উড়ন্ত মেসি দুরন্ত মারিয়া

সারাদিন তীর্থের কাকের মতো বসে বসে প্রহর গুনছে কখন রাত দশটা বাজবে। আজ যে জাদু দেখার রাত! মেসের সবাই অপেক্ষা করছে, ভাইয়া কখন টিভি অন করবে! না হলে যে বাইরে গিয়ে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে ‍দাঁড়িয়ে খেলা দেখতে হবে। পুরো মেসে একটিমাত্র টিভি, তাও আবার ভাইয়ার রুমে। ভাইয়া সবসময় সব খেলা দেখে না। প্রিয় দলের খেলা হলে অবশ্য ভিন্ন কথা। আজকে সবার মাঝে আশার আলো, ভাইয়ার রুমে বসে আয়েস করে খেলা দেখার ব্যাপারে আজকে অনেকেই বেশ দৃঢ় চিত্ত!

>> এমরুল হোসাইনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2014, 03:08 PM
Updated : 2 July 2014, 03:08 PM

কারও কারও মনে শঙ্কাও কাজ করছে। তবে আশার প্রদীপ সবার মনেই টিমটিম করে জ্বলছে। ভাইয়া যে আর্জেন্টিনার কড়া সমর্থক। খেলা শুরু হবে হবে ভাব।

ভাইয়ার রুমের আশপাশ দিয়ে শুরু হয়ে গেছে অনেকেরই ঘুরাঘুরি। কিন্তু ভাইয়া যে দরজা খুলছে না। তবে কি আজ খেলা দেখা হবে না? নাকি প্রিয় দলের খেলা দেখতে হবে দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে?

ভাইয়া ইন্টারনেটে ব্রাউজ করছিল। কখন যে সময় হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। হঠাৎ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চমকে উঠল। এ কী! দশটা যে পার হয়ে গেছে!

দ্রুত কম্পিউটার অফ করে টিভি অন করল। এহহে! দশ মিনিটতো পার হয়ে গেছে! তাড়াতাড়ি দরজা খুলে টিভির সামনে বসে পড়ল ভাইয়া। খেলা যে মেসি, ডি মারিয়াদের। প্রতিপক্ষ ইউরোপের ক্রীড়াভূমি, সুইজারল্যান্ড। ওদেরও কম তারকা নেই, আছে রডরিগেজ, শাকিরির মতো আরও অনেকে।

দরজা খুলতে দেখে একজন জিজ্ঞেস করল, ভাইয়া খেলা দেখবেন না। ভাইয়া বিদ্যুৎগতিতে জবাব দেয়, “অবশ্যই! আসো।”

মুহূর্তেই একে একে আট-দশজন ঢোকে পড়ল ভাইয়ার রুমে। সবাই নড়েচড়ে বসে যায় খেলা দেখার জন্য।

খেলা চলছে। সবাই এক ধ্যানে খেলা দেখছে। দুদলই কী চমৎকার খেলছে! তবে আর্জেন্টিনাই অধিকাংশ সময় বল দখলে রেখেছে। ওরাও কম চেষ্টা করছে না। সবাই যেন আজকে মরিয়া হয়ে খেলছে। আর খেলবেই-বা না কেন? আজ যে নকআউট পর্বের খেলা চলছে! তাই তো এক দল যদি আক্রমণে যায় মুহূর্তেই প্রতিপক্ষের সবাই এসে জড়ো হয় ডি-বক্সের মধ্যে। সেই দুর্গ ভেদ করে গোল করাটা আর সম্ভব হয়ে ওঠে না। চলে পাল্টা আক্রমণ। সবার ‍মাঝে টানটান উত্তেজনা, সেই সঙ্গে উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও। আজকে মনে হচ্ছে মেসিরা নতুন মন্ত্র নিয়ে মাঠে নেমেছে, বিশ্বকে অবাক করে দেওয়ার মিশনে।

কী চমৎকার! মেসি যদিও খুব একটা‍ সুবিধা করতে পারছে না কিন্তু মাঠজুড়ে ডি মারিয়ার দাপট দেখে সবাই আশায় বুক বাঁধছে, এই বুঝি গোল হয় ‍হয়। মেসি পারবে কেমন করে? সবার নজর যে মেসির দিকেই! মেসির পায়ে যদি একবার বল আসে, সঙ্গেই সঙ্গেই তিন-চারজন এসে জড়ো হয় তাকে রুখতে।

ফুটবলের ‍জাদুকরও কম যায় না। মাঝেমধ্যে ওদের চোখে সরষে ফুল দেখিয়ে দেয়।

আক্রমণ চলে। মাঝেমধ্যে পাল্টা আক্রমণও। যখন সুইজারল্যান্ডের কোনো খেলোয়াড় বল নিয়ে চিতার ক্ষিপ্রতায় আক্রমণে যায় তখন সবাই আঁতকে ওঠে অজানা শঙ্কায়, যদি গোল হয়ে যায়! সঙ্গে সঙ্গেই রোজো, ফার্নান্দেজরা এসে ডিফেন্স করে। ছেলেরা হাফ ছেড়ে বাঁচে। কিন্তু মেসিরা গোল না পাওয়ায় কারও মধ্যে স্বস্তি নেই।

নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হয়ে অতিরিক্ত সময়ের খেলা চলছে। মেসি আজকে যেন পণ করে নেমেছে গোল না হওয়া পর্যন্ত মাঠ ছাড়ছে না! অতিরিক্ত সময়ের খেলাও প্রায় শেষ হয় হয় কিন্তু কোনো গোল হচ্ছে না। সবার কপালেই ঘন ভাঁজ পড়েছে, খেলা কি তবে টাইব্রেকারে গড়াচ্ছে? নাহ! তা যেন ‍না হয়, মনে মনে প্রার্থনা করতে থাকে সবাই।

ইতোমধ্যে রেফারি বেশ কয়েকবার হলুদ কার্ড দেখিয়ে সতর্কও করে দিয়েছে উভয় দলের একাধিক খেলোয়াড়কে। ভাবটা এমন-- আমার সামনে কোনো ফাউল চলবে না, বুঝলে!

তবুও থামছে না। চলছে তুমুল লড়াই।

অতিরিক্ত সময়ের ২৮ মিনিটের খেলা চলছে। এমন সময় উড়ন্ত মেসির দুরন্ত জাদু দেখার সুযোগ পেল পুরো বিশ্ব, সেই সঙ্গে ডি মারিয়ারও। মেসি মন্ত্রমুগ্ধের মতো সবাইকে বশীভূত করে বল কাটিয়ে নিয়ে ডি-বক্সের মধ্যে ঢুকে গিয়ে পাস দিয়ে দিল ডি মারিয়ার উদ্দেশে।

মনে মনে হয়তো বলতে লাগল আজকে ওর পায়েই গোলটা দেওয়া উচিত। ছেলেটা কী দুরন্তগতিতেই না সারমাঠ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! সবাই যেন ওর পা থেকেই কাঙ্ক্ষিত গোলটি দেখার প্রত্যাশা করছে। ও এবার ‍আর ভুল করে না। মুহূর্তও দেরি না করে বলে বাম পায়ের জাদুকরি ছোঁয়া দিয়ে বেনালিওকে কষ্টের সাগরে ভাসিয়ে বল ঢুকিয়ে দিল জালে। সঙ্গে সঙ্গে সবাই চিৎকার করে উঠল, “গোল! গোল!”

ভাইয়াও উত্তেজনায় কম যায় না। তালিতে তালিতে ভরিয়ে তুলল সারাঘর। হঠাৎ মনে পড়ে যায় দ্বিতীয় তলায় বাবা-মা তো ঘুমোচ্ছে। জেগে গেলেই সর্বনাশ। ভাইয়া সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলতে লাগল, “চুপ! চুপ! আস্তে! আস্তে! আব্বু-আম্মু জেগে যেতে পারে।”

সবাই খুব কষ্টে উত্তেজনা সামলানোর চেষ্টা করল। খেলা এখনও শেষ হচ্ছে না কেন? অতিরিক্ত সময়ের খেলা শেষ হয়ে ‍আরও প্রায় পাঁচ মিনিট কাটে সংশয়ে, না জানি কী হয়! কিন্তু না কোনো দুর্ঘটনা ঘটেনি! এরপর সবাই জয়ের হাসি হাসতে হাসতে ভাইয়ার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যার যার রুমে চলে গেল। ভাইয়াও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছেড়ে আনন্দচিত্তে বসে পড়ল লেখালেখিতে--

“বাঘের গতি, চিতার গতি

খেলায় ছিল ছন্দ,

চোখ ধাঁধানো খেলার তোড়ে

টিপ্পনি আজ বন্ধ।”