সূর্য হল চুরি

বিকেলবেলা ধীরে ধীরে আকাশে সাঁতার কাটছে সূর্য। হঠাৎ এল এক ঝাঁক মেঘ- ঘিরে ফেলল সূর্যটাকে। গাছের তলায় ঝোপের ভেতর খরগোশের ঘর। ঘরের দুয়ার খুলে বাইরে উঁকি দিল সে। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে বলেই ফেলল, “আহ, কী অন্ধকার! কোথায় গেল সূর্যটা?”

>> মাহবুব সাদিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 August 2013, 12:04 PM
Updated : 26 August 2013, 12:06 PM

ছাতারে পাখির দল চরছিল মাঠে আর শুধু শুধু চেঁচাচ্ছিল। আকাশের দিকে তাকাল তারা। তারপর পাহাড় আর মাঠের দিকে গলা বাড়িয়ে খবর দিল বক আর সারসদের, “শোনো সবাই, শোনো। সূর্যটাকে গিলে ফেলেছে কুমির।”

সবাই শুনল খবরটা। তখন ঘন আঁধার নেমে এসেছে চারপাশে। কিচ্ছু দেখা যায় না কোথাও। পথে যারা ছিল, ডুবল তারা আঁধারে। আর দেখাই গেল না তাদের। কে আর কী করবে?

ছিটকির ডালে বসে ছোট্ট চুই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ভয়ে। সে কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তখনও তার রাতের খাওয়া সারা হয়নি। দুঃখে সে ফিসফিস করল, “কিছু তো দেখছি না। দানা খুঁটব কী করে? বেরিয়ে এসো সূর্য। বাঁচাও আমাদের।”

কাঁদল খরগোশরাও। তারা তো আবার সারাক্ষণ লাফায়-ঝাঁপায়। বাসা থেকে তারা চলে এসেছে অনেক দূরে। কিন্তু এখন তো পথই দেখা যাচ্ছে না। ঘরে ফিরবে কী করে?

শুধু ফোলা চোখের চিংড়িরা ঘন আঁধার জলের তলায় লাফ-ঝাঁপ করছে। আর নেকড়েরা পাহাড়ের ওপারে আকাশের দিকে মুখ করে ডাক ছাড়ছে সমান তালে।

ফিকে অন্ধকারে তখন মাঠঘাট ঢাকা। শোনা গেল কার তীক্ষ্ণ চিৎকার, “র‌্যাট-ট্যাট-ট্যাট। ওখানে আবার কে রে?”

গেটের বাইরে ডাক ছাড়ছে বিশাল দুই ভেড়া। ইয়া বড় তাদের বাঁকানো শিং। তারা বলছে, “এসো তোমরা, মানুষেরা। সবাই এসো, একটুও দেরি কর না। লড়তে হবে বীরের মতো। কুমিরের গ্রাস থেকে বাঁচাতে হবে সূর্যকে।”

কিন্তু এল না কেউ। ভয় পেয়েছে সবাই। কী বিশাল হা কুমিরের; আর দাঁত! আর ওজনও কত, তিন টনের কম নয়। সে কি আর সূর্যকে ফেরত দেবে?

দুই ভেড়া গেল ভালুকের ডেরায়। ডাকল তাদের, “শিগগির এসো ভাই ভালুক, নষ্ট করার মতো সময় নেই। আলসের হাড্ডি, এসো দ্রুত। থাবা চাটা বন্ধ কর। সাহায্য কর আমাদের, সূর্যকে ছাড়িয়ে আনি কুমিরের গ্রাস থেকে।”

বিশাল আর শক্তিশালী হলে কী হয়, ভালুক লড়তে চায় না। সে গর্জন করল আর চেঁচাল সমানে। তার বাচ্চারা ঘাসবনে আটকা পড়েছে অন্ধকারে। সে খুঁজছে তাদের, “কোথায় গেলি রে ছোঁড়ার দল। বাসায় ফিরে আয়।”

কাঁদল ভালুক আর খুঁজল এখানে-সেখানে। ভালুক-মা ব্যাকুল হয়ে খুঁজছে গাছের তলায়, শিকড়ের ফাঁকে আর পাথরের খাঁজে--

“ওরে আমার পাগলা পুটো প্রান্টু এবং টেডি

কোথায় তোরা গেলি ওরে পরাণ-কাড়া এডি?

পড়লি কোথাও খাদে নাকি ডুবলি জলের তলে

নাকি তোদের পাগলা কুকুর কামড়াল কোন ছলে?”

ভালুক-মা ছেলেদের খুঁজল সারাদিন, জলা আর জঙ্গলে। কিন্তু খোঁজ নেই তাদের। শুধু পেঁচারাই মুখ বাড়াল খোঁড়ল থেকে। তারা বসে আছে উঁচু গাছের উঁচু ডালে।

দেখেশুনে রেগে গেল ভালুক-মা। ফেটে পড়ল সে ভালুকের সামনে, “থামাও তোমার কুঁই-কুঁই কাঁদুনি আর প্যানপ্যানানি-ঘ্যানঘ্যানানি। সাহসী হও, হও একটা জোয়ান ভালুক। যাও এবার, বাঁকা পায়ের কুমির ধর। পেটাও তাকে। ভেঙে দাও ওর বিচ্ছিরি চোয়াল। ছিনিয়ে আনো সূর্যটাকে।  সূর্য ছাড়া পেলেই আঁধার পালাবে। রোদ হাসবে চারদিকে। তখন বাচ্চারা তোমাকে দেখত পাবে। ছুটে এসে বলবে, এই যে বাবা। এই যে আমরা।”

ভালুক তখন পেছনের দুপায়ে দাঁড়াল শক্ত হয়ে। আকাশমুখো গর্জন করল রাগের গলায়। তারপর দৌড়াল নদীর দিকে। কুমির তো সেখানেই তার ভয়ংকর চোয়ালের মধ্যে আটকে রেখেছে সূর্যটাকে। আমাদের সেই সোনালি সূর্য, চুরি-যাওয়া সেই প্রিয় সূর্যটা।

গুঁড়ি-মেরে ভালুক এগিয়ে গেল কুমিরের কাছে। জানো তো, ভালুক কাউকে ভয় করে না। সে বলল, “শোনো এবার, দুষ্টু বাঁকা কুমির। ফিরিয়ে দাও আমাদের সূর্য। নইলে পিটিয়ে তোমাকে নস্যি বানিয়ে উড়িয়ে দেব বাতাসে। পৃথিবী ঢেকে গেছে অন্ধকারে। কী ভেবেছ তুমি?”

শুনে পাজি কুমির হাসল শুধু। বলল, “ভাগ, নচ্ছার ভালুক। ভেগে যা তুই হোৎকা বেবুন। নয়তো আমি গবগবিয়ে গিলব তোদের চাঁদটাকেও।”

গর্জে উঠল ভালুক। বার করল তার ধারাল দাঁত আর বাঁকা নখ। তেড়ে গেল সে শত্রুর দিকে। ধরল সে কুমিরের লেজে আর চোয়ালে। বাঁকিয়ে আনল তাকে। কুমির হল দুভাঁজ। ভালুক বলল, “এবার বার কর সূর্যটাকে।”

ভয়ে কুমির চেঁচাল অনেক জোরে। হাঁ করল সে। তার পেট থেকে বেরিয়ে এল সূর্য। উঠে পড়ল আকাশের আরও উঁচুতে। উজ্জ্বল রোদ ছড়িয়ে পড়ল মাঠে মাঠে, উপত্যকা আর পাহাড়ে।

এসো, এসো সোনালি সূর্য। চিৎকার করে সূর্যকে স্বাগত জানাল সবাই। গান গেয়ে উঠল পাখিরা। নাচল খরগোশ, আনন্দে ডিগবাজি খেল।

আর তক্ষুনি ভালুকছানারা এগিয়ে এল বেড়ালছানার মতো হেলেদুলে। বাবা আর মাকে বলল, “এই যে আমরা।”

* বিদেশি কাহিনি অবলম্বনে