দুখু মিয়ার গল্প

ছোট একটি ছেলে। গায়ের রং শ্যামলা। ভারি সুন্দর লাবণ্যময় চেহারা। বড় বড় দুটি চোখে বিস্ময়ভরা চাহনি। ভীষণ চঞ্চল। তবে স্বভাবটি মনকাড়া। তাই গ্রামের সকলেই তাকে ভালোবাসে।  ছোটবেলা থেকে দুঃখের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাকে বাঁচতে হয়েছে। নামও তার দুখু মিয়া।

>> শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2014, 01:39 PM
Updated : 25 May 2014, 10:16 AM

কিন্তু শত দুঃখ কষ্ট সত্ত্বেও বড় হয়ে তিনি হয়েছেন জনগণের কবি, দেশের সবার প্রিয় মানুষ। তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।

নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে। সে সময় বাংলাদেশ, ভারতসহ পুরো উপমহাদেশ ছিল ব্রিটিশ শাসনে। নজরুলের পূর্বপুরুষরা সিপাহি বিদ্রোহের সময় ইংরেজবিরোধী ছিলেন। তাই মোগল আমলে অভিজাত হওয়া সত্ত্বেও সিপাহি বিদ্রোহের পর তারা খুবই খারাপ অবস্থায় পড়েন।

অবিভক্ত ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে কাজী পরিবার বসবাস করত। নজরুলের দাদার নাম ছিল কাজী আমিন উল্লাহ। নজরুলের বাবা কাজী ফকির আহমেদ গ্রামের মসজিদে ইমাম ছিলেন। মায়ের নাম ছিল জাহেদা খাতুন।

অভাবের সংসারে নজরুলের জন্ম। এরই মধ্যে গ্রামের মক্তবে নজরুলের পড়াশোনা শুরু হয়। তার ডাক নাম ছিল দুখু মিয়া। মাত্র ৯ বছর বয়সে তার বাবা মারা যান। ফলে পরিবারের দুঃখদুর্দশা আরও বাড়ে। এই সময় মক্তবের শিক্ষা শেষ করেন তিনি।

তারপর দশ বছর বয়সেই তাকে লেখাপড়া ছেড়ে আয়ের পথ খুঁজতে হয়। কারণ সংসার চালাতে হবে। তিনি সেই মক্তবেই ছাত্র পড়ানো শুরু করলেন। সেই সঙ্গে গ্রামে হাজী পালোয়ানের মাজারের খাদেম আর মসজিদের মুয়াজ্জিন হলেন।

নজরুলের এক চাচা ছিলেন লেটো দলের ওস্তাদ। লেটো দল মানে হচ্ছে নাচগানের দল। যারা বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে, নাটক দেখিয়ে টাকা রোজগার করে। চাচার প্রভাবে দুখু মিয়া ভিড়ে পড়লেন সেই লেটোর দলে। এখানে তার বেশ সুনাম হল। তার লেখা ও সুর করা গানগুলো শ্রোতা দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়তা পেল।

শুধু তাই নয়, দুখুর কণ্ঠস্বরও ছিল খুব মিষ্টি আর ভরাট। তার গানে সবাই মুগ্ধ হত। কয়েক দিনের মধ্যেই লেটোর দলের ওস্তাদ হলেন দুখু। সংসারের অভাব অনটনের জন্য অর্থ রোজগার করতে হলেও দুখুর পড়ার আগ্রহ কমেনি। তার খুব ইচ্ছা স্কুলে পড়ার।

১৯১০ সালে নজরুল লেটোর দল ছেড়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। রানিগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে পড়লেন কিছুদিন। তারপর ভর্তি হলেন মাথরুন হায়ার ইংলিশ স্কুলে। স্কুলের প্রধান শিক্ষকসহ অন্য শিক্ষকরা তাকে বেশ পছন্দ করতেন। স্কুলে তিনি ছিলেন বেশ চটপটে স্বভাবের। লেখাপড়াতেও ভালো করার আপ্রাণ চেষ্টা করতেন। কিন্তু দুখুর দুঃখের শেষ নেই। লেখাপড়া করার মতো টাকা কোথায় তার। ষষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার রোজগারের জন্য কাজে নামতে হল।

এবার যোগ দিলেন বাসুদেবের কবিগানের দলে। কবিগানের দলে মুখে মুখে কবিতা বানিয়ে দর্শক-শ্রোতাদের শোনাতে হয়। দুই দলের মধ্যে কবির লড়াইও চলে। কবিগানের দলে দুখু বেশ নাম করলেন। কবিতা বানাতে আর গান গাইতে তো তার জুড়ি নেই।

কিন্তু হলে কী হবে। এই কাজে তেমন রোজগার নেই। নিজের পেট চালাতে হবে, সংসারেও টাকা পাঠাতে হবে। এরপর রেলওয়ের একজন গার্ডের খানসামা বা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করলেন কিছুদিন।

এরপর সেই কাজ ছেড়ে আরেকটু বেশি বেতনের আশায় আসানসোলে চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নিলেন। কী পরিশ্রমের কাজ আর কত কষ্ট ভেবে দেখো তো। কিন্তু এত কষ্টেও ভেঙে পড়েননি দুখু। রুটির দোকানে কাজ করতেন আর ছড়া কবিতা লিখতেন।

১৯১৪ সালে এই দোকানে কাজ করার সময় আসানসোলের দারোগা রফিকউল্লাহ তাকে দেখলেন। নজরুলের সঙ্গে আলাপ করে, তার ছড়া কবিতা শুনে রফিকউল্লাহ বুঝতে পারলেন ছেলেটি প্রতিভাবান। তিনি দুখুকে নিয়ে এলেন ময়মনসিংহের ত্রিশালে। এখানে দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি করে দিলেন তাকে।

কিন্তু নিজের গ্রাম ছেড়ে এতদূরে ত্রিশালে তার মন ভালো লাগত না। একা একা গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন তিনি। দেখতেন প্রকৃতির সৌন্দর্য।

১৯১৫ সালে তিনি ফিরে এলেন রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে। ভর্তি হলেন অষ্টম শ্রেণিতে।

১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই লেখাপড়া করলেন।  মাধ্যমিক পরীক্ষার সময় ঘনিয়ে এল। প্রিটেস্ট পরীক্ষা দিতে হবে। তার আগেই সুযোগ পেলেন সেনাবাহিনীতে। রোজগারের ভাবনা ঘুচল। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছিল। সৈনিক হিসেবে যোগ দিয়ে যুদ্ধে চলে গেলেন নজরুল।

দুখুমিয়া তার পুরো শৈশব-কৈশোর এভাবেই দুঃখের সঙ্গে লড়াই করেছেন। তবে হাল ছাড়েননি। আর কবিতা লেখাও কখনও ছাড়েননি। পরবর্তী জীবনেও তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে। আর্থিক কষ্ট ছিল। ছিল অনেকের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য।

তবে সেসবে দমে না গিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে গেছেন। লিখে গেছেন অবিশ্রান্ত। শিশু কিশোরদের জন্যও অনেক কবিতা লিখেছেন তিনি।

জীবনে অনেক দুঃখ কষ্ট পেলেও তিনি কিন্তু মোটেই গোমড়ামুখো ছিলেন না। বরং ছিলেন দারুণ হাসিখুশি, চঞ্চল, ছটফটে একজন মানুষ। যখন হাহা করে হাসতেন তখন আশপাশের মানুষের মনেও ছড়িয়ে যেত আনন্দের রেশ। মানুষের ভালোবাসাই দুখু মিয়াকে সব দুঃখ কষ্ট জয় করার প্রেরণা দিয়েছিল।