কাসিদা

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। ১৫-২০ বছর আগেও রমজানে সেহরির সময় শোনা যেত তাদের গলা-

>> আহমেদ রিয়াজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2013, 10:26 AM
Updated : 20 August 2013, 10:26 AM

এল রে দেখ ওই মাহে রমজান

জাগো রে মুসলমান।

অথবা

আমরা কাসিদাওয়ালা

যাই ডেকে যাই

ওঠ ওঠ মমিন

সেহরির সময় নাই।

রমজানে সেহরি খাওয়ার জন্য রোজাদারদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলা হত এভাবেই। ‘কাসিদা’র সুরে সুরে। এখন কাসিদার সেই আগের মতো জমক নেই, জাঁক হারিয়েছে সেই কবে। নেই আগের মতো কাসিদা গাওয়ার ধুম। নেই রোজাদারদের কাসিদার সুরে ঘুম ভাঙানোর তোড়জোড়। তবে কাসিদার ঐতিহ্য একাকার হয়ে মিশে রয়েছে ঢাকার পথে পথে। কারণ ঐতিহ্যটা যে কয়েকশ’ বছরের।

‘কাসিদা’ শব্দটি ফার্সি। অর্থ কবিতার ছন্দে প্রিয়জনের প্রশংসা করা। তবে এর মূল শব্দটি আরবি, ‘ক্বাসাদ’। এই ‘ক্বাসাদ’ বিবর্তিত হয়ে ফার্সিতে এসে হয়েছে ‘কাসিদা’।

কাসিদা গেয়ে রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর কাজটি সাধারণত তরুণরাই করত। উৎসবের আমেজে। মোগলদের হাত ধরে এ অঞ্চলে, মানে বাংলায় কাসিদার প্রবেশ। তখন কাসিদা লেখা হত ফার্সিতে। কারণ মোগলদের দরবার আর প্রশাসনিক ভাষা ছিল ফার্সি। পূর্ববঙ্গে কাসিদার প্রাচীনতম তথ্যটি পাওয়া যায় মির্জা নাথানের ‘বাহারিস্তান-ই-গায়বি’ গ্রন্থে। তিনি ছিলেন একজন মোগল সেনাপতি। ১৬০৮ সালে ইসলাম খান চিশতির সঙ্গে মোগল নৌবহরের সেনাপতি হিসেবে বঙ্গে এসেছিলেন নাথান। এক সামরিক অভিযানে গিয়েছিলেন যশোরে। তাঁর সেই যশোরের আস্তানায় সে সময় এক বিশাল আনন্দোৎসবের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানে কবিরা নিজেদের লেখা কবিতা বা কাসিদা পরিবেশন করেন। সবার অনুরোধে যশোরের আবহাওয়া নিয়ে স্বরচিত কাসিদা আবৃত্তি করেন কবি আগাহি।

রমজানে সেহরির সময় গাওয়ার জন্যই কেবল কাসিদা রচনা করা হত না। কোনো বিষয়ের প্রশংসা করেও কাসিদা রচনা করা হত। লেখা হত বিশেষ কোনো উৎসবকে আরও বেশি আনন্দময় করার জন্যও। প্রাক-ইসলামি যুগ থেকেই কাসিদার শুরু। তবে কাসিদার পরিচিতি আসে ‘কাসিদা বারদা’ থেকে। ইমাম আর বাসিরি এবং ইবনে আরাবির সংগ্রহ করা ধ্রুপদী কাসিদার সংকলন এটি।

কাসিদার একদম প্রাচীন যে রূপটি, যেটাকে বলা যায় কাসিদার ধ্রুপদী রূপ। সেটি মূলত এ রকম- যে কোনো একটি বিষয়কে কবিতার মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। কবিতার প্রতিটা লাইনে ছন্দ-অন্ত্যমিল থাকবে। আকারে পঞ্চাশ লাইনেরও বেশি হবে। কখনও কখনও ছাড়িয়ে যাবে একশ’ লাইনও। কাসিদার বিস্তার একশ’ লাইনেরও বেশি ছাড়িয়ে যাওয়ার এ রীতিটি মূলত পারস্যের কবিদের। আর যাই হোক, কাসিদার মূল উৎস তো পারস্য থেকেই। আরবের লেখক ইবনে কুতাইবাহ আরবি কাসিদাকে তিনটি অংশে বিভক্ত করেছেন। কাসিদা নিয়ে তিনি একটি বই লেখেন নবম শতকে; নাম- ‘কিতাব আল-শির ওয়া-আল-শুয়ারা’ বা ‘বুক অব পোয়েট্রি অ্যান্ড পোয়েটস’। এখানেই রয়েছে তাঁর নিজস্ব কাসিদার গঠনতত্ত্ব।

কাসিদার প্রথম অংশ হচ্ছে ‘নসিব’। শুরুটা হতো নস্টালজিক। পরের অংশ ‘তাখাল্লাস’। এখানেও নস্টালজিক বর্ণনা থাকত। আর এই নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন থেকেই বর্ণনা থাকত অভিযাত্রার। অভিযাত্রার এ অংশের নাম ‘রাহিল’। একই সঙ্গে গোষ্ঠীর জীবনযাত্রা, প্রকৃতির বর্ণনাও থাকত। আর কাসিদার শেষ অংশে থাকত উপদেশ বা মেসেজ। এই শেষ অংশেরও তিনটা ভাগ। প্রথমটুকু হচ্ছে গোষ্ঠীর গুণকীর্তন। এর নাম ‘ফাখর’। পরের অংশ হচ্ছে গোষ্ঠীর স্যাটায়ার। এর নাম ‘হিজা’। আর শেষটুকুতে থাকে কিছু নৈতিক বাণী। এর নাম ‘হিকাম’।

এদিকে দশম শতাব্দীতে ইরানের কবিদের লেখা কাসিদা ছিল বৈচিত্র্যময়। কারণ ওসব কাসিদা লেখা হত ভিন্ন ভিন্ন উদ্দেশ্যে। যেমন নাসির খসরুর কাসিদায় দর্শনতত্ত্ব, ঈশ্বরতত্ত্ব এবং নৈতিকতা মিলেমিশে একাকার। অন্যদিকে আভিসেন্নার কাসিদায় কেবল দর্শনতত্ত্বেরই অস্তিত্ব মেলে। সম্ভবত প্রথম ধরনটা হচ্ছে বসন্তের কবিতা। ফার্সিতে যাকে বলে ‘বাহারিয়াহ’। আর পরের ধরনটা ‘খাজানিয়াহ’। এটা হচ্ছে শরতের কবিতা। শুরুটা প্রকৃতির বর্ণনা দিয়েই হত। সঙ্গে মৌসুম, প্রাকৃতিক দৃশ্য অথবা মজার দৃশ্যকল্প থাকত। ‘তাখাল্লাস’ অংশে কবি নিজের লেখক নাম ধরেই শুরু করতেন। আর শেষ অংশে থাকত কেন কবিতাটা লেখা হয়েছে, সে উদ্দেশ্যের কথা।

পারস্যে মহাকাব্য রচিত হয়েছে অনেক। কবি ফিরদৌসির ‘শাহনামা’ তো দুনিয়াখ্যাত মহাকাব্য। তবে কাসিদা মহাকাব্যের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন। এই ধাঁচে প্রথম কবিতা লিখেছিলেন কবি রুদাকি। রুদাকির জন্ম ৮৫৮ সালে। ওই সময় বেশিরভাগ কাসিদাই ছিল প্রশস্তিগাথা। কিছু কিছু ছিল শোকগাথা। নীতিকথার ঘরানাতেও বেশ কিছু কাসিদা রচিত হয়েছিল। এসব কাসিদায় কখনও দর্শন কখনও আত্মজীবনীমূলক বক্তব্যও ছিল। ফার্সি কাসিদার বৈশিষ্ট্য হল এর অন্ত্যমিলে। পুরোটা কাসিদায় অন্ত্যমিল একই থাকবে। তবে মাত্রা ভিন্ন হতে পারে। গড়পড়তায় কাসিদার দৈর্ঘ্য ছিল ৬০-১০০ লাইন। ২০০ লাইনের বেশি দীর্ঘ কাসিদাও লেখা হত।

কাসিদার প্রথম দিকের কবিরা ছিলেন ফিরদৌসির সমসাময়িক। এদের মধ্যে উনসুরি (আনুমানিক মৃত্যু ১০৪৯), আসজাদি এবং ফাররোখির নাম উল্লেখযোগ্য। বলা হয়ে থাকে, গজনীর সুলতান মাহমুদের দরবারে যে ৪০০ কবি ছিলেন, তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ফাররোখি। কাজেই তখনকার ফার্সি ভাষায় সেরা কবিরাই কাসিদা লিখতেন। ফার্সি ভাষার দীর্ঘ ইতিহাসে প্রশস্তিগাথামূলক কাসিদা লিখেছেন অনেকে। তবে তাদের মধ্যে কবি আনভারিকে সর্বাগ্রে স্থান দেওয়া হয়। ওদিকে দার্শনিক কাসিদার লেখক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন নাসির খসরু। নাসির খসরু মারা যান ১০৮৮ সালের দিকে। আর নাসির খসরুর সমসাময়িক ছিলেন ওমর খৈয়াম। হ্যাঁ, রুবাই বা চতুষ্পদী কবিতার শ্রেষ্ঠ কবি ওমর খৈয়াম।

১৪ শতকে এসে গজলের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় কাসিদার। কাসিদার তুলনায় গজল জনপ্রিয় হতে থাকে। এর কারণও আছে। কাসিদার মতো গজল এত দীর্ঘতর নয়। তার উপর কাসিদার প্রথম অংশকে ঘষামাজা করেই গজল রচনা করতেন কবিরা। কাজটা খুব একটা কঠিনও নয়। কাসিদার প্রথম অংশে আরও কিছু দৃশ্যকল্প ঢুকিয়ে সঙ্গে আরও কিছু সুমিষ্ট শব্দ ব্যবহার করে গজল রচনা করা যায়। ফার্সিতে কাসিদার কদর যখন পড়তির দিকে, তখনই উর্দুতে এর চর্চা শুরু হয়। উর্দু কাসিদা মূলত স্তুতিমূলক। কখনও বা ব্যঙ্গাত্মক। তবে বেশিরভাগই কোনো বিশেষ উপলক্ষ ঘিরে রচিত। উর্দু কাসিদা গজলের চেয়ে আকার আয়তনে বড় হলেও, ছন্দের নিয়ম ঠিকঠাক মেনে চলে।

এ অঞ্চলের কাসিদার ধারক বাহক আদি ঢাকাবাসীরা, মানে পুরান ঢাকার লোকজন। মাহে রমজানই শুধু নয়, ঈদ-উল-ফিতর ও মহররম উপলক্ষেও কাসিদা রচনা করা হত এ অঞ্চলে। এই ঢাকাবাসীদের মধ্যে আবার দুটো দল। এক দলে ছিল ‘সুব্বাসি’ বা ‘সুখবাসী’। তারা নিজেদের মধ্যে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতির চর্চা করতেন। ঢাকার মোগল ঘরানার শেষ ধারক বাহক ছিলেন এই সুব্বাসিরা। নিজেদের মধ্যে উর্দু আর ফার্সি চর্চা করতেন। আরেকটি দল হচ্ছে ‘কুট্টি’। এরা কথা বলতেন বাংলার সঙ্গে উর্দু ও হিন্দি শব্দ মিশিয়ে। তাদের কাসিদার ভাষাও উর্দু ও ফার্সি। যদিও ঠিক কবে থেকে ঢাকায় কাসিদার শুরু, সে সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা যায়নি। মোগল আমল থেকে শুরু বলেই ধরে নেওয়া হয়। সায়লা পারভীনের লেখা ‘হারিয়ে যাওয়া কাসিদা’ বই থেকে জানা যায়, ঢাকার উর্দু রোড, কসাইটুলী, বকশীবাজার, হোসনি দালান ও বংশালে ভীষণ জনপ্রিয় ছিল কাসিদা। রমজানের সময় দলবেঁধে হেঁটে হেঁটে পাড়া-মহল্লায় কাসিদা গেয়ে শোনাতেন তরুণরা। তাদের হাতে থাকত হ্যাজাক বাতি আর কুকুরের উৎপাত থেকে বাঁচার জন্য লাঠি।

ঢাকায় গাওয়া কাসিদা কয়েক ধরনের। চাঁদ ওঠার খুশিতে গাওয়া হয় ‘চানরাতি আমাদ’। রমজান মাসকে স্বাগত জানিয়ে গাওয়া হয় ‘খুশ আমদেদ’ বা ‘সদা’। আর রমজানকে বিদায় জানিয়ে গাওয়া হয় ‘আল বিদা’। রমজানের প্রথম ১৫ দিন গাওয়া হয় ‘সদা’। আর শেষ ১৫ বা ১৪ দিন গাওয়া হয় ‘আল বিদা’। ঈদের পরদিন হয় বিখ্যাত ঈদ মিছিল। ওই ঈদ মিছিলে গাওয়া হয় কাসিদা ‘ঈদ মোবারক’।

সেহরির সময় রোজাদারদের ঘুম ভাঙানোর জন্য যে সব কাসিদা গাওয়া হয়, এগুলোর নির্দিষ্ট নিয়মনীতি নেই। এগুলোর অনেকগুলোই অনেক জনপ্রিয় গানের সুর অনুকরণে গাওয়া হয়।

অধ্যাপক মোহাম্মদ আবদুল কাইউমের লেখা ‘চকবাজারের কেতাবপট্টি’ থেকে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে কাসিদা প্রতিযোগিতার চল ছিল ঢাকায়। সে সময় কাসিদার জন্য ঢাকার প্রায় প্রত্যেক পাড়াতেই গড়ে উঠেছিল নিজস্ব দল। এ দলগুলোর উপর নির্ভর করত পাড়ার সম্মান। ঈদের পর মহল্লার সর্দারদের নিয়ে কাসিদার বিশেষ প্রতিযোগিতাও হত। থাকত পুরস্কার। বিজয়ী দল তাদের মহল্লার জন্য বয়ে আনত সম্মান।

এখনও পুরান ঢাকায় চলে কাসিদা প্রতিযোগিতা। ২০ রমজান থেকে শেষ রোজা পর্যন্ত একেক রাতে একেক মহল্লায় অনুষ্ঠিত হয় এ প্রতিযোগিতা। শুরু হয় রাত ১১টা থেকে। চলে সেহরি পর্যন্ত। প্রতিযোগিতার বিখ্যাত স্থান উর্দু রোড। এছাড়া হোসনি দালান, কসাইটুলি, খাজে দেওয়ান, বংশীবাজার, মিটফোর্ডসহ কয়েকটি মহল্লায় কাসিদা প্রতিযোগিতা চলে। স্বাধীনতার আগে প্রতিযোগিতা হত পুরান ঢাকার ৩০-৩১টি মহল্লায়। এখন মাত্র ১১টি মহল্লায় হয়।

কাসিদা গানের অনেক গুণী বিচারক আছেন। তাদের অনেকেই এক সময় ছিলেন বিখ্যাত কাসিদা গায়ক। তাদের অনেকেই এখন আর বেঁচে নেই। বিখ্যাত কাসিদা বিচারকদের মধ্যে এজাজ, হাফেজ জহুর, মাওলানা আবদুস সালাম, ক্বারি সামসুল হক, মাওলানা আবু তাহের, আইয়ুব কাওয়াল, মাওলানা বশির আহমেদ, হাজী ফুরকান আহমেদ উল্লেখযোগ্য। আর কাসিদা গায়কদের মধ্যে বিখ্যাত কয়েকজন হচ্ছেন- জুম্মন মিয়া, মঞ্জুর আলম, আবদুস সামাদ, মানিক চাঁন, সৈয়দ ফাসীহ হোসেন।

এখনও রমজানে মধ্যরাতে পুরান ঢাকায় গেলে আপনার কানে হয়তো ভেসে আসবে-

পরোয়ারদিগারে আলম যাতা হে মাহে আকরাম

ফুরকতেছ মাহে দিকে হ্যায় আব কাহা দম

অর্থাৎ

দুনিয়ার প্রতিপালক, চলে যাচ্ছে মাহে আকরাম

চলে যাচ্ছে মাহে রমজান, এখন আর দুঃখ কোথায়?

তাই তো। এখন আর দুঃখ কোথায়? রমজান শেষ। ঈদের আনন্দ। আনন্দের ঈদ।