সোনারগাঁওয়ে দারুণ মজা

রূপকথার গল্পে রাজারানি, রাজপুত্র রাজকন্যার কথা আমরা অনেক শুনেছি। বাড়ির কাছাকাছি যদি কোনো রাজবাড়ি থাকে তাহলে সেটা দেখতে কার না ইচ্ছে হয়। আজ তোমাদের শোনাব এমনি এক জায়গার কথা যেখানে পুরনো দিনের রাজা আর সুলতানদের অনেক জিনিসপত্র, ঢাল-তলোয়ার রয়েছে। আরও রয়েছে অনেক পুরনো প্রাসাদ আার চমৎকার সব জিনিস।

>> শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 June 2014, 08:12 AM
Updated : 5 Oct 2016, 11:54 PM

তোমরা নিশ্চয়ই ভাবছ, আমি হয়ত অনেক দূরের কোনো দেশের কথা বলছি। মোটেই না। ঢাকার একবারে কাছেই রয়েছে এমন একটি জায়গা। এর নাম সোনারগাঁও। আমি অনেকবার সেখানে গিয়েছি। এই তো গত বৈশাখেও ঘুরে এলাম। আজ তোমাদের শোনাব সেই বেড়ানোর গল্প।

গাড়িতে বা বাসে চড়ে ঢাকা থেকে সোনারগাঁও যেতে সময় লাগে মাত্র এক ঘণ্টা। অবশ্য রাস্তায় যানজট থাকলে আর একটু বেশি সময় লাগতে পারে। প্রথমেই তোমাদের সোনারগাঁওয়ের ইতিহাস সম্পর্কে একটু বলে রাখি। তাহলে বেড়ানোর মজাটা পুরোপুরি পাবে।

ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা সোনারগাঁও। এখানে সুলতানি আমল ও মোগল আমলের বেশ কিছু প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন রয়েছে। প্রাচীনকাল থেকেই এ অঞ্চলে জনবসতি গড়ে ওঠে।

 

এ অঞ্চলের চারু ও কারুশিল্প এবং বস্ত্র বয়ন শিল্প পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে বিখ্যাত ছিল। তোমরা শুনে অবাক হবে সোনারগাঁও অঞ্চলের সুতি কাপড় মিশরীয় ও রোমান সাম্রাজ্যের অভিজাতদের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল।

সোনারগাঁওর প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম। ১৩শ’ শতকে রাজা দানুযমদেব দশরথদেব তাঁর রাজধানী বিক্রমপুর থেকে সোনারগাঁওয়ে নিয়ে আসেন। ১৪শ’ শতকের মাঝামাঝি সময় সুলতান শামসুদ্দিন ফিরোজ শাহ সোনারগাঁও অঞ্চল অধিকার করেন।

সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারক শাহ ছিলেন বাংলার স্বাধীন সুলতান, সোনারগাঁও ছিল তাঁর রাজধানী। বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম ঈশা খাঁর রাজধানীও ছিল সোনারগাঁওয়ে। ঈশা খাঁর রাজধানী হিসেবেই সোনারগাঁও সবচেয়ে বিখ্যাত।

ঈশা খাঁ ছিলেন মস্ত বড় বীর। সেই আমলের ঢাল-তলোয়ার, অস্ত্রশস্ত্র তোমরা দেখতে পাবে এখানে।

বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এখন রয়েছে লোকশিল্প জাদুঘর। এই জাদুঘরে তোমরা দেখবে বাংলার প্রাচীন সুলতানদের ব্যবহৃত অস্ত্র শস্ত্র, তৈজসপত্র, পোশাক, বর্ম, অলংকার  ইত্যাদি। বিশাল আকৃতির ঢাল তলোয়ার দেখে আমার সব সময় মনে হয় সে যুগের মানুষ কতটা শক্তশালী ছিল যে এমন ভারি অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ করত। বাংলার প্রাচীন ও মধ্যযুগের লোকশিল্পের অনেক নিদর্শনও রয়েছে এখানে। রয়েছে বাংলার প্রাচীন মুদ্রা। সোনারগাঁওয়ে  বড় সর্দার বাড়ি নামে পরিচিত একটি প্রাচীন জমিদার প্রাসাদে এই জাদুঘর রয়েছে। এই প্রাসাদটা দেখতে ঠিক রূপকথার প্রাসাদের মতো। প্রাসাদের সামনে রয়েছে পাথরের ঘোড়ায় চড়া সেপাই। দেখলে মনে হয় যেন জীবন্ত।

লোকশিল্প জাদুঘর গড়ে উঠেছে বিশাল এলাকা নিয়ে। এই লোকশিল্প জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা কে জান? শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন এই জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন। জাদুঘর এলাকায় রয়েছে একটি কারুপল্লি। এই কারুপল্লিতে জামদানি, নকশিকাঁথা, কাপড়ের পুতুল, পাটের ব্যাগ ও নানা রকম সামগ্রী, কাঠের কারুকাজ করা বিভিন্ন জিনিস, বাঁশ, বেত, শোলাসহ বিভিন্ন ধরনের কারুপণ্য তৈরি করা হয়। তোমরা দেখে অবাক হবে কীভাবে তাঁতের কাপড় বোনা হয় বা বাঁশ দিয়ে তৈরি হয় নানা রকম জিনিস। চাইলে সে সব কিনতেও পার। রয়েছে অনেকগুলো দোকান। আমি এখান থেকে অনেক কিছু কিনেছি, বিশেষ করে কাপড়ের পুতুল। তোমাদের মতো আমিও পুতুল ভালোবাসি তো, তাই।

পৌষ-মাঘ মাসে অথবা বৈশাখ মাসে এখানে চলে লোকশিল্পমেলা। এ মেলায় লোকসংগীত, যাত্রাপালা,কবিগান ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান পরিবেশন করা হয়।। মেলায় দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসেন লোকজ শিল্পী ও কারুশিল্পীরা। মাটি, শোলা, বাঁশ, বেত, কাপড়সহ বিভিন্ন হস্তশিল্পজাত সামগ্রী বিক্রি হয় এ মেলায়।

এখানে রয়েছে একটি বিশাল লেক। লেকে নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা আছে। তোমরা চাইলে নৌকায় চড়ে ঘুরতে পার। এছাড়াও আছে ক্যান্টিন। সুতরাং খাবার জন্য ভাবনা নেই।

লোকশিল্প জাদুঘরের কাছেই পানামনগরী। এ এক মজার জায়গা। এখানে এখন কোনো মানুষজন থাকে না। তোমরা গেলে দেখতে পাবে এখানে বিশাল প্রাসাদের মতো সব বাড়ি খালি পড়ে আছে। ঠিক যেন ভুতুড়ে শহর।  এই বাড়িগুলো আজ থেকে দু-তিনশ’ বছর আগে এ এলাকার ধনী ব্যবসায়ীরা গড়ে তুলেছিলেন। তারা কাপড়ের ব্যবসা করতেন। তাদের তৈরি করা বাড়িগুলো খালি পড়ে আছে।

প্রত্নতত্ব বিভাগের অধীনে পুরো পানামনগরী সংরক্ষিত রয়েছে। তোমরা এখানে দেখতে পাবে কারুকার্য করা বিশাল সব প্রাসাদ, ভেতরে সিরামিকের কারুকার্যশোভিত দেয়াল, নাচঘর, ঝুল বারান্দা। মনে হবে তোমরা যেন ঊনবিংশ শতাব্দীতে ফিরে গেছ জাদুকরের কোনো মন্ত্রবলে। সোনারগাঁওর সদর ও পানামনগরীর মধ্যে যোগাযোগের জন্য  তিনটি সেতু  রয়েছে। এই সেতু তিনটি মোগল আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল। পানাম সেতু, দালালপুর সেতু এবং পানামনগর সেতু নামে পরিচিত এ তিনটি সেতু মোগল স্থাপত্যরীতির নিদর্শন। এ সেতুগুলো এখনও ব্যবহৃত হচ্ছে।

শীতলক্ষ্যা নদীর তীরে রয়েছে মোগল আমলে নির্মিত সোনাকান্দা দুর্গ। এটিও দেখার মতো।

প্রাচীন বাংলা, সুলতানি ও মোগল আমলে সোনারগাঁও ছিল সমৃদ্ধ জনপদ ও বন্দর। এখানে চীনা পর্যটক মা হুয়ান, মরক্কোর পর্যটক ইবনে বতুতা ও ইয়োরপীয় পর্যটক  রালফ ফিচ এসেছিলেন । তাঁরা তাঁদের ভ্রমণ কাহিনিতে সোনারগাঁওয়ের কারুশিল্পের প্রশংসা করেছেন। তাঁদের ভ্রমণকাহিনিতে বলা হয়েছে সোনারগাঁও বন্দর থেকে দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পণ্যবাহী বাণিজ্য জাহাজ চলাচল করত। এ অঞ্চলের মসলিনসহ অন্যান্য সুতিবস্ত্র ছিল বিখ্যাত।

১২শ’ শতকে সোনাগাঁওয়ে ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য মুসলমান দরবেশ ও সুফি-সাধকরা আসেন।এই সুফি-সাধকদের কয়েকজনের সমাধি এ এলাকায় এখনও রয়েছে। রয়েছে সুলতান গিয়াসউদ্দিন আজম শাহের সমাধি।

সোনারগাঁওয়ের খাসনগর গ্রামে রয়েছে বিশাল দিঘি। দিঘির নামও খাসনগর। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিক থেকে দিঘি এবং তার চারপাশের দৃশ্য অসাধারণ সুন্দর। দিল্লির পাঠান সুলতান শেরশাহ সুরির নির্মিত বিখ্যাত গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের পূর্ব প্রান্ত সোনারগাঁওয়ে অবস্থিত। তোমরা কি গ্র্যান্ড ট্রাংক রোডের নাম শুনেছ? এই দীর্ঘ রাস্তা দিল্লি থেকে সোনারগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত। আবার দিল্লি থেকে এই পথ দিয়ে কাবুল কান্দাহার পর্যন্ত যাওয়া যেত। এই পথের দুপাশে অনেক বড় বড় দিঘি থাকায় এর নাম গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড। এখানে রয়েছে ফখরুদ্দিন মোবারক শাহের আমলে নির্মিত মসজিদ ও সমাধিসৌধ।

বাংলার প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ে যদি তোমরা বেড়াতে যাও তাহলে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সোনালি ভুবনে হারিয়ে যেতে পারবে সারাদিনের জন্য।