মিশন নট ইমপসিবল

খুব মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনে হেডস্যার বললেন, “এটা তো খুবই ভালো প্রস্তাব। আপনি আপনার মতো করে কাজ শুরু করুন।

>> সুমন্ত আসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 August 2013, 12:08 PM
Updated : 29 August 2013, 12:13 PM

 বলতে পারেন এই জন্যই তো কারও কথা না শুনে আপনাকে চাকরিটা দিলাম। শুধু মনে রাখবেন, এই স্কুলে আমার কথাই সব, আমার কথাই আইন। আগের অঙ্কের শিক্ষককে আমি অল্পদিনের মধ্যেই চাকরিহারা করেছি। আমার স্কুলে থেকে আমার কথা শুনবে না! হতে পারে সে আমার চেয়ে বেশি শিক্ষিত। তাতে কী! আমি এই স্কুলের প্রধান শিক্ষক। পাঁচ-সাত বছর না, বার বছর ধরে এই স্কুলে আছি। নিজের ক্ষমতাবলেই আছি। কতজন এল গেল, কিন্তু আমি রয়ে গেছি এবং থাকব।”

সালন্দা উচ্চ বিদ্যালয়ের নতুন অঙ্কের শিক্ষক সালামত মুন্সী মুখটা হাসি হাসি করে বললেন, “আমি আপনার কথার একটুও বাইরে যাব না, স্যার। আপনি যা বলবেন সেটাই হবে আমার মূল দায়িত্ব।” হাত দুটো হেডস্যারের হাতের দিকে এগিয়ে দিয়ে, তারপর শক্ত করে চেপে ধরে বললেন, “স্যার, আপনি শুধু আমাকে দোয়া করবেন।”

মাথা ঝাঁকিয়ে হেডস্যার বললেন, “নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই...।”

লাইব্রেরি রুমের পাশে ছোট্ট একটা রুম আছে, সেখানে বসে আছেন সালামত মুন্সী স্যার। একটু পর পিয়ন একটা একটা করে ছাত্র পাঠাবে, তিনি তাদের সাধারণ জ্ঞান পরীক্ষা করবেন। ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেনের ছাত্রদের পরীক্ষা হবে। আজ ক্লাস সেভেনের পালা। ক্লাস সেভেনে সাতাশজন ছাত্র। প্রথমেই পিয়ন বজলু মিয়া রোল নম্বর সাতাশ সাদাতকে পাঠাল স্যারের রুমে। স্যার এভাবেই পাঠাতে বলেছেন, সাতাশ, ছাব্বিশ, পঁচিশ, সবশেষে রোল নম্বর এক। সবাই রুমের বাইরে বারান্দায় অপেক্ষা করছে।

স্যারের রুমে ঢুকে দরজার সামনে দাঁড়াল সাদাত। স্যার কিছুটা রূঢ় স্বরে বললেন, “রুমে ঢুকে যে স্যারকে সালাম দিতে হয়, এটা জানো না!”

“জানি, স্যার।”

“তাহলে সালাম দিলে না কেন?”

“খাওয়ার সময় সালাম দিতে নেই। আপনি মুড়ি খাচ্ছেন স্যার।”

কিছুটা বিব্রত হলেন সালামত মুন্সী স্যার। সকালে নাস্তা করার সময় পাননি। ছাত্রদের জন্য সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন রেডি করতে করতে সময় চলে গেছে। রুমে বসে তাই শুকনো মুড়ি খাচ্ছেন, সঙ্গে কাঁচামরিচ আর পিঁয়াজ।

স্যার এক মুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, বসো।”

সাদাত এগিয়ে গিয়ে স্যারের টেবিলের সামনের চেয়ারে বসতেই স্যার বললেন, “তোমরা তো জানো আমি তোমাদের নতুন অঙ্কের শিক্ষক। কিন্তু আমি তোমাদের সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা নেব আজ। তারপর অন্য একটা কাজ করব তোমাদের সবাইকে নিয়ে।”

“জি, স্যার।” সাদাত খুব ভদ্র ছেলের মতো বলল, “দুদিন আগে ক্লাসে নোটিশ দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন হেডস্যার, আপনি আজ আমাদের সাধারণ জ্ঞানের পরীক্ষা নেবেন।”

“প্রত্যেককে একটা করে প্রশ্ন করা হবে। উত্তর ভুল হোক কিংবা শুদ্ধ হোক, তাকে আর দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে না।” স্যার আরও এক মুঠো মুড়ি মুখে দিয়ে বললেন, “বলো তো, বিদ্যুৎ আবিস্কার না হলে কী হত?”

সাদাত একটু নড়ে চড়ে বসল। তারপর খুব নরম গলায় বলল, “মোমবাতি জ্বালিয়ে টিভি দেখতে হত আমাদের।”

সালামত স্যার সাদাতের উত্তর শুনে বিষম খেলেন। তার মুখ থেকে অনেকগুলো মুড়ি ছিটকে এল টেবিলে। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে তার। হাতের মুঠোতে মুড়ি ছিল স্যারের। সেগুলো মুখে না দিয়ে সামনের পাত্রে রেখে দিলেন আবার। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, “তুমি এখন যাও।”

সাদাত রুম থেকে বের হতে নিয়েই ঘুরে দাঁড়াল আবার। স্যারের দিকে মাথা উঁচু করে তাকিয়ে বলল, “আপনার ডান কাঁধে যে বিড়ালের বাচ্চা বসে আছে, বাচ্চাটা খুব সুন্দর!”

ঝট করে স্যার তার ডান কাঁধে হাত রাখলেন। জায়গাটা শূন্য। বাম কাঁধেও হাত রাখলেন। শূন্য। স্যার কিছুটা রেগে গিয়ে বললেন, “এই ছেলে, বিড়ালের বাচ্চা দেখলে কোথায় তুমি?”

“স্যার, আপনি না একটু আগে বললেন উত্তর ভুল হোক শুদ্ধ হোক একটাই প্রশ্ন করা হবে, দ্বিতীয় প্রশ্ন করা হবে না।”

স্যারের চোখ দুটো আরও বড় বড় করে দিয়ে সাদাত বের হয়ে এল রুম থেকে।

রোল নম্বর ছাব্বিশ মৃদুল কান্তিকে রুমে পাঠাল পিয়ন বজলু মিয়া। মৃদুল রুমে ঢুকেই সোজা স্যারের টেবিলের সামনের চেয়ারে গিয়ে বসল। সঙ্গে সঙ্গে স্যার বললেন, “চেয়ারে যে বসেছ, অনুমতি নিয়েছ?”

“স্যার...” মৃদুল চেয়ারটাতে ভালো করে বসে বলল, “এখানে চেয়ারটা তো রাখা হয়েছে বসার জন্যই। কেউ কেউ আবার চেয়ারে দাঁড়িয়ে খেলতে পছন্দ করে। কিন্তু চেয়ার তো দাঁড়ানোর জায়গা না। তাই কারও দাঁড়ানোর ইচ্ছে করলে অনুমতি নেওয়া প্রয়োজন। বসার জন্য অনুমতি নেওয়ার কোনো দরকার আছে কি? অনুমতি-টনুমতি চাওয়ার জন্য অযথা সময় নষ্ট হয়। বড়রা বলেন না, সময় নষ্ট করা বড্ড খারাপ কাজ।”

সালামত স্যার মুখ ভর্তি মুড়ি চিবুচ্ছিলেন। তিনি চিবানো বন্ধ করে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন মৃদুলের দিকে। মৃদুল সিরিয়াস ভঙ্গিতে বলল, “স্যার, প্রশ্ন করুন। বাইরে আরও পঁচিশ জন দাঁড়িয়ে আছে।”

কিছুটা চমকে উঠলেন স্যার। মুখে মুড়ি নিয়েই তিনি বললেন, “বলতে পারবে, মানুষ কোন কাজটা ঘুমের মধ্যেও করতে পারে?”

“বিছানায় শুয়ে থাকার কাজ।” ঝটপট উত্তর দিল মৃদুল।

চেহারা লাল হয়ে গেছে স্যারের, রেগে গেছেন তিনি। কিন্তু শান্ত গলায় মৃদুলকে বললেন, “ঠিক আছে, তুমি এখন যেতে পার।”

সাদাতের মতো মৃদুলও রুম থেকে বের হতে নিয়েই ঘুরে দাঁড়াল। স্যারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “স্যার, একটা বিড়ালের বাচ্চা বসে আছে আপনার ডান কাঁধে, খুব সুন্দর লাগছে বাচ্চাটা!” বলেই আর কোনো দিকে না তাকিয়ে রুম থেকে বের হয়ে এল মৃদুল। 

চব্বিশ নম্বর রোলের ইফতি রুমে ঢুকল তারপর। ওর হাতে একটা চানাচুরের প্যাকেট। চানাচুর খেতে খেতে স্যারের সামনে দাঁড়াতেই স্যার বললেন, “তুমি চানাচুর খাচ্ছ যে!”

“প্রশ্নটা তো আমারও, আপনি মুড়ি খাচ্ছেন যে!” চেয়ারে বসতে বসতে ইফতি বলল, “আসলে হয়েছে কী, শুনলাম আপনি শুধু মুড়ি খাচ্ছেন। বলতে পারেন, চানাচুরটা আপনার জন্য কিনে আনা।” স্যারের দিকে প্যাকেটটা এগিয়ে দিয়ে ইফতি বলল, “নিন স্যার, মুড়ির সঙ্গে মিশিয়ে খান, বহুত মজা পাবেন।”

স্যার প্যাকেটটা নিলেন না। হাতের মুঠোর মুড়িগুলো মুখে না দিয়ে সামনের পাত্রে রেখে বললেন, “কমলা আর আপেলের মধ্যে মূল পার্থক্যটা কী, বলো তো?”

“খুবই সহজ প্রশ্ন স্যার, কমলার রং কমলা, কিন্তু আপেলের রং আপেল না।”

মাথাটা হঠাৎ ঘুরে উঠল স্যারের। পরপর তিনটা ছেলেকে প্রশ্ন করলেন, তিনজনই উল্টাপাল্টা উত্তর দিল।

কেন? কিছুই মাথায় আসছে না স্যারের। কথা বলতেও যেন ভুলে গেছেন তিনি। হাত দিয়ে ইশারা করে ইফতিকে চলে যেতে বললেন।

ইফতি চলে যেতে নিয়েই ঘুরে দাঁড়াল। স্যারের দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “স্যার, আপনার ডান কাঁধে যে বিড়ালের বাচ্চাটা বসে আছে, ওর লেজটা দেখতে কী সুন্দর! বাচ্চাটাও সুন্দর!”

রুম থেকে বের হয়ে এল ইফতি। মাথাটা আগের চেয়েও জোরে ঘুরে উঠল স্যারের। তিনি তার দুকাঁধই দুহাত দিয়ে একসঙ্গে দেখতে লাগলেন। বিড়ালের বাচ্চা তো দূরের কথা, একটা মশাও নেই সেখানে।

রোল নম্বর তেইশ অনুপস্থিত, জ্বর এসেছে তার। বাইশ নম্বর রোল হচ্ছে তপুর। তপু বেশ তোতলা। স্যারের রুমে ঢুকতেই স্যার বললেন, “রুমে ঢুকতে দেরি করলে কেন?”

“বদ... বদ... বদ...।” তোতলাতে শুরু করে তপু।

“কী! আমি বদ?” রেগে চিৎকার করে বললেন স্যার।

“না, আসলে আমার বদহজম হয়েছে তো। এতক্ষণ তাই বা... বা... বা...” তপু তোতলাতে শুরু করে আবার।

“বাথরুমে ছিলে?”

“না, বাদামের খোসা খাচ্ছিলাম। বাদামের খোসা খেলে নাকি বদ... বদ... বদ...”

“বদহজম।”

“জি, বদহজম সেরে যায়।”

স্যার ভালো করে কিছুক্ষণ দেখলেন তপুকে। তারপর মুড়ির পাত্রে হাত দিতে নিয়েই থেমে গিয়ে বললেন, “বল তো, পৃথিবীর সবচেয়ে পুরনো প্রাণী কোনটি?”

“জেব্রা, স্যার। কারণ জেব্রা এখনও সাদা-কালোই আছে।”

ইফতির কথা শুনে মাথা ঘুরে উঠেছিল স্যারের; তপুর কথা শুনে মাথা না, সমস্ত রুমটাই ঘুরতে লাগল তার চোখের সামনে। তিনি স্পষ্ট দেখতে পেলেন, রুমের সবকিছু চারপাশে ঘুরছে। ভনভন শব্দও হচ্ছে। আগের মতোই ইশারা করলেন স্যার তপুকে।

তপু সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল না চেয়ার থেকে। স্যারের দিকে একটু ঝুঁকে বসে বলল, “স্যার, আমি অনেক পশুপাখিকে ভালোবাসা মানুষ দেখেছি। কিন্তু আপনার মতো কাউকে দেখিনি। আপনি একটা বিড়ালের বাচ্চাকে আপনার ডান কাঁধে বসিয়ে রেখেছেন। কী সুন্দর যে লাগছে বাচ্চাটাকে দেখতে!”

চোখে প্রচণ্ড পাওয়ারওয়ালা চশমা-পরা রাজনের রোল নম্বর হচ্ছে একুশ।

স্যার ওকে দেখে বললেন, “তুমি ঠিক মতো চোখে দেখ তো?”

“জি, স্যার। এই দরজার কাছে থেকেও ওই যে আপনার টেবিলে একটা পাত্র দেখতে পাচ্ছি, ওখানে বিড়ালের বাচ্চার জন্য যে সাদা দুধ রাখা আছে, সেটাও দেখতে পাচ্ছি।”

“সাদা দুধ পেলে কোথায়, এটা তো সাদা মুড়ি।”

স্যারের দিকে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারে বসে টেবিলের দিকে তাকাল রাজন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, “স্যরি, স্যার। মুড়িই তো।”

“তোমার নাম তো রাজন। আচ্ছা রাজন, তুমি ঠিকভাবে বল তো, একটা বাইসাইকেল আর একটা বাসের মধ্যে পার্থক্য কী?”

চোখ থেকে চশমাটা খুলে রাজন টেবিলে রাখল। তারপর বলল, “বাইসাইকেল তার স্ট্যান্ডটি সঙ্গে রাখে, কিন্তু বাস তার স্ট্যান্ডটিকে পেছনে ফেলে চলে যায়।”

স্যার এবার সত্যি সত্যি বোবা হয়ে গেলেন। হাত দিয়ে ইশারা করে রাজনকে রুম থেকে চলে যেতে বললেন স্যার। রাজন টেবিল থেকে চশমটা নিয়ে চোখে পুরতেই চমকে উঠল।

স্যারের দিকে ভালো করে তাকিয়ে বলল, “স্যার, একি! আপনার ডান কাঁধে বিড়ালের বাচ্চা কেন? এত সুন্দর বিড়ালের বাচ্চা কোথায় পেলেন আপনি?”

দুহাত দিয়ে মাথা চেপে ধরলেন স্যার। অনেকক্ষণ সেভাবে থাকার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, না, মাঝের আর কোনো ছেলেকে না, থার্ড, সেকেন্ড এবং ফার্স্ট বয়কে ডেকেই আজকের পরীক্ষা শেষ করবেন। এবং তিনজনকে একসঙ্গে ডাকবেন, একই প্রশ্ন করবেন। স্যার দেখবেন, তিনজন একই ধরনের উত্তর দেয়, না ভিন্ন ভিন্ন উত্তর দেয়।

পিয়ন বজলু মিয়াকে বলতেই, রোল নম্বর তিন মাথায় ঝাকড়া চুলের মিথুন, রোল নম্বর দুই অতিরিক্ত ফর্সা জুবায়ের এবং রোল নম্বর এক বোকা বোকা চেহারার সানতুরকে ভেতরে পাঠাল সে। ভেতরে ঢুকেই ওরা তিনজন একসঙ্গে সালাম দিল স্যারকে। হাতের মুঠোতে মুড়ি নিয়ে মুখে দিতে যাচ্ছিলেন স্যার, ওদের দেখে হাত ফিরিয়ে আনলেন। সামনের পাত্রতে মুড়িগুলো রেখে ইশারা করলেন। স্যারের টেবিলের সামনে চারটা চেয়ার, ওরা তিনজন তিনেটেতে গিয়ে বসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে ছিলেন স্যার, সোজা হলেন তিনি। তিনজনের দিকে ভালো করে তাকিয়ে কী যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর খুক করে কেশে বললেন, “আমি তোমাদের তিনজনকে একটাই প্রশ্ন করব। তোমরা একে একে সেটার উত্তর দেবে।” স্যার একটু থামলেন, আবার একটু খুক করে কেশে বললেন, “বল তো, আলো আর শব্দের মধ্যে কোনটির গতি বেশি?” স্যার মিথুনের দিকে তাকালেন, “প্রথমে তুমি বলো, মিথুন।”

“অবশ্যই আলোর।”

“একটু বুঝিয়ে বলতে পারবে?”

“আমি যখন রেডিও অন করি, তখন প্রথমে আলো জ্বলে, তারপর শব্দ কানে আসে।” চেহারা হাসি হাসি করে মিথুন বলল।

রাগতে গিয়েও থেমে গেলেন স্যার। কিছুটা আড়চোখে জুবায়েরের দিকে তাকালেন। স্যার জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলল, “মিথুনের সঙ্গে আমি একমত। অবশ্যই আলোর গতি বেশি। এটা আমি জানলাম কী করে-- আমি যখন টিভি অন করি, তখন আগে আলো দেখতে পাই, পরে শব্দ শুনতে পাই।”

চোখ বড় বড় করে ফেললেন স্যার। তিনি বুঝতে পারলেন না, কঠিন কোনো প্রশ্ন করেছেন কি না, না ছাত্ররাই বোকা! মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি, প্রশ্নটাকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করবেন তিনি।

সানতুরের দিকে তাকালেন স্যার, “সানতুর, মনে কর, একটা পাহাড়ের উপর দাঁড়িয়ে আছ তুমি। সামনের আরেকটা পাহাড়ে একটা কামান রাখা আছে। সেই কামান থেকে একটা গোলা ছোড়া হল। তুমি প্রথমে কামানের মাথায় আগুন দেখবে, না কামানের গোলার শব্দ শুনবে?”

সানতুর মেরুদণ্ড সোজা করে বসে বলল, “অবশ্যই কামানের মাথায় আগুন দেখব।”

স্যার খুশি হলেন সানতুরের উত্তর শুনে, “একটু বুঝিয়ে বলতে পারবে?”

“অবশ্যই স্যার।” সানতুর খুব আগ্রহ নিয়ে বলল, “আমার চোখ দুটো আমার কান দুটোর চেয়ে অপেক্ষাকৃত সামনে বলে আমি আগে আলো দেখতে পাব।”

সত্যি সত্যি এবার রেগে গেলেন স্যার। তিনজনকে একসঙ্গে ধমক দিতে গিয়েই শান্ত হয়ে গেলেন। বিড়বিড় করতে লাগলেন, কিন্তু স্পষ্ট করে কিছু বললেন না। আগের মতোই হাত দিয়ে ইশারা করলেন ওদের।

রুম থেকে বের হয়ে আসছিল ওরা। জুবায়ের হঠাৎ ঘুরে দাঁড়াল। স্যারের দিকে ভালো করে তাকিয়ে মিথুনকে বলল, “স্যারের কাঁধে ওটা কী, বল তো?”

মিথুন অতি উৎসাহ নিয়ে বলল, “আরে, ওটা তো বিড়ালের বাচ্চা।”

সানতুর পেছন থেকে সামনে এল, “সত্যি তো একটা বিড়ালের বাচ্চা বসে আছে স্যারের কাঁধে। দেখেছিস, বাচ্চাটা কী নাদুস-নুদুস!”

“দেখতেও কী সুন্দর!” জুবায়ের স্যারের দিকে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “স্যার, এত ছোট বিড়ালের বাচ্চা পেলেন কোথায় আপনি? বাচ্চাটা কী সুন্দর করে বসে আছে আপনার কাঁধে! স্যার, ও একা একা দুধ খেতে পারে তো?”

“ও কি গরুর দুধ খায়, না গুঁড়ো দুধ গুলিয়ে খাওয়ানো হয় ওকে?” মিথুন জিজ্ঞেস করল।

“একা একা দুধ খেতে পারে ও, না ফিডারে করে খায়?” স্যারের দিকে আরও একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে জুবায়ের বলল।

“তোরা যাই বলিস...” সানতুর হাসতে হাসতে বলল, “স্যারের শখ আছে বলা যায়। কী সুন্দর একটা বিড়ালের বাচ্চাকে বসিয়ে রেখেছেন কাঁধে!”

রুম থেকে বের হয়ে এল তিনজনই। স্যার ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। পাশের বাথরুমে ঢুকলেন দ্রুত। সেখানে একটা আয়না আছে। আয়নার দিকে তাকালেন ভালো করে। এদিক-ওদিক দেখলেন সময় নিয়ে। কোনো বিড়ালের বাচ্চা তো দূরের কথা, ছোট একটা পিঁপড়াও দেখতে পেলেন না সেখানে। আরও কিছুক্ষণ আয়নার সামনে কাটিয়ে যেই না রুম থেকে বের হয়ে স্কুলের বারান্দায় এলেন, সঙ্গে সঙ্গে ক্লাস নাইনের সৌরভ স্যারকে দেখে বলল, “স্যার, আপনার কাঁধের বিড়ালের বাচ্চাটা তো ঘুমিয়ে পরেছে। ওটা পড়ে যাবে! হাত দিয়ে চেপে ধরে কোলের কাছে আনুন।”

সৌরভ পাশ কেটে চলে যেতেই স্যার আনমনে কাঁধে হাত রাখলেন আবার। না, ওখানে কিচ্ছু নেই, একেবারেই নেই। একা একা মাথা ঝাঁকাতে লাগলেন তিনি এবং সেভাবে মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে হেডস্যারের রুমে ঢুকে হেডস্যারকে বললেন, “স্যার, দেখুন তো, আমার কাঁধে কোনো বিড়ালের বাচ্চা বসে আছে কি না?”

চোখ বড় বড় করে অঙ্ক স্যারের দিকে তাকালেন হেডস্যার। চেহরাটা আস্তে আস্তে রাগে ভরে যাচ্ছে তার। বেশ কিছুক্ষণ সেভাবে তাকিয়ে থাকার পর তিনি বললেন, “মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার। যান, স্কুলের মাঠের কোণায় যে টিউবওয়েলটা আছে, ওটার পানি খুব ঠাণ্ডা। মাথায় কমপক্ষে আধঘণ্টা ওই ঠাণ্ডা পানি ঢালুন।”

সালামত মুন্সী স্যার হেডস্যারের রুম থেকে বের হয়ে টিউবওয়েলটার দিকে চলে গেলেন সোজা। তারপর টিউবওয়েল টিপে মাথায় পানি দিতে লাগলেন খুব যত্ন করে। পুরো আধঘণ্টা মাথায় পানি দেওয়ার পর তিনি খেয়াল করলেন, সারা স্কুলের সব ছাত্র ক্লাস ছেড়ে বারান্দায় চলে এসেছে। তারা অধীর আগ্রহে প্রচণ্ড আনন্দ নিয়ে মাথায় পানি দেওয়া দেখছে তার। টিচার্স রুম থেকে সব স্যারও বের হয়ে এসেছেন বারান্দায়। সবাই হাসছেন। কেবল হেডস্যার মুখটা গম্ভীর করে রেখেছেন।

ক্লাস টেনের থার্ডবয় রাজন টিউবওয়েলের দিকে এগিয়ে গিয়ে সালামতস্যারের পাশে দাঁড়াল। তারপর চোখ দুটো বড় বড় করে স্যারকে বলল, “স্যার, আপনি মাথায় পানি দিচ্ছেন, কিন্তু আপনার কাঁধের বিড়ালের বাচ্চাটা তো ভিজে গেছে। ওইটুকুন বাচ্চা, মারা যাবে তো। কী সর্বনাশ!”

সালামতস্যার ভেজা মাথায় হেডস্যারের সামনে চলে এলেন। কাতর মুখে তার দিকে তাকিয়ে বললেন, “স্যার, সত্যি করে বলুন তো, আমার কাঁধের বিড়ালের বাচ্চাটি কি ভিজে গেছে?”

সঙ্গে সঙ্গে হেডস্যার ধমক দিয়ে বললেন, “যান, আপনি আরও আধঘণ্টা পানি ঢালুন মাথায়।”

সালামত স্যার তার পরের দিন থেকে স্কুলে আসেননি আর। সেদিন মাঝরাতে হেডস্যারের বাসায় নাকি ছুটে গিয়েছিলেন অঙ্কস্যার। চিৎকার করে বলেছিলেন, “স্যার, আমি ঘুমাতে পারছি না। ঘুমাতে গেলেই কাঁধের বিড়ালের বাচ্চাটা খামচাচ্ছে আমাকে। ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছে স্যার। কী যে করি! আমাকে বাঁচান স্যার।”

পরদিনই হেডস্যার স্কুলে এসে সালামত স্যারকে বিদায় করে দিয়েছিলেন। তিনি নাকি পাগল হয়ে গেছেন। একটা পাগলকে স্কুলে রাখা ঠিক হবে না বলে তার গ্রামের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তাকে।

স্কুলের কোণার দেয়ালের উপর বসে আছে মিথুন, তপু, মৃদুল, সাদাত, ইফতি, জুবায়ের, সানতুর। বেশ শব্দ করে পা নাচাচ্ছে মৃদুল। সবার চেহারা হাসি হাসি। সানতুর একটু সোজা হয়ে বসে বলল, “আমরা প্রথমে আন্তরিকভাবে তপুকে একটা ধন্যবাদ দিতে পারি। ওর বুদ্ধিতেই ওই নতুন অঙ্কস্যারকে তাড়ানো গেছে।”

“ধন্যবাদ দেওয়ার আগে চল, ওকে আমরা দাঁড়িয়ে এক মিনিট ধরে একটা সালাম দেই।” দেয়ালের উপর থেকে ধপাস করে নেমে, কপালে হাত রেখে সাদাত বলল, “ঠিক এভাবে, ওই যে গার্ড অব অনার দেওয়ার মতো।”

“খুবই ভালো প্রস্তাব।” ইফতি সমর্থন করল।

“ওটা একটু পরে দেই। আগে একটু কথা বলে নেই।” মৃদুল পা নাচানো থামিয়ে বলল, “হেডস্যারের একটা বদনাম আছে। উনি নিজের আত্মীয়-স্বজন দিয়ে স্কুল ভরে ফেলছেন। সেই মানুষটা পড়াতে পারুক কিংবা না পারুক, চাকরি দিয়ে দেন স্কুলে।

“এটা খুবই খারাপ একটা কাজ।” জুবায়ের প্রতিবাদী ভঙ্গিতে বলল, “আমাদের কয়েকজন স্যার নাকি পড়াতেই পারেন না। তারা সবাই হেডস্যারের আত্মীয়-স্বজন।”

“এতে করে আমাদের লেখাপড়ার মান খারাপ হচ্ছে।” মন খারাপ করে বলল সানতুর।

“অথচ আমাদের আগের অঙ্কস্যার কত ভালো। হেডস্যারের সঙ্গে উনার কী হয়েছে, আর তাই উনাকে স্কুল থেকে তাড়াতে উঠে পড়ে লেগেছেন!” তপু রাগী রাগী চেহারা করে বলল, “খুবই খারাপ কথা!”

“এটা ভেবে খুব ভালো লাগছে, তপুর এই আইডিয়াটার কথা আমরা ক্লাস এইট, নাইন, টেনের ভাইয়াদের বলেছিলাম। ক্লাস সিক্সের ছেলেদেরও বলেছিলাম। সবাই সাপোর্ট করেছিল আমাদের। সেই অনুযায়ী কাজও করেছে।” জুবায়ের বলল।

“নতুন অঙ্ক স্যারও শেষপর্যন্ত বিশ্বাস করে ফেলেছিলেন, তার কাঁধে সত্যি সত্যি একটা বিড়ালের বাচ্চা আছে।” তপুর পিঠে একটা হাত রেখে সানতুর বলল, “চমৎকার একটা আইডিয়া দিয়েছিলি, দোস্ত। আমরা সফল, একশ পার্সেন্ট সফল। কিন্তু কোনো স্যারই জানলেন না, কাজটা আমরা করলাম, আমাদের বুদ্ধিতে হয়েছে।”

চমকে উঠল সবাই হঠাৎ। সামনের রাস্তা দিয়ে স্কুলের দিকে যাচ্ছেন রাহাতস্যার, ওদের আগের অঙ্কস্যার। ওদের দেখেই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। এগিয়ে এলেন ওদের দিকে। দেয়াল থেকে সবাই নেমে পড়ল একসঙ্গে। স্যার সবার দিকে একপলক তাকিয়ে চেহারা ম্লান করে বললেন, “কাজটা তোমরা না করলেই পারতে। আমি না হয় এ স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে যেতাম, কোনো সমস্যা হত না আমার।”

“কিন্তু আমাদের হত।” সানতুর স্যারের দিকে একটু এগিয়ে গিয়ে বলল, “আমরা আপনার মতো একজন স্যার কোথায় পেতাম, যিনি সন্তানের মতো তার প্রতিটি ছাত্রকে অঙ্ক শেখান।”

রাহাত স্যার কোনো জবাব দিলেন না। ঘুরে দাঁড়ালেন স্কুলের দিকে। মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার মতো মূল্যবান আর কিছু নেই। চোখ দুটো শিরশির করছে তার। চোখের জল লুকোতে হাত রাখলেন তিনি দুচোখে। পেছন থেকে একজন ডাক দিল, “স্যার?”

কথাটা শুনেও না শোনার ভান করলেন স্যার। স্কুলের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন তিনি দ্রুত পায়ে।