জেনাসের ভয়ংকর একদিন

>> শান্তা মারিয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 April 2014, 01:19 PM
Updated : 21 April 2014, 01:19 PM

খুব ছোটবেলার কথা জেনাসের কিছু মনে নেই। ওর শুধু মনে আছে একটা খুব বড় ঝকমকে বাড়ি। সেখানে ভীষণ চড়া আলো। ও বড় হয়ে পাপার কাছে শুনেছে ওটা ছিল একটা শুটিং বাড়ি। ওখানে বিভিন্ন নাটকের শুটিং হয়। সেখানে ঘরগুলো সব শুটিংয়ের জন্য সাজিয়ে রাখা হয়। ওকে একটা ধারাবাহিক নাটকে অভিনয় করতে হয়েছিল। অভিনয়ের জন্য ওকে বিশেষভাবে আনা হয়েছিল কাঁটাবন থেকে। দৃশ্যটা ছিল নায়িকার কোলে চড়ে ওর এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়ানোর। নায়িকার নাকি ওর গায়ের গন্ধ পছন্দ হয়নি। তাই ওকে প্রতিদিন শ্যাম্পু দিয়ে গোসল করানো হত। শুটিং ইউনিটের লোকরা ওকে একটা ঘরে আটকে রাখত। তখনও ওর দুধ ছাড়া কিছুই খাবার বয়স হয়নি। কিন্তু ওকে দেওয়া হত মুরগি। ফলে ও কিছুই খেতে চাইত না। সারাদিন শুধু কাঁদত, পানি খেত, আর মাকে ডাকত। কিন্তু কোথায়-বা মা?

ও প্রায় আধমরা হয়ে পড়েছিল। তারপর তো একদিন নাটকের শুটিং শেষ হল। ইউনিটের লোকজন ওকে রাস্তায় ফেলে দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু পাপা ওদের কাছ থেকে ওকে নিয়ে এলেন বাড়িতে। সেদিনটা ওর খুব ভয় করছিল। অনেকটা রাস্তা গাড়ি চড়ে ও এসে ঢুকল একটা ফ্লাটবাড়িতে। তখন বেশ রাত। প্রায় একটা বাজে। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছিল। এমনকি মামণিও। কিন্তু অর্ণবাবু জেগে ছিল। বেল বাজতেই অর্ণবাবু ছুটে এসে দরজা খুলে দিল। তারপর ওকে দেখে খুশিতে চিৎকার করে উঠল। অর্ণবাবুর চিৎকারে মামণি বেডরুম থেকে বেরিয়ে এলেন, এমনকি নানাভাই আর নানুও।

মামণি ওকে দেখেই তাড়াতাড়ি ওর খাবারের আয়োজন করতে লেগে গেলেন। একটা বাটিতে দুধ নিয়ে আসলেন। কিন্তু ও দুধ খেতে পারল না। কারণ এর আগে ও কখনও বাটিতে করে দুধ খায়নি। তাছাড়া এ কদিন মুরগি খেয়ে অন্যকিছু খেতে ভুলে গিয়েছিল ও। পাপা ছোট একটুকরো মাছ দিলেন। কিন্তু ও সেটাও খেতে চাইল না। তখন অর্ণবাবু তাড়াতাড়ি হাঁড়ি থেকে একটু মুরগির মাংস এনে ওর সামনে ধরল। এবার ও কিছুটা খেয়ে নিল। তারপর ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসাতে ও গুটিসুটি মেরে ওখানেই ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন যখন ঘুম ভাঙল তখন ও দেখে, একটা বেশ নরম সোফায় শুয়ে আছে। সেদিন থেকেই ওর নাম হল জেনাস। এটা অর্ণবাবুর দেওয়া নাম। অর্ণবাবু বলল, ওর পুরো নাম হবে জেনাস স্ক্র্যাচিং ক্যাটক্লস আর ডাক নাম হবে জেনাস। মামণি অবশ্য বলেছিল জেনাস একজন রোমান দেবতার নাম। ও তো মেয়ে, ওর নাম ভিনাস হলে ভালো হয়। কিন্তু অর্ণবাবু তাকে জেনাস নামই দেবে বলে জেদ ধরল। নানু দুয়েকদিন ওকে পুষি পুষি বলে ডাকলেও শেষ পর্যন্ত জেনাস নামটাই চালু হয়ে গেল।

ছোটবেলায় জেনাস খুব দুষ্টুমি করত। মানে যতক্ষণ জেগে থাকত ততক্ষণ দুষ্টুমি করত। আর বাকি সময়টা সোফায়, মামণির বিছানায়, টেবিলে, ফ্রিজের উপর, ল্যাপটপের উপর এমনকি টিভির উপর ঘুমিয়ে কাটাত। পাপা ওকে খাবার টেবিলের উপর উঠতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু ও সে কথা শুনলে তো। লাফিয়ে খাবার টেবিলে উঠে পড়ত ও।

ড্রইংরুমে সাজিয়ে রাখা শোপিসগুলো দেখতে ওর খুব ভালো লাগত। শোকেসের ভেতরে ও ঢুকতে পারত না কাচের ¯øাইডের জন্য। কিন্তু শোকেসের উপর যে খেলনাগুলো সাজানো থাকত সেগুলোও কম সুন্দর ছিল না। ও লাফিয়ে শোকেসের উপর উঠত তারপর হাত দিয়ে একটু একটু করে ঠেলে একটা শোপিসকে একেবারে কিনারায় নিয়ে যেত। ঝুম করে নিচে পড়ত শোপিসটা। তারপর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যেত। ওর খুব মজা লাগত কাচের খেলনা ভাঙার শব্দ। প্লাস্টিকের শোপিস ভাঙত না, তাই ওগুলোকে ফেলে তেমন মজা হত না। অর্ণবাবুর কয়েকটা সফট টয়েজ ছিল সেগুলোকে শিকার করতেও দারুণ মজা পেত ও। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে পাপাই, টেডি আর টুইটির সঙ্গে খেলত ও। একবার মামণি চীন থেকে ওর জন্য একটা পান্ডা পুতুল এনে দিলেন। সেটা হয়ে দাঁড়াল জেনাসের প্রিয় খেলনা। ওটার সঙ্গে দিনরাত কুস্তি লড়ে ওটাকে আঁচড়ে কামড়ে একাকার করত ও। ও যখন সফট টয়েজ নিয়ে খেলত তখন বাড়ির সবাই ভীষণ মজা পেত। ওকেও মনে হত একটা সাদা রংয়ের সফট টয়েজ।

ওর জন্য কিনে আনা হত বাউন্সিং বল। ড্রইংরুমে একটা বাউন্সিং বল ছেড়ে দিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে ওর লাফঝাঁপ দেখত। যেন সার্কাস। এটা আরও জমত মামা-মামি আসলে। মামাকে দেখানোর জন্য অর্ণবাবু মজার মজার সব খেলা বের করত জেনাসকে নিয়ে। আর মামা তার মোবাইল ফোনে জেনাসের ভিডিও তুলতেন। সেগুলো নাকি মামা ফেইসবুকে দেন, আর অনেক লাইক পড়ে। এসব কথা শুনে জেনাসেরও খুব আনন্দ হত। ও বুঝত বাড়ির সবাই ওকে খুব ভালোবাসেন। আস্তে আস্তে মামণি ওকে রান্না মাছ আর শুটকি মাছ খেতে শেখালেন। মাছ ওর ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠল। বিশেষ করে যেদিন বাড়িতে ইলিশ মাছ আসত। ও তো গন্ধে পাগল হয়ে রান্না ঘর আর খাবার ঘরে ছুটাছুটি করত।

প্রতিবছর জেনাসের বার্থডেও পালন করা হত। ওর সঠিক বার্ড ডে কবে সেটা অবশ্য কেউ জানত না। তবে অর্ণবাবু একটা দিন ঠিক করে নিয়েছিল। অর্ণবাবুর মতে যেদিন ওকে এ বাড়িতে আনা হয়েছিল সেটাই ওর জন্মদিন। জন্মদিনে মামণি বেইলি রোড থেকে একটা কেক নিয়ে আসতেন। জন্মদিন উপলক্ষে মামা-মামি এ বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। নানাভাই ওর গলায় একটা লাল ফিতে বেঁধে দিতেন। নানাভাই কমিউনিস্ট ছিলেন কিনা, তাই লাল রংটা খুব পছন্দ করেন।  ফিতেটা আবশ্য ও তেমন পছন্দ করত না। তবে মুরুব্বি মানুষ বলে ও কিছুটা সম্মান দেখিয়ে ফিতেটা অল্পসময় গলায় রাখত।

জন্মদিনে অর্ণবাবু ওকে চকলেট খেতে দিত। চকলেট জেনাসের মোটামুটি প্রিয় খাবার। আর মামার আনা দইও ও বেশ চেটেপুটেই খেত। তবে ও সবচেয়ে পছন্দ করত পাপার রান্না করা মাছ। পাপা জেনাসের জন্য স্পেশাল মাছ রান্না করতেন। বুয়ার রান্না জেনাস একদম পছন্দ করত না। কারণ বুয়া রান্নায় বেশ ঝাল দেয়।

এ বাড়িতে আসার কয়েক মাস পর জেনাস একবার হারিয়ে গিয়েছিল। সেটা মনে হলেই অনেকদিন পর্যন্ত ভয় লাগত ওর। ও ভুল করে ফ্লাটের খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নেমে কী করে যেন গ্যারেজে ঢুকে পড়েছিল। অ্যাপার্টমেন্টের বিশাল বেজমেন্ট। সেখানে অসংখ্য গাড়ি আসছে, যাচ্ছে, হর্ন বাজাচ্ছে প্যাক-প্যাক। শব্দে জেনাসের কান ঝালাপালা। ভয়ে থরথর করে কাঁপছিল ও। অবশ্য পাপা একটু পরই ওকে খুঁজে বাড়িতে নিয়ে এসেছিলেন। এরপর থেকে জেনাস আর কখনও বাড়ির বাইরে যায়নি। আরও কিছু কিছু জিনিস জেনাস ভয় পেত। বিশেষ করে মামণির পারফিউমের বোতল আর হেয়ার ড্রায়ারে ওর খুব ভয়। পারফিউমের বোতল থেকে কেমন একটা হিস-স-স শব্দ বের হয়। আর হেয়ার ড্রায়ারটার গোঁগোঁ আওয়াজে ওর কানে তালা ধরে। মামণি যখন বিদেশে যেতেন তখন ওর খুব মন খারাপ হত তবে স্কাইপে মামণির সঙ্গে কথা বলার পর ও শান্ত হত।

এগুলো সত্তে¡ও মোটের উপর এই তিন চার বছরের জীবনে জেনাস বেশ সুখেই ছিল।

কিন্তু কয়েকদিন ধরে ওর ভীষণ মন খারাপ লাগছে। বাড়ির সবার উপর খুব অভিমান হচ্ছে। কেন ওর দিকে কেউ তেমন মনোযোগ দিচ্ছে না কে জানে। জানে ও ইদানিং বড় হয়ে গেছে। আর অর্ণবাবুও উপরের ক্লাসে উঠেছে বলে লেখাপড়া বেড়েছে। আজকাল লেখাপড়া নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে সে, আগের মতো যখন তখন ওর সঙ্গে খেলা করে না। কয়েকদিন আগে বাড়ির ব্যালকনিতে বসে ছিল জেনাস।। তখন পাশের বাড়ির একটা দুষ্টুু বেড়াল উল্টো দিকের ব্যালকনিতে বসে ওকে যাচ্ছেতাই ঠাট্টা করেছে।

বেড়ালটা বলছিল, “ ম্যাও, ম্যাও। ছিঃ ছিঃ। বেড়াল হয়েও তুই বাড়ির বাইরে গেলি না, পাখি শিকার করলি না, মাছ ধরে খেলি না। তোর তো জীবনের ষোলআনাই মিছে।” জেনাস প্রথমে কোনো উত্তর দেয়নি।

তারপর বলেছিল, “আমি তোমার মতো সাধারণ বেড়াল নই। আমি রাস্তা থেকে আসিনি। পাপা বলেছে আমি টার্কিস বেড়াল। আমাকে কাঁটাবন থেকে কিনে আনা হয়েছে। আমি ছোটবেলায় নাটকেও অভিনয় করেছি।”

শুনে বেড়ালটা ফ্যাঁচফ্যাঁচ করে সেকি হাসি। বলেছিল, “ধুর ধুর। রাখ ওসব কথা। বারান্দায় এত চড়াই আসে, তোদের বারান্দার উপর তো চড়াইরা বাসাও বেঁধেছে দেখছি। ওদের দুচারটে ছানাকে ধরে খেতে পারিস না?”

জেনাস ওসব কথার কোনো জবাব না দিয়ে ঘরে চলে এসেছিল বটে কিন্তু চড়াইয়ের ছানা ধরে খাবার আইডিয়াটা ওর মন্দ লাগেনি।

ওদের বারান্দার গ্রিলের ফাঁকে সত্যিই একজোড়া চড়াই বাসা বেঁধেছে। কয়েকটা ছানাও হয়েছে ওদের। চড়াইয়ের ছানা খেতে কেমন কে জানে। মজার নিশ্চয়ই, নইলে দুষ্টু বেড়ালটা বলবে কেন। এরপর থেকে জেনাস প্রায়ই বাসাটার উপর নজর রাখে।

একদিন সত্যি সত্যি একটা ছোট্ট চড়–ইছানা ঝুপ করে পড়ে গেল বাসা থেকে। সবে ডানা গাজিয়েছে ছানাটার । উড়তে শেখেনি এখনও। তিড়িংবিড়িং করে লাফাচ্ছে। জেনাস সহজেই ওকে ধরতে পারে। কিন্তু যেই না ওকে খপাৎ করে ধরেছে অমনি নানু এসে দিয়েছে ভীষণ জোরে এক ধমক। “জেনাস, ছাড় ওকে”।

বলতে বলতেই বুয়া ছুটে এসে জেনাসের থাবা থেকে ছানাটাকে ছাড়িয়ে নিয়ে বাসায় উঠিয়ে দিয়েছে। মামণিও তখন মাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন। বারান্দায় ছুটে এসে ওকে বললেন, “ছিঃ জেনাস। এই সব জংলিপনা কোথা থেকে শিখছ? এত করে তোমাকে ভালো ভালো কথা শেখাচ্ছি, গান শুনাচ্ছি, আর তুমি দিন দিন বখাটে হচ্ছ।”

মামণির বকা খেয়ে ভীষণ মন খারাপ হয়ে গেল জেনাসের। না হয় সে একটা অন্যায় করেই ফেলেছে। তাই বলে সবার সামনে তাকে বখাটে বলা কি মামণির উচিৎ হয়েছে। বিশেষ করে পাশের বাড়ির দুষ্টু বেড়ালটা ওদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল আর মিচকে হাসি দিচ্ছিল। দেখে জেনাসের প্রায় কান্না পেয়ে গেল।

মন খারাপ করে রাতে সোফায় শুয়ে রইল জেনাস। পরদিন সকালে মনটা আরও খারাপ হযে গেল ওর। আজ ওর জন্মদিন। কিন্তু বাড়ির লোকদের কোনো তোড়জোর দেখা গেল না। পাপা ভোর সকালে কোথায় বেরিয়েছে। হয়তো নাটকের শুটিং আছে। মামণিও একটু পর অফিসে চলে গেল।

আজ আবার অর্ণবাবুর পরীক্ষা। নানু তাই ওকে নিয়ে গেলেন স্কুলে। বাড়িতে একা নানাভাই আর বুয়া। নানাভাই ঘরে বসে বসে টেলিফোনে কার সঙ্গে যেন কথা বলছেন। বুয়া রান্নায় ব্যস্ত। জেনাস ব্যালকনিতে গিয়ে বসল। অমনি দুষ্টু বেড়ালটা ওদিকের ব্যালকনিতে হাজির। ওকে দেখে জেনাস মুখ ঘুরিয়ে চলে যাচ্ছিল। দুষ্টুটা পিছন থেকে ডেকে বলল, “কী রে, অত ডাঁট দেখিয়ে চলে যাচ্ছিস যে বড়। তুই যে বলছিলি তোকে নাকি বাড়ির সবাই খুব ভালোবাসে। কই তার তো কোনো লক্ষণ দেখলাম না। সেদিন তুই কীভাবে বকা খেলি, তাও তো চোখের সামনেই দেখলাম। আরে যত যাই বলিস না কেন, তুই তো আর মানুষ নস, একটা সামান্য বেড়াল। এতদিন তোকে নিয়ে একটু মজা করেছে। এখন তোর কথা ভুলে গেছে। দেখিস কদিন পর ঠিকমতো খাবারও দেবে না। তখন আমার মতোই চুরি করে খেতে হবে।”

“আমি কখনও চুরি করে খাব না।” উত্তর দিয়েছে জেনাস।

“আরে রাখ, ওসব বড় বড় কথা অনেক শুনেছি। আগে একটু বাড়ির বাইরে গিয়েই দ্যাখ না। দুনিয়াটা কী মজার। রাস্তায় তোর মতো কত বেড়াল ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

মন খারাপ করে ঘরে চলে এসে জেনাসের মনে হল, সত্যি তো একটা বাড়ির ভেতর এত বড় হয়ে গেল ও। কিন্তু কখনও তো দেখল না বাইরের জগতটা কেমন। আর সত্যিই এ বাড়ির কেউ ওকে ভালোবাসে না। নইলে আজ ওর জন্মদিনটা সবাই এমন বেমালুম ভুলে গেল কী করে। ও বাড়ির বাইরে চলে গেলেও ওর কথা কেউ ভাববে না। অর্ণবাবু তো পড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকবে। মামণিও অফিস যাবে আর পাপা তার কাজে। এসব কথা ভাবতে ভাবতে অভিমানে জেনাসের মুখ ভারি হয়ে আসে।

ও ধীরে ধীরে ফ্ল্যাটের দরজার কাছে এসে বসে থাকে। এমন সময় বুয়া কী একটা দরকারে বাইরে যাওয়ার জন্য দরজা খুলতেই ও চুপিসারে বেরিয়ে আসে। এই সেই সিঁড়ি যেটা দিয়ে অনেক ছোটবেলায় ও নেমে গিয়েছিল। পাশেই লিফট। এটা দিয়ে পাপা ওকে নিয়ে এসছিলেন। এখন ও ধীরে ধীরে ওই সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল তারপর ধীর পায়ে অ্যাপার্টমেন্টের গেটের পিছন দিয়ে পাশের বিল্ডিংযের দিকে এগোতে লাগল। এর মধ্যে দেখল একটা গাড়ি এসে বাড়ির ভেতর ঢুকল। গাড়ি থেকে নেমে অর্ণবাবু আর নানু সোজা লিফটের দিকে এগিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস অর্ণ ওকে দেখেনি। অর্ণর জন্য একটু খারাপ লাগল জেনাসের। এ বাড়িতে ওই তো তার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। কিন্তু অভিমানে জেনাস অর্ণর পিছু পিছু গেল না। এখন অর্ণ বড় হয়েছে তার কত নতুন বন্ধু হয়েছে। প্রায়ই অন্য অ্যাপার্টমেন্টের ছেলেরা ওকে খেলতে যাওয়ার জন্য ডাকতে আসে। জেনাসের কথা ভাবার সময় কোথায় ওর। অভিমানী জেনাস পাশের বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ে।

এদিকে অর্ণবাবু স্কুল থেকে ফিরেই তো জেনাসকে ডাকছে। আজ ওর জন্মদিন। ওর জন্য চকলেট কিনে এনেছে।

কিন্তু কোথায় জেনাস। সারাবাড়ির কোথাও নেই। অর্ণ আর নানু তাড়াতাড়ি বাইরে বেরিয়ে সবার কাছে খোঁজ খোঁজ শুরু করলেন। সিকিউরিটি গার্ডরা কোনো সাদা বিড়ালকে দেখেনি।

অনেক খুঁজেও জেনাসকে না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরল অর্ণ। অর্ণর ফোন পেয়ে অফিসের মিটিং ফেলে রেখে চলে এলেন মামণি। পাপাও তাড়াতাড়ি ফিরে এলেন সব কথা শুনে। তারপর সবাই মিলে জেনাসকে খোঁজা শুরু করলেন। নানাভাই বললেন পুলিশে খবর দিতে। জেনাস হারিয়ে গেছে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়ার কথা ভাবছে সবাই। মামণি তো একটা কাগজে জেনাস হারিয়ে গেছে লিখে দেয়ালে পোস্টার দেওয়ার জন্য রেডি হলেন। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে।

এদিকে, জেনাস ততক্ষণে ভয়ে, ব্যথায় আধমরা। হয়েছে কী, ও তো পাশের বাড়ির সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠেছে। ও তারপর একটা ফ্ল্যাটের দরজা খোলা পেয়ে ভেতরে ঢুকে পড়েছে। সে বাড়ির লোকেরা খেয়াল করেনি ওকে। ওরা তখন মহাব্যস্ত। কারণ সাতদিনের জন্য কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছে সবাই। একটু পরেই ফ্ল্যাটের দরজা বাইরে থেকে তালা দিয়ে বাড়ির লোকরা সব বেরিয়ে পড়েছে। আর জেনাস ভয়ে একা অচেনা বাড়ির ভেতর ছুটোছুটি করছে। বাড়ির সব আলো নেভানো, সব ঘর অন্ধকার। জেনাস ভয়ে পাগল হয়ে ছুটছে। আর এটা-ওটার সঙ্গে ধাক্কা খাচ্ছে, মিউমিউ আওয়াজ করছে। কিন্তু কেউ শুনছে না ওর ডাক। অনেক দৌড়াদৌড়ির পর বারান্দার দিকে একটা জানালা খোলা পেয়ে জেনাস কোনোমতে গ্রিলের ফাঁক গলে বারান্দায় এসে পড়ল। কিন্তু বারান্দা থেকে ও বের হবে কী করে। ভয়ে বারান্দায় লাফঝাঁপ শুরু করল সে। লাভ তো কিছুই হল না মাঝখান থেকে গ্রিলে বাড়ি খেয়ে নাকটা কেটে রক্ত ঝরল খানিকটা, পায়েও একটু ব্যথা পেল। ভয়ে বারান্দার এককোণে বসে থরথর করে কাঁপছে জেনাস। খিদেও পেয়েছে খুব। কেন যে দুষ্টু বেড়ালটার কথা শুনতে গিয়েছিল ও। জেনাস যখন ভয়ে ভাবনায় মরোমরো তখন হঠাৎ শোনে কে যেন অনেক দূর থেকে ওর নাম ধরে ডাকছে।

সে কী, নানুর গলা না? জেনাস আবার মিউমিউ করে সাড়া দিল। হ্যাঁ, সত্যিই তো নানুর গলা। নানু, অর্ণ আর মামণি সবাই মিলে ওকে খুঁজছে আর বাড়িটার সামনে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ওকে ডাকছে। নানুই প্রথম শুনতে পেলেন জেনাসের মিউমিউ ডাক। সবাই এবার কানখাড়া করে রইল, নানু আবার ডাকলেন। সত্যিই ক্ষীণ কণ্ঠে বিড়ালের সাড়া পাওয়া গেল। কিন্তু কোথা থেকে আসছে এই ডাক। পাপা এবার টর্চ হাতে নিয়ে ডাক লক্ষ করে এগোতে লাগল। বাড়িটার পেছন দিকের গলিতে গিয়ে ওরা দেখল একটা বারান্দা থেকে যেন এই ডাক আসছে। নানু বারবার ডাকতে লাগলেন, “জেনাস।”

জেনাসের মিউমিউ কান্না শোনা গেল। এদিকে ওদের এ বাড়িতে ঢুকতে দেখে বাড়ির দারোয়ান এগিয়ে এল। সবশুনে দারোয়ান জানাল ও ফ্লাটের বাসিন্দারা কক্সবাজার গেছে সাতদিনের আগে ফিরবে না। সর্বনাশ এখন উপায়। সাতদিন তো দূরের কথা একদিন এখানে থাকলেই জেনাস ভয়ে মরে যাবে। কিন্তু দারোয়ান ভাড়াটেদের বাড়িতে বাইরের কাউকে ঢুকতে দিতে নারাজ। অবশ্য বেড়ালটার কান্না শোনা যাচ্ছে এটাও ঠিক। শেষ পর্যন্ত দারোয়ান বলল, পাপা যদি দোতলা বেয়ে উঠে ওকে বারান্দা থেকে নিতে পারে তাহলে তার কোনো আপত্তি নেই। কিন্তু খাড়া দেয়াল বেয়ে পাপা উঠবে কী করে?

পাপা এবার পাশে একটা বাড়িতে যেখানে নির্মাণ কাজ চলছিল সেখানকার শ্রমিকদের সাহায্য চাইলেন। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কিন্তু কাজ চলছিল। দুজন শ্রমিক কী হয়েছে দেখতে এলেন। শ্রমিকরা একটা মই নিয়ে এলেন। সেই মই বেয়ে দোতলার পাঁচিলের উপর ওঠা গেল। তারপর পাপা সরু দেয়ালের উপর দিয়ে খুব সাবধানে হেঁটে যেতে লাগলেন বারান্দার দিকে। সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে ওর কাণ্ডকারখানা দেখছিল। একটু পা ফসকালেই উঁচু দেয়ালের উপর থেকে পড়তে হবে। পাপা ধীরে ধীরে বারান্দার নিচের সানশেডে পৌঁছালেন। তারপর ওখানে দাঁড়িয়ে জেনাসকে ডাকলেন। জেনাস লাফ ঝাঁপ শুরু করল। পাপা কোনোমতে গ্রিলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে জেনাসকে তুলে নিলেন। তারপর ওকে কোলে নিয়ে খুব আস্তে আস্তে দেয়ালের উপর দিয়ে হেঁটে আসতে লাগলেন। জেনাস পাপার কোলের মধ্যে চুপ করে মাথা রেখে থরথর কাঁপছিল। পাপা মই বেয়ে নিচে নেমে আসতে সবাই ¯^স্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

জেনাসকে নিয়ে বাড়িতে ফিরতেই আনন্দের ধুম পড়ে গেল। নানাভাই সাবধানে ওর কেটে যাওয়া নাকে মলম লাগিয়ে দিলেন। আপু দুধ গরম করে নিয়ে এলেন একটা বাটিতে করে। আর মামণি সেই রাতেই দোকান থেকে কেক কিনে আনলেন। বেশ ঘটা করে জন্মদিন হল। জেনাস অর্ণবাবুর কোলে চড়ে লেজ নাড়তে লাগল। আরেকটু রাত হলে যখন সবার খাওয়া শেষ হল জেনাস এক ফাঁকে বারান্দায় গিয়ে পাশের বাসার বেড়ালটার দিকে তাকাল। দুষ্টু বেড়ালটা চুপ করে ওদের বারান্দায় বসে ছিল। এ বাড়িতে জেনাসের আদরের ঘটা দেখে ও ‘ফ্যাঁচ’ শব্দ করে নিজেদের ঘরে ঢুকে গেল।