ভ্রমর ধরার অভিযান

ইস! ধরতে পারলাম না। আঙুলে লেগেও ছুটে গেল। ওই তো, ওই কড়ই শাখের ডগায় গিয়ে বসেছে।

>> রানা ইশতিয়াকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 June 2014, 09:27 AM
Updated : 28 June 2014, 09:27 AM

খুব সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছে রবিন। ইয়া লম্বা লম্বা ঘন ছনগুলো সব এমনভাবে একদিকে কাত হয়ে আছে, যেন কুঁড়েঘরের চালা। এই ছনচালার ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে যাওয়া প্রায় অসম্ভব। পা রাখতে গেলেই শনশন্ শব্দ। ছনের নিচে অসংখ্য লজ্জাবতী কাঁটা। উপরে দাঁতইগাছ, বেতকাঁটা, তেওড়াকাঁটা, মনকাঁটা, ডেফিলাকাঁটা, লাউঘোরি গাছে জড়িয়ে আছে হাজারো লতাপাতা। এগুলো ফাঁকা করতে গেলেই নড়ে ওঠে অনেক দূর পর্যন্ত। সেই সঙ্গে নড়ে ওঠে কড়ই গাছের ডাল। উড়ে যায় ভ্রমর। ছিঁড়ে যায় রবিনের বুকের বীণা। গত কদিন ধরেই চেষ্টা করছে রবিন একটা ভ্রমর ধরার জন্য। কিন্তু পারছে না কোনোভাবেই। কত শত কাঁটার ঘা যে লেগেছে গায়ে-পায়ে, তার হিসাব নেই। ভ্রমর উড়ে গেলেই বেশি টের পায় সেসব ব্যথা।

নরম তুলতুলে শরীর। গোলাপি টানটান স্বচ্ছ চামড়ার নিচে উঁকি দিয়ে আছে টকটকে রক্তের আভা। বয়স মাত্র ৯ বছর। স্বাস্থ্য ভালো। বয়সের তুলনায় বেশ বড় সে। শহরে থাকে। পূজার ছুটিতে স্কুল বন্ধ থাকায় নানাবাড়ি এসেছে কয়দিন বেড়ানোর জন্য। অনেক বলেকয়ে সেজমামা রাজি করিয়েছেন রবিনের মাকে। মা-বাবাকে বাদ দিয়ে এই প্রথম তার গ্রামে আসা। স্কুল বন্ধের সময় সেজমামা বাসায় না গেলে এবারও সম্ভব হত না আসা। বেড়াতে আসা তো মুখের কথা মাত্র; ভ্রমর ধরাই আসল টার্গেট। প্রাইভেট টিচারের কাছ থেকে ভ্রমর ধরা ও ঘুরানোর গল্প শোনার পর থেকেই রবিনের মাথায় ঢুকেছে এই চিন্তা।

সবুজ পাহাড় এলাকার সবচেয়ে বড় ও নির্জন তার নানাভাইয়ের এই ছনবন। বিশাল আম-জাম-কাঁঠাল-লটকন আর পেয়ারাবাগানের তিনদিকের ঢালু জমিতে এর অবস্থান। এটির তুলনায় কিছুই না দাদাবাড়ির ছনচালা। তাছাড়া এত লকলকে ছোট ছোট কড়ইগাছও নেই দাদাবাড়ির ছনচালায়। যেখানে কড়ইগাছ, সেখানেই ভ্রমর। ভ্রমরের খুব প্রিয় খাবার কড়ই ডালের কচিপাতা।   

বাহ্! ওই তো, ওইখানে দেখা যাচ্ছে দু-তিনটে ভ্রমর। শেয়াল চলাচলের রাস্তা ধরে রবিন এগিয়ে যায় সেখানে। ভাবে, এবার নিশ্চিয় ধরা যাবে যে কোনো একটা। সবচেয়ে বড়টাই ধরব। কালো-নীল-সোনালি চকচকে শক্ত পাখায় ঝলমল করছে আশ্বিনের দুপুররোদের আলো। বুমবুম ভ্রমর ঘুরছে রবিনের চোখের ভেতর। হাত বাড়াতেই উড়ে গেল কাছের ছোট ভ্রমর দুটি। এ দুটির দেখাদেখি উড়ে গেল বড়টিও। যেন বজ্রপাত হল রবিনের হৃদপিণ্ডে। আরও অসহনীয় মনে হচ্ছে সূর্যের কড়া তেজ। ব্যথা হয়ে যায় হাঁটু। কোনো উপায় নেই সম্পুর্ণ সোজা হয়ে দাঁড়ানোর।

কিছুক্ষণ বসে বিশ্রাম নেয় ঘন লতা জড়ানো কড়ইগাছের ছায়ায়। বেড়ে যায় পানির পিপাসা। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, ‘যত কষ্টই হোক আজ ভ্রমর না নিয়ে বের হব না এই জঙ্গল থেকে। আজকেই রোদ সবচেয়ে বেশি। এমন রোদ নাও থাকতে পারে কাল-পরশু। প্রাইভেট টিচার ঠিকই বলেছিলেন-- যেদিন রোদ বেশি থাকে, সেদিন ভ্রমরও বেশি আসে।

হঠাৎ বুমবুম শব্দ। মনে হয়, খুবই কাছে। এদিক-সেদিক তাকায় রবিন। ঠিক তার মাথার উপর উড়ছে বড় একটি ভ্রমর। ভ্রমরের সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে রবিনের চোখের দৃষ্টি। কোথায় বসে! কোথায় বসে! এই তো বসেছে কড়ই ডালের ডগায়। একেবারেই হাতের কাছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘাড়ের ছোট ছোট তিল। একটু একটু করে কেটে খাচ্ছে লকলকে তেলতেলে সবুজ ডগা। মনে হয় মজা পাচ্ছে খুব। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে খাওয়ার গতি। সারাদিন পর মাছ-ভাত পাওয়া ক্ষুধার্ত মানুষের মতো। মনে হয় খেয়াল করছে না কিছুই। একমনে গিলছে আর গিলছে। খুব সাবধানে হাত বাড়ায় রবিন। ঘন লতাপাতার মঝে ছোট্ট একটা ফাঁক। কোথাও হাত স্পর্শ করলেই উড়ে যাবে ভ্রমর। আস্তে, আস্তে!  রবিনের হাত উঠে গেল কড়ই ডগাটির উপর। ঢিবঢিব শব্দ হচ্ছে তার বুকের ভেতর। কাঁপছে অর্ধ সোজা হাঁটু। কিঞ্চিত কেঁপে ওঠে হাত। নিজেই বন্ধ করে নেয় দম।

আস্তে! ধীরে। আস্তে! খপ্ করে হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয় ভ্রমর। রবিনের আঙুলের ভাঁজ ঢুকে পড়ে ভ্রমরের ঘাড়ের কলে। বন্দি করার প্রতিবাদে ভ্রমর কেটে নেয় রবিনের তুলতুলে আঙুলের মাংস! গড়িয়ে আসে এক ফোঁটা রক্ত! তবু ব্যথা যেন পাচ্ছে না রবিন। খুব কৌশলে গেঞ্জির পকেটে রেখে দিল ভ্রমর।

কিছুতেই সংগ্রহ করতে পারছে না গরুর লেজের লম্বা চুল। লেজে হাত দিতে গেলেই চটে যায় গরু। ছোট লেজের চুলে ভ্রমর বাঁধলে ছিঁড়ে যাবার সম্ভাবনা বেশি। বড় গরুগুলোর এত রাগ যে, পেছনে গেলেই লাথি মারে; লেজে হাত দেওয়া তো দূরের কথা-- রবিন ভেবে পায় না এসব গরু দিয়ে কীভাবে যে হালচাষ করেন সেজমামার ঐ বেঁটে মতো কাজের লোকটা! যে দুটি গরুর লেজ বড়; ঐ দুটিরই ইয়া বড় বড় শিং, লাল মাংসের মতো চোখ, উটের পিঠের মতো উঁচু উঁচু গজ। দেখলেই ভয় লাগে! গুঁতো দেওয়ার জন্য তেড়ে আসে বারবার। অথচ কিছুই করে না কাজের লোক আর সেজমামাকে।

গত কালও তো কাজলা গরুটার লেজ থেকে ছারপোকার মতো অনেক ছোট-বড় রক্তচোষা পোকা ছাড়িয়েছেন সেজমামা। গরুর গায়ে কামড় দিয়ে আঠার মতো লেগে থেকে সারাক্ষণ। রক্ত চোষে বলেই নাকি এ পোকার নাম হয়েছে ‘আটালি’। জোঁক স্বভাবের আঁটালির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্যই মনে হয় গা এলিয়ে চুপচাপ শুয়ে ছিল গরু। নির্ভয়ে শালিকও এসে খুঁটে খুঁটে আটালি খেয়েছিল গরুর গা-কান  থেকে। গরুটাও জিব দিয়ে বারবার চেঁটে দিচ্ছিল মামার শরীর। শেষে মামা বিরক্ত হয়ে গরুটার মুখেই মেরেছিলেন থাপ্পর। বিন্দুমাত্রও ক্ষুব্ধ হয়নি গরুটা। চুপ করে ছিল মাথা নিচু করে। অবাক হয়ে ভাবছিল রবিন, প্রতিপালকের অবাধ্য হয় না পশু! তখন মামাকে বললে কত সহজেই পাওয়া যেত লেজের লম্বা লম্বা চুল। আজ কখন জানি মামা ফিরে আসে মরজালবাজার থেকে। এত কষ্ট করে ভ্রমর ধরে চুলের অভাবে ঘুরানো যাবে না এক বিকেল; এটি মেনে নিতে পারছে না রবিন। কীভাবে যে একটা চুল ছিঁড় আনা যায় লেজের আগা থেকে! কীভাবে, কীভাবে...? রবিন নিজেকেই প্রশ্ন করে বারবার।

অবশেষে একটা বুদ্ধি আসে মাথায়। আমড়া গাছের নিচে থেকে নিয়ে আসে লম্বা চিকন বাঁশ। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে খুব কৌশলে বাঁশের ফাটা মাথায় পেঁচিয়ে ফেলে বড় গরুটির লেজের চুল। সঙ্গে সঙ্গে সাঁই করে লেজ উঁচিয়ে ছুড়ে মারে পিছনের পা। আনন্দে ভরে ওঠে রবিনের মন। বাঁশের ফাটা মাথায় আটকে আসা চুল থেকে মোটা ও লম্বাটি বেছে নেয় রবিন। অত্যন্ত সতর্কভাবে চেইন খুলে গেঞ্জির পকেট থেকে হাতে নেয় ভ্রমর। ওর প্রাইভেট টিচারের কাছ থেকে জেনে নেওয়া কৌশলে চুলের দুই মাথায় শক্ত করে বাঁধে ভ্রমরের দুই পা। অন্য চার পায়ে কিলবিল করে প্রতিহত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় ভ্রমর। পা নাড়ানাড়ির কারণে বেশকিছু সময় নষ্ট হয় রবিনের। চালকলের ফিতার মতো বৃত্তাকার চুলে গেঁথে দেয় প্রায় একফুট লম্বা পাটকাঠি। ধরে রাখে দুই মাথায়; ঠিক যেন ঘুড়ির লাটাই। মুক্তি পেয়েছে মনে করে উড়তে থাকে ভ্রমর। ঘুরতে থাকে পায়ে বাঁধা চুলের সীমানায়। রবিনের কানে লাগে বুমবুম বুমবুম বুমবুম শব্দ! বুকে বাজে কাঙ্ক্ষিত আনন্দ সংগীত। আগে কখনও সে পায়নি এত আনন্দ! স্কুলের দৌড়ে বা পরীক্ষায় প্রথম হলেও এমন লাগে না তার। ঈদে কিংবা জন্মদিনে নতুন জামাও দিতে পারে না এমন আনন্দ! এ আনন্দ যেন বিশ্বজয়ের! এ আনন্দ একান্ত নিজের।

গ্রামের বাড়িতে ১০টা না বাজতেই গভীর রাত! সবাই ঘুমিয়ে। মাটির দেওয়াল ঘেরা টিনের ঘরের পাটাতনে রাখা ধান খেয়ে আনন্দে কিচিরমিচির করছে অনেকগুলো ইঁদুর। নানুর পায়ের কাছে ঘুমন্ত বিড়ালের গলার ঘরঘর শব্দ। সাঁইসাঁই শব্দ করে লেজ দিয়ে মশা তাড়াচ্ছে গোয়ালের গরু। ঘরের উপরে হেলে থাকা বড় তেঁতুল গাছে বসে একমনে কু-কু ডাকছে পেঁচা।

রবিনের চোখে ঘুম নেই। ভাবে, কালই চলে যাবে বাসায়। ভ্রমর ঘুরিয়ে দেখাবে বন্ধুদের। রাতে বন্দি করে রাখবে ফিল্মের স্বচ্ছ খালি কৌটায়। সঙ্গে দিয়ে রাখবে কিছু কড়ইয়ের ডগা। বাইরে থেকে দেখবে কীভাবে খায়। বিছানা থেকে উঠে হাত ছোঁয়ায় চেয়ারের পিঠে রাখা গেঞ্জিতে। পকেটের গায়ে আলতোভাবে ধরে খেয়াল করে, আছে কি না ভ্রমর।

হ্যাঁ, আছে। ভালোভাবে চেইন লাগানো হয়েছে কিনা নিশ্চিত হয়ে এসে শুয়ে পড়ে বিছানায়। মনে পড়ে ওর নানুর কথা-- ‘ভ্রমরটা তুই ছেড়ে দে ভাই। স্বাধীনতা হরণ করা মহাপাপ। এভাবে বন্দি করে রাখলে এটা বাঁচবে না।’

এত কষ্ট করে ভ্রমর ধরে ছেড়ে দেবে, এমনটি যেন ভাবতেই পারে না রবিন। ভীষণ রাগ হয় নানুর উপর।

ঘুমে চোখে বন্ধ হয়ে আসে একসময়। স্বপ্ন দেখে, লিফটে আটকা পড়ে কান্নাকাটি শুরু করে রবিন। কে জানে কখন আসে বিদ্যুৎ। দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে তার! কপালের ঘাম এসে মিশে যাচ্ছে চোখের পানিতে। ক্ষুধায় জ্বলছে পেট। পিপাসায় আড়ষ্ট হয়ে আসছে কণ্ঠ। দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে হাত-পায়ের কাঁপন। দাঁড়ানো থেকে বসে এবং বসা থেকে শুয়ে পরে লিফটের মেঝেতে। ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে শরীর ও কণ্ঠ। চিৎকার করার চেষ্টা করছে সর্বশক্তি দিয়ে। কিন্তু পারছে না! মনে মনে প্রত্যাশা করছে সৃষ্টিকর্তার সহায়তা। ক্ষমা প্রার্থনা করছে অতীতের সকল কৃত অপরাধের।

হঠাৎ নানুর ডাকে ঘুম ভাঙে রবিনের। ভেঙে যায় দুর্বিসহ দুঃস্বপ্ন। মুক্তি পায় বন্দিজীবন। বুক ভরে টেনে নেয় ভোরের নির্মল বাতাস। কড়কড় শব্দ হয় গেঞ্জির পকেটে। ভ্রমর এখনও চালাচ্ছে মুক্তির চেষ্টা। রবিন বুঝতে পারে বন্দি ভ্রমরের কষ্ট! কেঁদে উঠে বুকের ভেতর। পকেটের চেইন খুলে হাতে নেয় ভ্রমর। চলে যায় উঠানে। গত কালের মত চকচক করে না ভ্রমরের পাখা। ছোড়াছুড়ি করে না হাত-পা। আগের মতো গায়ের সঙ্গে ঠিক মিলছে না উপরের শক্ত পাখা। নিচে থেকে বেরিয়ে আছে কার্বন কাগজের মতো হালকা পাখার অংশ। ক্লান্ত-শ্রান্ত-বিধ্বস্ত ভ্রমর দেখে খুব মায়া হয় রবিনের। খুলে দেয় পা থেকে চুলের গিঁট। কিন্তু উড়ে যায় না ভ্রমর! যেন বুঝতেই পারে না, সে মুক্ত হয়েছে কি না। ধীরে ধীরে হাঁটতে থাকে রবিনের খোলা হাতের তালুতে। ভ্রমরের গায়ে ফুঁ দেয় রবিন। আরও জোরে ফুঁ দিয়ে আকাশে উড়িয়ে দেয় ভ্রমর! সূর্যের আভায় লাল হয়ে ওঠা মেঘমুক্ত আকাশ! উড়ে চলা ভ্রমরের দিকে রবিন তাকিয়ে থাকে অপলক চোখে।