের ছড়াছড়ি! মেঝেতে ফুল, শিথানের কাছে ফুল।

বিছানা ছেড়ে মেঝেয় পা রাখল অতন্দ্রিলা। ফুল সরিয়ে সরিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। ঘর থেকে বেরিয়ে উচ্চস্বরে আম্মুকে ডাকল অতন্দ্রিলা।

রান্নাঘর থেকে সাড়া দিলেন আম্মু।

অতন্দ্রিলা বলল, “আম্মু একবার আমার ঘরে এসো না।”

আম্মু ব্যস্ততার কথা বললেন।

কিন্তু অতন্দ্রিলা নাছোড়। রহস্যভরে বলল, “আম্মু দেখে যাও না কী অবাক কাণ্ড ঘটেছে!”

অতন্দ্রিলার কাছে এসে আম্মু বললেন, “সকাল সকাল তোমার কী হল বলো তো! নাস্তা তৈরি করতে হবে। তোমার আব্বু এখনই বেরোবেন।”

আম্মুর হাত ধরে নিজের ঘরে এল অতন্দ্রিলা। “এসো আম্মু, তোমাকে অবাক করে দেব।”

আম্মুও অবাক হলেন। চমকিত কণ্ঠে বললেন, “তোমার ঘর তো দেখছি ফুলের বাগান হয়ে গেছে! কীভাবে এমন হল?”

“আমিও তাই ভাবছি।” অতন্দ্রিলা বলল।

কিন্তু এমন অবাক কাণ্ডের কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না।

নাস্তা সেরে অতন্দ্রিলা আবার নিজের ঘরের দিকে এল। দরজার কাছে আসতেই থমকে দাঁড়াল। দেখল, ঘরময় ফুলের উপর একটা নীলপরি উড়ে বেড়াচ্ছে। অতন্দ্রিলা অবাক হবার চেয়ে মুগ্ধ হল বেশি। এত সুন্দর একটা পরি উড়ে বেড়াচ্ছে ওর ঘরে! অতন্দ্রিলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে দেখল।

পরিটি একসময় অতন্দ্রিলাকে দেখতে পেল। ওড়া বন্ধ করে ওর সামনে এসে থামল।

অতন্দ্রিলা কোনো কথা বলে না। পরির দিকে তাকিয়ে থাকল।

নীলপরি বলল, “অবাক হয়েছ?”

‘না’ সূচক মাথা নাড়াল অতন্দ্রিলা। সে অবাক হয়নি।

সুন্দর করে হাসল নীলপরি। হাসির শব্দটা যেন নদীর কুলকুল ধ্বনির মতো শোনাল। হেসে বলল, “এত ফুল তোমার জন্য তুলে এনেছি। তোমার জন্মদিনে আমার উপহার। আমি জানি, তুমি ফুল পছন্দ করো।”

অতন্দ্রিলা বলল, “তোমাকে তো আর কখনও দেখিনি।”

নীলপরি বলল, “আমি রোজ তোমার ঘরের জানালার কাছের শেফালি গাছ থেকে ফুল তুলতে আসি। তোমার পড়ার টেবিলে আমিই ফুল রেখে যাই।”

নীলপরির কথা শুনে ভালো লাগল অতন্দ্রিলার। পরিকে নিয়ে খাটে বসল ও। তারপর জিজ্ঞেস করল, “তুমি কোথায় থাক?”

“পরির দেশে।”

“সেখানে তোমার কে কে আছে?”

“বাবা-মা, ভাইবোন।”

“তোমাদের দেশটা খুব সুন্দর, তাই না?”

“হ্যাঁ, খু-উ-ব সুন্দর! আকাশ, ঘরবাড়ি, বনবাদার সবকিছু সুন্দর। আকাশের রং সকাল বেলা বেগুনি, রাতের বেলা গোলাপি। আর বাতাসে ভেসে বেড়ায় ফুলের গন্ধ।”

একটু থেমে নীলপরি বলল, “তুমি যাবে পরির দেশে?”

অতন্দ্রিলা এককথায় রাজি হয়ে গেল, “হ্যাঁ, যাব। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে?”

“নিয়ে যাব।”

“কিন্তু কীভাবে যাব?”

“কেন?”

“তুমি তো তোমার সুন্দর ডানা মেলে উড়ে যাও। আমার তো ডানা নেই।”

“আমি তোমাকে ডানা এনে দেব। তাহলে তুমিও উড়তে পারবে।”

নীলপরির কথায় অতন্দ্রিলা খুব খুশি হল। পরিকে বলল, “আজ সন্ধ্যায় আবার এসো তুমি। কেক কাটা হবে। গান হবে। অনেক মেহমান আসবে। তুমি আসবে না?”

“সন্ধ্যায় যে আমাকে পাঠশালায় যেতে হবে।”

ফিক করে হেসে ফেলে অতন্দ্রিলা, “তুমি তো দেখছি বোকা পরি। সন্ধ্যায় কেউ পাঠশালায় যায়?”

“আমরা যাই। তোমাদের যেমন সকালে স্কুলে যেতে হয়, আমাদের যেতে হয় সন্ধ্যায়।” নীলপরি বলল।

“ও আচ্ছা। ঠিক আছে, তাহলে তোমাকে কিছু খেতে দেই? ফ্রিজে মিষ্টি আছে। এনে দেব?”

“না, মিষ্টি খাব না।”

“তাহলে কী খাবে?”

“কিছুই খাব না।”

“তাহলে আমি রাগ করব।” অতন্দ্রিলা বলল।

নীলপরি অতন্দ্রিলার হাত ছুঁয়ে বলল, “রাগ করো না। আমাকে এখন যেতে হবে। আরেকদিন এসে খাব।”

একটুক্ষণ পর নীলপরি চলে গেল।

বিকেল থেকে একে একে অতন্দ্রিলার বন্ধুরা আসতে থাকল। সবাই নানান রকম উপহার নিয়ে এল ওর জন্য।

নীরু ম্যাডাম এলেন সন্ধ্যাবেলা। উপহার হিসেবে অনেকগুলো বই আর ফুল নিয়ে এসেছেন তিনি।

নীরু ম্যাডাম সত্যি আসবেন, ভাবতে পারেনি অতন্দ্রিলা। ওর বারবার মনে হচ্ছিল, জরুরি কাজে আটকে পড়ে আসতে পারবেন না ম্যাডাম। কিন্তু না, এমন হল না।

দারুণ আনন্দ হল। সবাই মিলে খুব মজা করল ওরা। স্কুলে সবাই ম্যাডামকে ভয় পেলেও, আজ ভয় কোথায় পালাল! নিরু ম্যাডামও ওদের সঙ্গে আনন্দ করলেন।

কেক কাটা হল। চানাচুর… মিষ্টি… আরও কত কী! তারপর একসঙ্গে বসে রাতের খাবার সেরে বাড়ি ফিরল সবাই। এত হৈচৈ, আনন্দের মাঝেও নীলপরির কথা ভুলে যায়নি অতন্দ্রিলা। পরির জন্য ও কেক-মিষ্টি তুলে রাখল। পরি এলে খেতে দেবে।

তারপর থেকে প্রতিদিন নীলপরি আসে অতন্দ্রিলার কাছে। কত রকম গল্প শোনায় ওকে! একসময় চলে যায়। কখনও অনেক রাতে আসে, কখনও-বা খুব ভোরে এসে অতন্দ্রিলার ঘুম ভাঙিয়ে যায় নীলপরি। ওর জন্য বাগান থেকে ফুল তুলে আনে।

নীলপরির সঙ্গে আব্বু-আম্মুকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে অতন্দ্রিলা। তারাও  নীলপরিকে আদর করেন। আব্বু ওদের দুজনের জন্যই চকলেট কিনে আনেন।

এভাবে চলছিল। হঠাৎ নীলপরি কোথায় নিরুদ্দেশ হল! বেশ কদিন তার দেখা নেই। একদিন, দুদিন, তিনদিন...

অতন্দ্রিলা অপেক্ষায় থাকে, নীলপরি আসে না।

অতন্দ্রিলা ভাবে, নীলপরির কি অসুখ করল? ওর ইচ্ছে করে নীলপরির কাছে যেতে। কিন্তু নীলপরির ঠিকানা তো জানা নেই। পরি ওকে নিয়ে যাবে বলেছিল, তাও নিয়ে গেল না। ভীষণ কষ্ট হয় অতন্দ্রিলার। স্কুলে যেতে ভালো লাগে না, খেতে-ঘুমাতে-খেলতে ভালো লাগে না।

অতন্দ্রিলা ভাবে, যে করেই হোক নীলপরিকে খুঁজে আনবে।

একদিন সকালে অতন্দ্রিলার ঘুম ভাঙাতে এসে ওর আম্মু ওকে বিছানায় পেলেন না। ওর বিছানায় কিছু নীল রঙের পালক পড়ে থাকতে দেখলেন।

কোথায় গেল অতন্দ্রিলা? অনেক খুঁজেও কোথাও পাওয়া গেল না ওকে। অতন্দ্রিলার কোনো বন্ধুর বাড়িতেও না।