বিনাটিকিটে ব্রাজিল

ঘুমকাতুরে রাসেল। দিনের অধিকাংশ সময় কাটে ঘুমের ঘোরে। ক্লাসে দেরিতে যাওয়া আর শেষ বেঞ্চে বসে বন্ধুদের সঙ্গে দুষ্টুমিতে মেতে ওঠাটাই নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।

>> এমরুল হোসাইনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 July 2014, 12:44 PM
Updated : 8 July 2014, 06:39 AM

যদি কখনও সময় মতো চলে আসে বন্ধু-বান্ধবরা ‍আঁড় চোখে তাকিয়ে থাকে। এতে তার কিছু যায়-আসে না। তার স্বাভাবিকতায় বিন্দুমাত্রও ছেঁদ পড়ে না।

যে ‍যাই বলুক না কেন সে তার মতো। ক্লাসের অধিকাংশ ছেলেমেয়েই খুব ভালোবাসে।

ইদানিং তার চোখ থেকে ঘুম যেন পালিয়ে গেছে, বিশেষ করে রাতের ঘুম, মনে হয় বিশ্বকাপ দেখতে গেছে। সারাবিশ্বের কোটি ভক্তরা যখন বিশ্বকাপের একটি টিকিটের জন্য হা-পিত্যেশ করছে তখন কিনা ঘুম মহাশয় বিনাটিকিটেই চলে গেছে ব্রাজিল! যতই চেষ্টা করুক না কেন কিছুতেই ঘুম আসে না। দিনের বেলা এলেও এক মুহূর্তের জন্য। আর আসবেই-বা কেমন করে সময়টা যে বিশ্বকাপের!

উত্তেজনায় সারাবিশ্ব যখন কম্পমান তখন ঘুমের কী সাধ্যি তার মতো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তাগড়া এক যুবককে কাতর করে!

সারাদিন যাই করুক না কেন রাতে তার টিএসসির নির্ধারিত সীমানার বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে কারফিউ জারি করেছে মন প্রশাসন। স্থির হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে খেলা দেখাটাই রুটিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আজও এর ব্যতিক্রম হয়নি। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে নির্ধারিত সময়ের অনেক আগেই কপালে প্রিয় দলের পতাকা বেঁধে বিশ্বকাপের মিছিল করতে করতে হল থেকে চলে এসেছে টিএসসিতে বড় পর্দায় খেলা দেখার জন্য। আগে না আসলে যে সামনের সারিতে জায়গা পাওয়া যাবে না। দূর থেকে খেলা দেখে কি তৃপ্তি হয়? তাছাড়া আজ থেকে কোয়ার্টার ফাইনাল শুরু হচ্ছে জার্মানি-ফ্রান্স ম্যাচ দিয়ে। রাত দশটায় প্রথম ম্যাচ, শক্তিশালি জার্মানির সামনে অগ্নি পরীক্ষা দিতে হবে ফ্রান্সকে। রয়েছে বিশ্বযুদ্ধের স্মৃতি, রয়েছে পুরনো নানান হিসেব-নিকেশ। বাঁচা-মরার লড়াইয়ের জন্য সবাই প্রস্তুত। প্রস্তুত ফিলিপ লাম, পোডলস্কি, মুলাররা। প্রস্তত করিম বেনজেমা, পগবা, লরিসরাও।

রাসেল, মিঠু, রতন, তুহিন, কামালসহ আরও অনেকেই এসেছে টিএসসিতে বড় পর্দায় খেলা দেখতে। আজ সবার মূল আকর্ষণ কোয়ার্টার ফাইনালের প্রতিটি ম্যাচের দিকেই। প্রথম ম্যাচ শুরু রাত দশটায়, ফ্রান্স বনাম জার্মানি; আর দ্বিতীয় ম্যাচ শুরু রাত দুইটায়, ব্রাজিল বনাম কলম্বিয়া। ব্রাজিলের সমর্থক বেশি হলেও জার্মানির সমর্থকও নেহাত কম নয়। তবে আজকের দুটি ম্যাচের মধ্যে ‍প্রথমটি নিয়েই সবার বেশি আগ্রহ। কারণ, একে বাঘ-সিংহের লড়াই বললেও যে কম বলা হবে!

পরিসংখ্যান বলছে দুদলের ২৫ বারের মুখোমুখি লড়াইয়ে ফ্রান্স জয়লাভ করেছে ১১ বার, জার্মানি ৮ বার আর বাকি ৬ ম্যাচ ড্র। কিন্তু বিশ্বকাপে কেউ কারও চেয়ে কম না, একেবারে সমানে সমান; একবার ফ্রান্স, একবার জার্মানি,‍ আর একবার ফলাফল অমীমাংসিত। শুধু পরিসংখ্যানই নয় সাম্প্রতিক পারফরম্যান্সের বিচারেও কেউ কারও চেয়ে কম নয়! ‍তাই সবাই অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে বাঘের হুঙ্কার আর সিংহের গর্জন শোনার জন্য। এই ম্যাচ নিয়ে আগ্রহের আরও কারণ হচ্ছে মিরোস্লাভ ক্লোসার এককভাবে বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ গোল করার রেকর্ডের হাতছানি, সেই সঙ্গে থমাস মুলারের গোল্ডেন বুট জয়ের মিশনে টিকে থাকা।

টিএসসিতে রাসেলরা বসে বসে বাদাম চিবুচ্ছে। ‍ওদের মধ্যেও দুটো দল হয়ে গেছে। একদল জার্মানিকে আর এক দল ফ্রান্সকে সাপোর্ট করছে। এ নিয়ে চলছে বাগ-বিতণ্ডাও। দেখতে দেখতে অপেক্ষার পালা শেষে শুরু হয়ে গেল সেই কাঙ্ক্ষিত লড়াই।

সবাই এক দৃষ্টিতে খেলা দেখছে। শুরু থেকেই সবার মাঝে টানটান উত্তেজনা। দর্শকদের সেই উত্তেজনাকে বাড়িয়ে দিতেই যেন মাত্র তের মিনিটের মাথায় ম্যাট হামেলসের অসাধারণ এক হেডে বল চোখের পলকে লরিসকে ফাঁকি দিয়ে ঢুকে গেল ফ্রান্সের জালে। আর অমনি টিএসসিকে প্রকম্পিত করে জার্মান সমর্থকরা চিৎকার করে উঠল, ‘গোল! গোল!’ বলে।

রাসেল একদিকে গোল উৎসবে মেতে উঠল অন্যদিকে মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিল তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হবে ভেবে। কারণ তাড়াতাড়ি খেলা শেষ হলেই তো অনন্তপক্ষে ঘণ্টাদুয়েক ঘুমিয়ে নেওয়া যাবে, তাই না?

এরপর জার্মানি কিছুটা ধীরে-সুস্থে দেখে দেখে খেলতে লাগল। মাঝেমধ্যে ফ্রান্সের দুর্দান্ত আক্রমণ ঠেকিয়ে দেওয়ার জন্য ফাউল করে সতর্ককরণ কার্ডও দেখল।

দেখতে দেখতে হাফ টাইম শেষ কিন্তু ফ্রান্স গোল পরিশোধ করতে পারল না। কী আর করা! কিছুটা সময় জিরিয়ে নেওয়া যাক, তারপর আবার শুরু করা যাবে নতুন উদ্যমে!

বিরতির পর খেলা শুরু হল। ফ্রান্স মাঝেমধ্যে আক্রমণে যাচ্ছে; কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। উল্টো জার্মান রক্ষণভাগের কাছে নাকানি-চুবানি খেতে হচ্ছে। দেখতে দেখতে নির্ধারিত সময়ের খেলাও শেষ হল। কিন্তু বারবার সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে পারল না একটি বারও। তবে ভেলভিউয়েনা কিন্তু দুর্দান্ত খেলেছে একথা জার্মান সমর্থকরাও অকপটে স্বীকার করবে।

অতিরিক্ত সময়ের খেলা চলছে, শেষ মিনিটে করিম বেনজামা অসাধারণ এক কিক করল। কিন্তু জার্মান গোলরক্ষক তা জাদুর হাতে রুখে দিয়ে ফ্রান্স সমর্থকদের হতশাটাকে স্থায়ী করে দিল। ফলাফল ফরাসিদের লড়াকু হার।

২.

রাসেল ভাবল, ব্রাজিল-কলাম্বিয়ার ম্যাচ শুরু হতে এখনও ঘণ্টাদুই বাকি, কাছেই হল, কিছুটা সময় ঘুমিয়ে নিলে মন্দ হয় না। কিন্তু হলে গিয়ে অনেক চেষ্টা করেও ঘুমকে ব্রাজিল মাঠ থেকে ফিরিয়ে আনতে পারল না। বিনাটিকিটে ব্রাজিলের মাঠে গিয়ে আর কি কেউ খেলা না দেখে ফিরে আসে? দেখতে দেখেতে দেড় ঘণ্টা কেটে গেল। কিন্তু ঘুম কাতুরে রাসেল কিছুতেই ঘুমকে ফিরিয়ে আনতে পারল না। উত্তেজনা ধরে রাখতে না পেরে আবারও চলে এল টিএসসিতে।

খেলা শুরু হয়ে গেছে। সবার মধ্যে উত্তেজনা। ব্রাজিল সমর্থকদের করতালিতে আকাশ-বাতাস কেঁপে ‍উঠছে। নেইমার দিব্বি ছুটে চলেছে মাঠের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত।

এ কী! খেলা শুরু হতে না হতেই যে প্রথম গোলটি করে দলের চাপকে হালকা করে দিল অধিনায়ক টি সিলভা নিজেই! যে যাই বলুক টানটান উত্তেজনার এতটুকুও কমতি নেই ম্যাচটিতে। কী দুরন্ত গতিতেই না খেলছে হাল্ক, অস্কার, নেইমাররা।

সানচেজ, টিও, রদরিগেজরাও কম যায় না। প্রতি আক্রমণে একাধিকবার গোল দেওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করেও ফেলেছিল। কিন্তু ফিনিশিং টাচটা আর হয়ে ওঠে না।

গতিমিয় ব্রাজিলের খেলা দেখতে দেখতেই কখন যে হাফ টাইম হয়ে গেল তা যেন বুঝতেই পারল না রাসেল-তুহিনরা। বিরতির পর খেলা শুরু হয়েছে। কলাম্বিয়া যেন গেরিলার গতিতে দ্বিতীয়ার্ধের খেলায় মরিয়া হয়ে উঠেছে গোল করার জন্য।

কিন্তু ভাগ্য সহায় হচ্ছে না। উল্টো ডি-বক্সের বাইরে ফাউল করার অপরাধে ডেভিড লুইজের করা চমকার এক ফ্রি কিক থেকে গোল খেয়ে বসল ৬৯ মিনিটের মাথায়। দ্বিতীয় গোল খেয়ে শোককে শক্তিতে পরিণত করল কলাম্বিয়া, ফলও পেল।

ফাউল করার অপরাধে ব্রাজিল গোলরক্ষকে হলুদ কার্ড দেখিয়ে দিল রেফারি। কলাম্বিয়ার রডরিগেজ ৮০ মিনিটের সময় পেয়ে গেল গোল ব্যবধান কমানোর ও ব্যক্তিগত অর্জন গোল্ডেন বুটের লড়াইয়ে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ। সে অবশ্য সুযাগের সদব্যবহারই করল।

বাকি সময়টুকুতে চলল আরও তুমুলগতিতে আক্রমণ। কিন্তু তাতে লাভ হল না। গোল ব্যবধানও কমল না, খেলার ফলাফলেও কোনো পরিবর্তন এল না। ‍অতিরিক্ত পাঁচ মিনিটের খেলাও শেষ হয়ে গেল কিন্তু আর কোনো গোল হল না। লাখো কলাম্বিয়ান ফ্যানদের দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে রেফারি ফাইনাল বাঁশি বাজিয়ে দিল।

আর রডরিগেজরা কোটি দর্শক হৃদয় জয় করে বিদায় নিল ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে। রাসেলরাও ফিরে গেল যে যার মতো, ঘুম মহাশয়ও বিনা টিকিটে ব্রাজিল স্টেডিয়াম ঘুরে ফিরে এল।