ঘুরে এলাম পান্ডারাজ্য

চিড়িয়াখানায় বেড়াতে কে না ভালোবাসে? বিশেষ করে সেখানে যদি দেখা যায় পান্ডা, গরিলা, পেঙ্গুইন, ডলফিন ও আরও অনেক প্রাণী।

>> শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 May 2014, 08:37 AM
Updated : 5 Oct 2016, 11:54 PM

বলছিলাম বেড়ানোর কথা। তোমরা যদি কখনও চীন দেশে বেড়াতে যাও তাহলে বেইজিং চিড়িয়াখানায় গিয়ে পান্ডা দেখতে ভুলবে না কিন্তু। ঢাকা থেকে বেইজিং সরাসরি ফ্লাইট নেই। ঢাকা থেকে যেতে হয় চীনের কুনমিং শহরে। সেখান থেকে ট্রেনে বা প্লেনে বেইজিং।

তোমরা নিশ্চয়ই জান, চীনের রাজধানীর নাম বেইজিং। পৃথিবীর বিখ্যাত ও সুন্দর চিড়িয়াখানার মধ্যে বেইজিং জু অন্যতম। শহরের মধ্যেই বেইজিং জু। মূলত চীনের মিং সম্রাটদের আমলেই এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজ তোমাদের শোনাব এই চিড়িয়াখানায় বেড়ানোর গল্প।

বিশাল এলাকা নিয়ে এই চিড়িয়াখানা। এর ল্যান্ডস্কেপ অপূর্ব সুন্দর। চীনের যে কোনো পার্ক, যেমন-- জলাশয়, পাহাড়, বাগান, ভাস্কর্য নিয়ে গড়ে ওঠে। এই চিড়িয়াখানাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষ করে বাঘের একটি বিশাল ভাস্কর্য রয়েছে, যা শিল্প হিসেবে অনবদ্য। ডিসেম্বর মাসে এক কনকনে শীতের সকালে গিয়েছিলাম এই চিড়িয়াখানায়।

চিড়িয়াখানায় ঢুকে চোখ জুড়িয়ে গেল ভেতরের ল্যান্ডস্কেপে। দিনটা রোদেলা। অনেক গাছের পাতা ঝরে গেলেও কিছু গাছে পাতা রয়েছে।

চিড়িয়াখানায় প্রথম গেলাম পান্ডার আস্তানায়। গুন্ডাপান্ডা কথাটি প্রচলিত থাকলেও চীনের পান্ডারা মোটেই গুন্ডা নয়। বরং উল্টো। পান্ডা অত্যন্ত আদুরে ও নিরীহ গোছের প্রাণী। অবশ্য তেমন কোণঠাসা হলে পান্ডাও আক্রমণ করে বসতে পারে তবে তেমনটি সচরাচর ঘটে না। 

পান্ডার জন্য বরাদ্দ বিশাল একটি এলাকা। চীনের জাতীয় পশু। একে নিয়ে চীনাদের আহ্লাদের সীমা নেই। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণী বলে অবশ্য সারাবিশ্বে এদের কদর। চীন সরকার এদের সংরক্ষণে খুব উদ্যোগী।

পৃথিবীর খুব বেশি চিড়িয়াখানায় পান্ডা নেই। চীন সরকার পান্ডা বিক্রি করে না। অন্য চিড়িয়াখানাকে ভাড়া দিতে পারে। যেসব চিড়িয়াখানা চীন সরকারের কাছ থেকে পান্ডা ভাড়া নেয়, তারা প্রতিবছর পান্ডা বাবদ বেশ মোটা টাকা ভাড়া দেয়। ফলে পান্ডাকে রোজগারি প্রাণীও বলা যায়।

কাচে ঘেরা বিশাল এক এলাকায় তাদের থাকার ব্যবস্থা। এই কাচের প্যাভিলিয়নের ভেতরে পান্ডার জন্য সবচেয়ে আরামদায়ক আবহাওয়া রয়েছে। পান্ডারা বাঁশের কচি ডগা খেতে পছন্দ করে। তাদের জন্য বাঁশঝাড় রয়েছে সেখানে।  আরও রয়েছে তাদের বিভিন্ন পছন্দের খাবার।

পান্ডা ভীষণ অলস। অমিশুকও। এরা একা থাকতে ভালোবাসে। ভেতরে দেখলাম কয়েকটি পান্ডা গাছের ডালে হাত পা ছড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। দুয়েকটি বাচ্চা পান্ডা খেলা করছে।

আমার খুব মজা লাগছিল পান্ডা ছানাদের দেখতে। দেখলেই সফট টয়েজ বলে মনে হয়। চীনে আদুরে পান্ডা বলে একটা কথা খুব প্রচলিত। বাচ্চাদের আদুরে পান্ডা বলে ডাকে বাবামায়েরা। চীনা ভাষায় পান্ডাকে বলে শিয়ান মাও। বেইজিং অলিম্পিকের মাসকটও ছিল পান্ডা। তোমাদেরও পান্ডা ছানা দেখে খুব ভালো লাগবে একথা জানিয়ে দিচ্ছি।

পান্ডার প্যাভিলিয়নের ভেতর বিক্রি হচ্ছে বেইজিং অলিম্পিকের ছবিওয়ালা পান্ডার নানা রকম স্যুভেনির। চাবির রিং, কলম, কলমদানি, ফুলদানি থেকে শুরু করে হরেক রকম জিনিস। পান্ডার সফট টয়েজও প্রচুর। কম দাম থেকে শুরু করে বেশি দামের জিনিস রয়েছে। পকেট বুঝে যার যা পছন্দের জিনিস কিনছে। আমিও ৩০ ইউয়ান দিয়ে একটা পান্ডা পুতুল কিনলাম। তোমরাও এখান থেকে পান্ডা পুতুল কিনতে পার।

বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত বেইজিং চিড়িয়াখানা। ২২০ একর এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠা এই চিড়িয়াখানায় ৯৫০ প্রজাতির ১৪ হাজার ৫০০ জীবজন্তু রয়েছে। বিরল প্রজাতির প্রাণীদের মধ্যে এখানে রয়েছে সোনালি নাক বানর, দক্ষিণ চীনাবাঘ, সাদাঠোঁট হরিণ, পিয়েরে ডেভিডস ডিয়ার, ক্রেস্টেড ইবিস, চীনা কুমির, চাইনিজ জায়ান্ট স্যালামান্ডার, সাইবেরিয়ান টাইগার, ইয়াক, প্রিজিওয়ালস্কিস হর্স, স্নো-লেপার্ড, তিব্বতি হরিণ, চমরি গাই এবং কিয়াং।

বিশ্বের খুব কম চিড়িয়াখানাতেই গরিলা রয়েছে। বেইজিং জু তাদের অন্যতম। এখানে বেশ কয়েকটি গরিলা আছে। আরও আছে সিংহ, জাগুয়ার, ক্লাউডেড লেপার্ড, এশীয় ও আফ্রিকান হাতি, গন্ডার, হিপোপটোমাস, কালো ভালুক, মেরুভালুক, টাপির, সামুদ্রিক কচ্ছপ, পেঙ্গুইন, ক্যাংগারু, শিম্পানজি, মুন্টজাক, অ্যাডাক্স, জেবরা, ভোঁদর, লেমুর, ফ্লেমিংগো ইত্যাদি।

বিশ্বের পনের প্রজাতির সারসের মধ্যে তেরটি রয়েছে বেইজিং চিড়িয়াখানায়। আরও রয়েছে অসংখ্য জাতের পাখি, সাপ, ইত্যাদি। বেইজিং চিড়িয়াখানায় একটা বিশালাকার অ্যাকুরিয়াম রয়েছে। যেটি বিরাট এলাকা নিয়ে অবস্থিত। সেখানে রয়েছে ডলফিন থেকে শুরু করে বিভিন্ন প্রজাতির জলজ প্রাণী।

আমি বাঘের দেশের মানুষ। তাই খুঁজে খুঁজে বাঘের এলাকায় গিয়ে হাজির হলাম। ‘মুনজালা হু’ বা রয়েল বেঙ্গল টাইগারও রয়েছে এখানে। রয়েছে সাদা বাঘ, সিংহ, বিশালাকার সাইবেরিয়ান টাইগার। এতসব জীবজন্তুর ভিড়ে আমার রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বড় আপন মনে হল।

বললাম, “মামা, বিদেশে আছ, দেশের জন্য মন কাঁদে না?”

বাঘমামা উত্তর দিলেন, “হালুম, কাঁদো ভাগ্নি, কিন্তু তোমার মতোই পেটের দায়ে বিদেশে চাকরি করছি। তুমি হয়ত দেশে ফিরতে পারবে। কিন্তু আমার তো আর জীবনেও সুন্দরবনে ফেরা হবে না।”

বাঘমামার জন্য মনের কোণে ব্যথা নিয়ে অন্য এলাকার দিকে চললাম। লেকের পানি জমে কাচের মতো হয়ে আছে। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, সেই বরফ জমা লেকের ভেতরে লাল-নীল মাছ দেখা যায়। তার মানে নিচের পানি এখনও জমেনি। বড় সুন্দর সেই দৃশ্য।

চিড়িয়াখানাটা বেজায় বড়। জীবজন্তু খুঁজে পাওয়াই মুশকিল। তবে স্থির করেছি গরিলা দেখতেই হবে। তাই খুঁজে খুঁজে গরিলার বাড়ির সামনে এসে পড়লাম। গোরিলার বাড়ির সামনের চত্বরে অনেকগুলো প্রমাণসাইজ গরিলার মূর্তি। নানা ভঙ্গিমায় গরিলা রয়েছে এখানে। কোনো কোনোটার পিঠে চড়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। শিশুরা চড়ছে সেসব পুতুল গরিলার কোলে পিঠে। সব জীবজন্তুর ঘরের সামনেই রয়েছে সেই জন্তুর বড় মূর্তি। শিশুরা সেটার পিঠে চড়তে পারে।

গরিলাদের রাখা হয়েছে কাচের বিশাল ঘরের ভেতর। ভেতরে গাছ, বাড়ি সবই রয়েছে। কাচের ঘরের ভেতর তাদের উপযোগী পরিবেশ।

তারপর গেলাম পেঙ্গুইন দেখতে। পেঙ্গুইনের ঘরও বিশাল। কাচের অ্যাকুরিয়ামের মধ্যে রয়েছে মেরু এলাকার পরিবেশ। পানিতে ভাসছে বরফের চাঁই। তার মধ্যে সাঁতরে বেড়াচ্ছে ঝাঁকঝাঁক পেঙ্গুইন। দারুণ লাগল।

পথনির্দেশ খুঁজে খুঁজে বিভিন্ন দিকে যাচ্ছি। ঘুরতে ঘুরতে পাখির এলাকায় এসে পড়লাম। বিশাল লেক। তার মধ্যে বিকেলের আলো এসে পড়েছে। রং বেরংয়ের অসংখ্য পাখি সেখানে। ঝাঁক বেঁধে উড়ছে, পানিতে ভেসে বেড়াচ্ছে। লেকের এই অংশের পানি কৃত্রিম উপায়ে জমে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করা হয়েছে। ফলে জলজ পাখিরা স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরছে এখানে। সে যে কী অপূর্ব দৃশ্য। মনে হচ্ছিল স্বপ্নের জগৎ। 

চিড়িয়াখানা এত বিশাল যে একদিনে তো দূরের কথা কয়েকদিনেও পুরো এলাকা দেখে শেষ করা সম্ভব না।

চীনে আজকাল অনেকেই বেড়াতে যাচ্ছেন। তোমরাও যেতে পার। আর গেলে বেইজিং চিড়িয়াখানায় পান্ডা, গরিলা এদের দেখে আসবে নিশ্চয়ই।