সারাদিন যে শুধু অকাজেই ঘুরে বেড়ায় তা নয়, মাঝেমধ্যে কাজের কাজও করে, তবে বেশির ভাগ সময়ই আড্ডাবাজি আর হই-হুল্লোড় করে কেটে যায়, কখনও চায়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে টিভি দেখে, কখনও-বা পাশের দোকানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ক্যারম খেলা দেখে, আর মাঝে মাঝে স্টেশনে ঘুরে ঘুরে ব্রাশ, চিরুনি, কটন বাট, ছোট সাইজের কাঁচি, টুথপিক ইত্যাদি ফেরি করায় বাবাকে সহায়তা করে।
এতটুকু ছেলে! বড়জোর ১২। মা নেই। তার জন্মের সময় মারা গেছে মা! চাচিকে মা ডেকে মায়ের অভাব পূরণ করে। চাচি বেশ আদর করলেও নিজের ছেলেমেয়েদের সামলাতেই হিমশিম খায়, ভাসুরের ছেলেকে দেখবে কখন! তাই তো তার দস্যিপনায় খুব একটা বাঁধা আসে না।
বাবা মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে কান বরাবর কষে মারতে গিয়েও ব্যর্থ হয় মা-রূপী চাচির কারণেই। যদি কখনও বুঝতে পারে আজকে বাবা তাকে শাসন করবে লক্ষ্মীছেলের মতো ‘মা মা’ বলে চাচিকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আঁচলে মুখ গুঁজে। বাবার আর শাসন করা হয় না।
কিন্তু বাবা যখন আন্তনগর ট্রেনে মালামাল ফেরি করে বেড়ায়, তখন তার সীমাহীন স্বাধীনতায় কেউ আর বাঁধ সাধতে পারে না। চলে সকাল-সন্ধে দুরন্তপনা।
ইদানিং বিশ্বকাপ নিয়ে তার মাতামাতির শেষ নেই। হোক না রাতের বেলা, বাড়িতে টিভি নেই, তাতেই-বা কী! বাড়ির পাশেই যে রেলস্টেশন, চায়ের দোকানি মণ্টুচাচা সারারাত জেগে জেগে খেলা দেখে। এতে একদিকে তার ঘুমটা কেটে যায়, আর অন্যদিকে বিক্রিও হয় বেশ। তাছাড়া বিচ্ছু বাহিনী তো আছেই। আর কিছু না হোক ওদের তো আনন্দ দেওয়া যাবে।
বাবলুর আর আনন্দ ধরে না। আজ রাতে যে নেইমারের খেলা। কেউ যদি নেইমারের খেলার প্রশংসা করে তাহলে চায়ের দামই নিতে চায় না। কিন্তু সবাই তো আর ফ্রি ফ্রি খেতে স্বচ্ছন্দ বোধ করে না। বিশ্বকাপ উপলক্ষে বাবলুরাই ফ্রি কাস্টমারদের তালিকায় রেকর্ড সংখ্যক চা-বিস্কুট পেয়েছে।
নেইমার নাম শুনলেই বাবলুর মতো ছেলেমানুষি শুরু হয়ে যায় মণ্টুচাচার। আর হবেই-বা না কেন, এতটুকু পুঁচকে ছেলে। কী চমৎকার খেলে! মন্ত্রমুগ্ধের মতো চাচা তার খেলা দেখে।
এই তো গ্রুপপর্বের প্রথম ম্যাচে ক্রোয়েশিয়া আর শেষ ম্যাচে ক্যামেরুনের বিপক্ষে জাদুর পায়ের ছোঁয়ায় জোড়ায় জোড়ায় গোল করে বিশ্বকে একেবারে তাক লাগিয়ে দিল! দ্বিতীয় ম্যাচ অবশ্য গোলশূন্য ড্র হয়েছিল। তাতে কী, তৃতীয় ম্যাচেই নিজের যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছে আবার। ভক্তরা তার মধ্যে পেলের ছায়াই যেন দেখতে পায়!
আজ যে আবারও বিশ্ববাসী নেইমার জাদু দেখার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। শুধু কী দলকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লড়াই! মেসি-মুলারদের পাশাপাশি তারও যে আছে গ্লোন্ডেন বুট জয়ের হাতছানি। তাই তো সারাবিশ্ব তাকিয়ে আছে নেইমার কয়টা গোল করে তা দেখার জন্য। চাচা বাবলুকে আগেই বলে রেখেছে নেইমার আজকে যতগুলো গোল করবে প্রত্যেককেই ততগুলো করে কাঁচা গোল্লা খাওয়াবে। কাঁচা গোল্লা বাবলুর খুব প্রিয়। সবাই মনে মনে দোয়া করতে থাকে আজকেও যেন নেইমার জোড়া গোল করে। তাহলে আনন্দের পাশাপাশি জোড়া মিষ্টিও পাওয়া যাবে। খেলা শুরু হয়েছে। প্রতিপক্ষ চিরচেনা চিলি।
পরিসংখ্যানে তাদের থেকে অনেকটাই এগিয়ে নেইমাররা...। তবে তারাও কম শক্তিশালী দল না। তাদের দলেই যে বার্সেলোনার হয়ে নেইমার, মেসির সঙ্গে খেলা দুর্দান্ত সানচেজ রয়েছে। রয়েছে শক্তিশালী রক্ষণভাগও।
নির্ধারিত সময়ে খেলা শুরু হয়ে গেছে। টানটান উত্তেজনায় খেলা চলছে। আক্রমণ পাল্টা আক্রমণে আনন্দটা দুদলের দর্শকদের মধ্যে দেয়াল ঘড়ির পেন্ডুলামের মতো পরিবর্তিত হচ্ছে নিয়মিত। মাঝেমধ্যেই গ্যালারিতে লাল হলুদের ডিসপ্লে দেখে বাবলুরাও উজ্জীবিত হচ্ছে।
চাচা নেইমারের পায়ে বল এলেই দাঁড়িয়ে যায় উত্তেজনায়। পারলে নিজেই বলে লাথি মারে। মাঝেমধ্যে অবশ্য তার উত্তেজনাকর কিকের পরিসমাপ্তি ঘটে জালের পরিবর্তে টেবিলের পায়াতে।
টানটান উত্তেজনাকর খেলা সবাই খুব উপভোগ করছে। বল একবার অসকার, দানি আলভেস, নেইমারদের পায়ে আবার মুহূর্তেই সানচেজ, মেনা, গনজালো জারাদের পায়ে।
ফলাফলও যথার্থ হল। ১৮ মিনিটেই ডেভিড লু্ইজের শটে গোল খেয়ে বসল চিলি। আর ৩২ মিনিটের সময় অ্যালেক্সি সানচেজের চোখ ধাঁধানো গোলে সমতায় ফিরল। নেইমারকে আজকে খুব একটা জ্বলে উঠতে দেখা যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে মণ্টুচাচার বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে নেইমারকে যখন ফাউল করা হচ্ছে কিংবা পড়ে গিয়ে আহত হচ্ছে। কিন্তু রেফারি কেন হলুদ কার্ড দিচ্ছে না তা ঠিক বুঝতে পারছে না। রাগে দুটি চায়ের কাপ ভেঙে ফেলেছে।
রেফারি মনে হয় চাচার কাপ ভাঙার শব্দ শুনতে পেল। চিলির এক প্লেয়ারকে দেখিয়ে দিল একটি হলুদ কার্ড (পরে অবশ্য আরও দেখিয়েছে)। এবার চাচা যেন কিছুটা স্বস্তি পেল। দেখতে দেখতে হাফ টাইমের খেলা শেষ। ফলাফল ১-১।
বাবলুরা বিরতির সময় একটি করে বিস্কুট পেল।
শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয়ার্ধের খেলা। ব্রাজিল মুহুর্মুহু আক্রমণে চিলির দুর্গপ্রাচীর ভাঙার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে; কখনও নেইমার, কখনও হাল্ক, কখনও অসকার। চিলির রক্ষণভাগ যেন চীনের প্রাচীরকেও হার মানায়।
নির্ধারিত সময়ের খেলা শেষ হয়ে ইনজুরি টাইমের খেলাও শেষ। কোনো দলই আর গোল করতে পারল না। দুদলের একাধিক খেলোয়াড় বল নিয়ে লড়াই করতে গিয়ে সতর্ককরণ কার্ডও দেখল।
এরপর শুরু হল অতিরিক্ত ৩০ মিনিটের খেলা। দেখতে দেখতে তাও ফুরিয়ে গেল। ফলাফল অমীমাংসিতই।
শুরু হল ট্রাইব্রেকারে খেলা নিষ্পত্তির মিশন। ব্রাজিলের ডেভিড লুইজ প্রথম কিকেই বল জালে পাঠিয়ে দিল। বাবলুরা চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘গোল!’
আর ব্রাজিলের গোলরক্ষক জুলিও সিজার চিলির করা প্রথম কিকটিই দিল ঠেকিয়ে। এরপর ব্রাজিলের দ্বিতীয় কিক, এবার আর হল না! ওদিকে চিলির দ্বিতীয় কিকটিও মিস। বাবলুরা জয়ের বাঁধভাঙা আনন্দে মেতে উঠল। কিন্তু এখনও তো খেলা শেষ হয়নি! তৃতীয় প্যানাল্টিতে ব্রাজিল এবং চিলি উভয় দলই ব্যর্থ হল।
এরপর চতুর্থ প্যানাল্টির পালা। কিক নিল হাল্ক। কিন্তু দুর্ভাগ্য! সে পারল না গোল করতে। পক্ষান্তরে চিলি চতুর্থবার আর মিস করল না। বল জালে ঢুকিয়ে দিল সহজেই।
মন্টুচাচারা একটু চিন্তিত হয়ে পড়ল, ফলাফল যে ২-২! এবার এল ব্রাজিলের সেই প্রাণভোমরা। বলে কিক দেওয়ার আগে দুই পায়ে কিছুটা নৃত্য করে নিল। ভাবটা যেন এমন, দেখো কেমন করে গোল করতে হয়ে! মনে মনে হয়ত জয়ের সঙ্গে সঙ্গে আসরের পঞ্চম গোলটি করতে যাওয়ার আনন্দও কাজ করছে। গ্যালারির নারী-পুরুষ সবাই একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল প্রাণভোমরাকে দেখে। এরপর চিলির পঞ্চম প্যানাল্টির পালা। শট নিতে যাচ্ছে গনজালো জারা। সবার মনেই উত্তেজনা, কী জানি কী হয়! বেচারা একটু বেশিই সতর্কতা অবলম্বন করতে চাইল। গোলপোস্ট ছুঁই ছুঁই করে শট দিতে গিয়ে ভক্তদের বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে তৃতীয় বারের মতো হারের দৃশ্য দেখতে বাধ্য করল।
আর বাবলু ও চা দোকানি চাচারা ‘ব্রাজিল! ব্রাজিল! নেইমার! নেইমার!’ বলে চিৎকার করে উঠল। বাবলু চিৎকার করে বলে উঠল, “কী জাদু দেখাইলা!”
আর মণ্টুচাচা শুরু করে দিল ওয়াদামতো সবার মধ্যে কাঁচাগোল্লা বিতরণ।