আকালুর অদ্ভুত ক্ষমতা

গাঁয়ে যত ভূত আর অদ্ভুত সব জিনিস আছে, সেসবের খোঁজ আকালুর মতো কেউ জানে না। এর প্রধান কারণ হল গাঁয়ের সঙ্গে আকালুর মাখামাখি জীবন। তার বাবা আকালের সময় কাজের খোঁজে শহরে গেছে। আর ফেরেনি। সেই তখন থেকেই ছোট আকালু সংসারের হাল ধরেছে।

>> মঞ্জু সরকারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 August 2013, 11:19 AM
Updated : 18 August 2013, 11:19 AM

মা ও ছোট ভাইবোন দুটির খাবার জোটাতে গ্রামেই ঘুরে বেড়ায় সারাদিন। তার বাবা ছিল ক্ষেতের কামলা, আর আকালুকে কেউ কেউ ‘ক্ষ্যাত’ বলেও খেপায়। আকালের সময় জন্ম হয়েছে বলে এ গ্রামে বুড়ো আকালু আরও একজন আছে। আকালুকে তাই ছোট আকালুও ডাকে কেউ কেউ।

আকালুর সমবয়সী ছেলেরা গ্রাম পেরিয়ে হাইস্কুলে যায়, পাকা রাস্তায় শহরে যাওয়ার বাস এবং বাজারে শহুরে কত কী জিনিস দেখে! কিন্তু স্কুল ছাড়ার পর আকালু এখন দিনমান হয় বাড়িতে, নয়তো ফসলের মাঠে কাজ করে। কোন ক্ষেতে কেমন ধান হয়, ধানের ফাঁকে কী ঘাস গজায়, কোন ঘাসের কাণ্ড আঁখের মতো মিষ্টি হয়-- আকালু অভিজ্ঞ চাষির মতো ভালো জানে।

ক্ষেতের কাজ ভালো পারে বলে এখন সে বড়দের সমান মজুরি পায়। চাষের কাজের বাইরে গাঁয়ের খালেবিলে মাছ ধরাটা আকালুর বড় নেশা। বিলের পানিতে মাছ ছাড়াও অদ্ভুত যত জীব আছে, সেগুলির খবর আকালুই জানে ভালো। একটা রাক্ষুসে গজার মাছের তিনটি চোখ একমাত্র আকালুই দেখেছে।

এক কালে, কালিসাঁঝে কিংবা অমাবস্যার রাতে গ্রামের গাছগুলোতে এবং বিলের জলেও কত রকম ভূত-প্রেত নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত। গাঁয়ের লোকেরা সবাই স্বচক্ষে না দেখুক, তেনাদের গল্প প্রত্যেকেই জানে। রাতবিরাতে আকালু বিলে মাছ ধরতে গিয়ে সেই পুরনো আমলের একজনকে নিজের চোখেও দেখেছে। এছাড়া শেয়ালের গর্তে খরগোশের বাচ্চা, পাখির বাসায় সাপÑ এ রকম নানা অদ্ভুত ও ভয়ঙ্কর জিনিস আকালু যত দেখে এবং জানে, গাঁয়ের আর কোন ছেলে তত জানে না। এ কারণে অদ্ভুত জিনিসের গল্প শোনার মানুষ অনেক দেখেছে। আকালুর কাছে এসব গল্প শোনার জন্য তার স্কুলপড়ুয়া বন্ধুরাও সময় পেলেই আকালুকে ঘিরে ধরে। কিন্তু আকালু গল্পগুজব করার মতো সময় পায় কম।

একদিন বিকেলে বাড়ির একমাত্র গরুটার ঘাস কাটার জন্য কাস্তে নিড়ানি নিয়ে ক্ষেতের আল ধরে হাঁটার সময় মোমেন চেঁচিয়ে ডাকে, “এই আকালু, একটা আশ্চর্য জিনিস দেখে যা।”

যত কাজই থাক, আশ্চর্য কিছু দেখার নেশা ছাড়তে পারে না আকালু। সে এগিয়ে যায়। মোমেনের হাতে ছোট একটি যন্ত্র। আকালু দেখেই চিনতে পারে, মোবাইল ফোন। প্রতিদিনই কত মানুষের হাতে এবং কানে নিয়ে কথা বলতেও দেখেছে। কিন্তু মোমেন পেল কোথায়? ওর বাপেরও তো নেই।

আকালু জিজ্ঞেস করল, “এটা সত্যি মোবাইল, নাকি খেলনা রে?”

মোমেন রেগে জবাব দিল, “খেলনা মোবাইল এরকম? এটা দুলাভাই বুবুকে কিনে দিয়েছে, আমি বুবুর কাছ থেকে নিয়েছি।”

“কোথায় ফোন করবি তুই?”

“এটা দিয়ে তুই ঢাকায়, শুধু ঢাকার না, দুনিয়ার যে কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলতে পারবি। খালি নাম্বারটা জানতে হবে। আর দুলাভাইয়ের নাম্বার তো সেভ করাই আছে, খালি একটা টিপলেই হল।”

আকালু মোমেনের হাতের জিনিসটার দিকে তাকিয়ে থাকে। মোবাইল কীভাবে চালাতে হয়, কীভাবে কাকে ফোন করবে, আর কীভাবে ফোন আসবে, কিছুই জানে না সে। মোমেনের কথা বিশ্বাস করবে কিনা বুঝতে পারে না। কিন্তু আকালুকে বিশ্বাস করাতেই যেন, হঠাৎ মোমেনর হাতে মোবাইলটা জ্বলে ওঠে এবং বাজতে থাকে। মোমেন মোবাইল কানে নিয়ে কথা বলতে থাকলে আকালু না শুনেও বুঝতে পারে, ঢাকা থেকে ওর দুলাভাই ফোন করেছে।

আকালুকে বিশ্বাস করানোর জন্য মোমেন ফোনটা আকালুর কানে চেপে ধরে বলে, “নে, আমার দুলাভাইয়ের সঙ্গে একটু কথা বল।”

আকালু ফোনটা কানে চেঁপে কাঁপা কণ্ঠে বলে, “হ্যালো।”

মোমেনের দুলাভাই জানতে চায়, “তুমি কি মোমেনের লগে স্কুলে পড়?”

আকালু জবাব দেয়, “না, আমি কাম করি।”

“কী কাম?”

“ক্ষেতের কাম।”

মোমেনের দুলাভাই বলে, “কামকাজ করা ভালো। তোমাদের গ্রামটা খুব সুন্দর। এবার শ্বশুরবাড়ি গেলে তোমার সঙ্গেও কথা হবে। ফোনটা মোমেনকে দাও।”

মোমেনের দুলাভাইকে তো আকালু দু-একবার দেখেছে, কিন্তু কথা হয়নি কখনও। তবে মোমেনের কাছে দুলাভাইয়ের গল্প শুনেছে মেলা। ঢাকায় হাউজিং কোম্পানিতে চাকরি করে। কোম্পানি তাকে থাকার জন্য একটি বাড়ি দিলেই নতুন বউকে ঢাকায় নিয়ে যাবে। তখন মোমেনও বোনের সঙ্গে ঢাকায় যাবে, সেখানেই পড়বে। বোনের সঙ্গে মোমেনের ঢাকা যাওয়ার স্বপ্নটা যে পাকা, সেটা তো বোনের মোবাইল ফোন হাতে তার ঘুরে বেড়ানো দেখেও বোঝা যায়। তারপরও মোমেন বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য বলে, “কী রে খ্যাত, দেখলি তো। আমি ঢাকায় গিয়ে এমন একটা মোবাইল কিনব, যেটা দিয়ে গান শোনা যাবে, টিভির মতো ছবি দেখা যাবে আবার ছবি তোলাও যাবে। গ্রামে এমন আশ্চর্য মোবাইল এখনও কেউ দেখেনি।”

অবিশ্বাস করতে পারে না আকালু। এর আগে মোবাইল ফোন কতজনের হাতে দেখেছে, কিন্তু ছোট যন্ত্রটি চুপিচুপি কানের মধ্যে কীভাবে আরেকজনের গলার স্বর বাজায়, তা মোমেনই তাকে প্রথম দেখিয়ে দিল। ঢাকায় গেলে আরও অনেক আশ্চর্য জিনিস তো সে দেখতে পাবে। যাওয়ার আগেই ঢাকার আশ্চর্য জিনিসের গল্প শুনিয়ে সবাইকে তাক লাগায় মোমেন। ঢাকার রাস্তায় নাকি চারতলা বাস আছে, সে জন্য রাস্তায় জ্যাম লাগে। রাস্তায় জ্যাম হলে ছোট প্লে¬নে চড়েও মানুষ উঁচু বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়ে নামে। বড় একটা মার্কেটে ঢুকলেই নাকি অটোমেটিক সিঁড়ি মানুষকে চারদিকের সব দোকানে নিয়ে যায়। ঢাকায় গেলে, ছবিওয়ালা মোবাইলের মালিক হলে মোমেন যে আরও কত আশ্চর্য জিনিসের গল্প বলে গাঁয়ের ছেলেদের হাঁ করে দেবে! তখন আকালুর গ্রামে দেখা ভূত-অদ্ভুতের পঁচা গল্প কেউ শুনতেও চাইবে না।

মোবাইল নিয়ে মোমেন বোনের কাছে ছুটে গেলে, আকালুও ঘাস কাটার জন্য ক্ষেতের আইল ধরে হাঁটতে থাকে।

গরুর জন্য ঘাস কাটতে গিয়ে ঘাসের মধ্যেও তো আকালু কত কী অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পায়! কালো ভোটা পিঁপড়ে, কেঁচো, ছোট ফড়িং ছাড়াও একবার একটা সবুজ রংয়ের উড়াল সাপ দেখেছিল। সেই গল্পও গাঁয়ে সবার কাছে করেছে। আকালুর সত্যি কথাটাকেও গুলগল্প ভেবেছে সবাই। কিন্তু মোমেনের হাতে মোবাইল দেখলে তার ঢাকার বানানো গল্প কেউ অবিশ্বাস করবে না আর। আকালু আজ ঘাস কাটতে গিয়ে কিছুই দেখে না, হারানো বাপ ও ঢাকার কথা ভাবতে থাকে।

মোমেনের দুলাভাইয়ের আগে থেকেই তো আকালুর বাপ ঢাকায় আছে। এখন ঢাকার কাছেই বোর্ড ফ্যাক্টরিতে চাকরি করে। হয়তো বাপের একটা মোবাইল ফোনও আছে। কিন্তু মাসে মাসে বেতন পেয়েও লোকটা বড় ছেলে আকালুকে একটা মোবাইল কিনে দেওয়ার কথা ভাবেনি কখনও। গ্রামে রেখে যাওয়ার পর বউ-বাচ্চাকে খাওয়ার জন্য ঢাকা থেকে টাকাও পাঠায়নি। তাদের আর খোঁজ না নেওয়ার জন্যই আকালুর মাকে তালাক দিয়ে ঢাকায় আবার বিয়ে করেছে। সেই বউয়ের বাচ্চাও আছে একটা। লোকে বলে, আকালুর সৎমা-ই আসলে দায়ী, সেই মেয়েটাই জাদু করে বন্দি করে রেখেছে আকালুর বাপকে।

বাপকে উদ্ধার করার জন্য আকালু মাঝেমধ্যে ঢাকায় যাওয়ার কথা ভেবেছে। লেখাপড়া না শিখেও তাদের গ্রামের দুটি ছেলে তো ঢাকায় গেছে। একজন রিকশা চালায়, আরেকজন গার্মেন্টস কোম্পানিতে চাকরি করে। আকালুও ঢাকায় গেলে বাপের দেখা না পাক, চাকরি করে মাসে মাসে টাকা পাবে। চাকরি যদি না পায়, আর একটু বড় হলে সে রিকশা চালাতে পারবে অবশ্যই। এখনই পারে। আর ঢাকায় রিকশা চালিয়ে মেলা টাকা রোজগার করতে পারলে, জমানো টাকা দিয়ে আকালু একটা মোবাইলও কিনতে পারবে।

কিন্তু আকালুর মা তার ঢাকা যাওয়ার কথা শুনলেও ভীষণ ভয় পায়। বলে, তোর বাপের মতো তুইও যদি গ্রাম থেকে চলে যাস, তা হলে আমি বিষ খেয়ে মরব।

মাকে ছেড়ে আকালু তাই গ্রাম ছেড়ে কোথাও যাওয়ার কথা ভাবতেও পারে না। কিন্তু তাই বলে আশ্চর্য জিনিস দেখার নেশা কমেনি আকালুর। বাবা যখন ছিল, প্রাইমারি স্কুলে যেত আকালু। সে সময় একটা সাইকেলের চাকাকে গাড়ির মতো ঘোরাতে ঘোরাতে মোটর গাড়ি নয়, একটা ট্রেন চালাবার কথা পর্যন্ত ভেবেছে আকালু।

কিন্তু গরিবের ছেলের কপাল দেখ। বাসে একবার একটুখানি উঠলেও, আজ পর্যন্ত ট্রেনে ওঠেনি ও। গাঁয়ের অন্য বন্ধুদের মতো শহরে গিয়ে সিনেমা হলে ঢুকে বড় পর্দায় সিনেমাও দেখেনি কোনোদিন। আশ্চর্য জিনিসের শখ মিটাতে যে অনেক টাকা লাগে! বাড়তি বিশটি টাকা রোজগার করতে না পারার কারণেই আজ পর্যন্ত বাসে চড়ে কাছের শহরে যাওয়াও হয়নি আকালুর।

অনেক টাকা রোজগারের কথা ভাবলে ঘুরেফিরে আকালুর আলাদিনের আশ্চর্য চেরাগটার কথা মনে পড়ে। সময় পেলেই রাতে বাজারের ক্লাবঘরের টিভি দেখতে যায় সে। টিভিতে সেই আশ্চর্য প্রদীপ আর দৈত্যটার সিনেমা দেখেছে একদিন। ঘষে দিলেই দৈত্যটা এসে হাজির হয়। আর প্রদীপের মালিক যে হুকুমই দিক না কেন, সঙ্গে সঙ্গে হুকুমমতো সব জিনিসই এনে পায়ের কাছে জড়ো করবে। এমন আশ্চর্য একটা প্রদীপ পেলে কোনো অভাবই থাকবে না আকালুর। তার আগে দৈত্যটাকে হুকুম দিয়ে দুনিয়ার সব আশ্চর্য জিনিস দেখার শখ মিটিয়ে নিত সে।

আকালু তাই গ্রামে কাজে-অকাজে ঘোরার সময় আশ্চর্য প্রদীপের মতো কিছু একটা পড়ে পাওয়ার কথা ভাবে। ভয়ঙ্কর কোনো দৈত্য-দানো না হোক, আল্লাহ ইচ্ছে করলে একটা জিনকে তার গোলাম করে দিতে পারে। পাশের গ্রামে একজন জিনে-ধরা মৌলভী আছে। তার অনেক টাকাপয়সা। লোকেরা বলে জিনটাই নাকি তাকে টাকা এনে দেয়। তাছাড়া ভূতের মতো আশ্চর্য একটা শক্তি অনেকের শরীরে ভর করে। তখন সে করতে পারে না, এমন কাজ নেই। এ রকম ভর-করা দুটি লোককে আকালু নিজেও দেখেছে। একজন ইনসাফ, হাডুডু খেলে। খেলার সময় যদি তার শরীরে ভূতটা ভর করে, তবে একশ’ জন ধরেও আটকাতে পারে না ইনসাফকে। আর একজন তারই মিতা, তাদের গাঁয়েরই বুড়ো আকালু। মাছ ধরতে গেলে সে এমন এক মন্ত্র পড়ে পানিতে নামে, পানির বড় মাছ তার কাছে ছুটে আসে। আকালু বুড়োর মাছ শিকার নিয়েও কত আশ্চর্য গল্প আছে গ্রামে। আকালু বুড়ো অচল হয়ে পড়ার পর হাঁটাচলা করতে পারে না আর। মরতে পারলেই বাঁচে, এমনই তার করুণ দশা। সেই বুড়োকে আকালু বলেছিল একদিন, ও মিতা, মন্ত্রটা শেখায় দেও তো আমাকে, তোমার মতো মাছ ধরতে পারলেও তবু সেই মাছ বাজারে বিক্রি করে সংসার চালাতে পারতাম।

বেশ কয়েকদিন ঘোরার পর আকালু বুড়ো বিড়িবিড় করে ছোট আকালুকে একটা মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সেই মন্ত্র এখনও কাজে লাগায়নি আকালু।

ক্ষেতের কাজ না থাকলে বাবার রেখে যাওয়া ঝাঁকি জাল কিংবা ছিপবড়শি নিয়ে চতলার বিলে মাছ ধরতে যায় আকালু। বাজার থেকে তো ইলিশ মাছ দূরে থাক, পুঁটি মাছও কেনার মতো বাড়তি পয়সা থাকে না। কাজের ফাঁকে আকালু বিল থেকে দুচারটা মাছ ধরে আনে বলেই মা ও ভাইবোনেরা এখনও মাছভাত খাওয়ার সুখ পায়। আজও বাড়িতে সেই সুখ আনার জন্য, সারাদিন মাঠে কাজের পর, সন্ধ্যার আগে জাল নিয়ে বিলে যায় আকালু।

বুড়ো আকালুদের ছোটবেলায় চতলার বিলে তখন কত যে মাছ ছিল! পুরনো দিনের মাছের গল্প শুনলে অবাক হয় সবাই। এখন তো বিল শুকিয়ে অনেক জায়গায় জমি হয়েছে। পানি যেখানে আছে, সেখানে আগের মতো বড় বড় মাছ দূরে থাক, পানি বাগড়ানো ব্যাঙের লাফ পর্যন্ত চোখে পড়ে না তেমন। তবু গাঁয়ের লোকজন তন্নতন্ন করে মাছ খুঁজতে সরকারি এই বিলেই ছুটে আসে। আকালুও আজ জাল নিয়ে বিলে এসে দেখতে পায়, তার আগেই আরও দুজন জাল নিয়ে বিলের অল্প পানিতে ঝপাংঝপ জাল ছুড়ছে।

আকালু বুড়োর কাছে শেখা মন্ত্রটা এরই মধ্যে মুখস্থ করেছে আকালু। মুখস্থ সেই মন্ত্রটা আউড়ে আজ জালে ফুঁ দিল সে, বিলের পানিতেও ফুঁ ছুড়ে মারল একটা। আশ্চযর্, আকালুর ফুঁয়ের জোরেই কিনা, পানিতে এক জায়গায় ঢেউ জাগতে দেখল আকালু। সেই ঢেউটা লক্ষ করে জালখানা ঝপাং করে ছুড়ে মারল সে।

পানি থেকে জাল টেনে তোলার সময় তো চোখের পলক পড়ে না আকালুর। কিন্তু আজ চোখ বুজে জাল টেনে তুলল সে। তারপর জালে ফাঁদা প্রাণীদের পরীক্ষা করতে গিয়ে দেখল, আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মতো কোনো জিনিস নয়, বড় আকারের দুটি তেলাপিয়া মাছ জালে ফেঁদেছে। ওজন করলে দুটো এক কেজিরও বেশি হবে। বাজারে বেচলে দাম কম করে ৫০ টাকা। এত বড় তেলাপিয়া মাছ ধরা দূরে থাক, চোখেও দেখেনি অনেকে।

মাছ দুটি খলইতে নিয়ে আজ আকালু আর জাল ফেলল না। কারণ বেশি লোভ করলে যদি মন্ত্রটার জোর মিথ্যে হয়ে যায়! জাল কাঁধে ও খালই হাতে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে লাগল আকালু। বিলে মাছ ধরতে এলে মাছুয়ার খলই দেখা গাঁয়ের মানুষের অভ্যাস। আকালুর খলইতে এক জোড়া বড় তেলাপিয়া দেখেও অনেকে আহ-উহ করতে লাগল। একজন তো কেনার প্রস্তাব দিল। কিন্তু আকালু মা ও ভাইবোনকে না দেখিয়ে এ মাছ বেঁচবে না। বলা তো যায় না, এই মাছ দুটি থেকেই হয়তো আকালুদের সৌভাগ্যের চাকা খুলে যাবে এবার।

বাড়িতে আসার পর মাছ দেখে আকালুর মা ও ছোট ভাইবোনরাও বেজায় খুশি। পড়শি জোবেদ বেপারি এসেছে তাদের বাড়িতে। ধারের টাকা শোধ করার তাগাদা দিতেই বোধহয়। আকালুদের উঠানে পিঁড়িতে বসে বিড়ি টানছিল লোকটা। আকালুর মায়ের হাতে এত বড় মাছ দেখে বলল, “কার দিঘি থেকে ধরে আনলি রে আকালু! চুরি করে আজও মণ্ডলের দিঘিতে জাল নিয়ে গেছিলি?”

আকালু জবাব দিল, “আমি চোর না, আর মানুষ ঠকিয়েও সংসার চালাই না। চতলার বিল থেকে ধরে আনলাম।”

বেপারির কণ্ঠে তবু অবিশ্বাস, বলল, “চতলার বিলে এত বড় তেলাপিয়া এল কোত্থেকে!”

আকালু যে নিজের উপর অলৌকিক শক্তি ভর করানোর মন্ত্র জানে এবং অলৌকিক শক্তি ভর করলে আকালু যা খুশি করতে পারবে, বেপারিকে প্রমাণ দিতে পারলে কাজের কাজ হত। বেপারি বিশ্বাস করবে না জেনেও জোর গলায় বলল আকালু, “আমি চাইলেই বিলে মেলা মাছ আসবে, আর হুকুম দিলেই বিলের সব মাছ ভ্যানিশ হয়ে যাবে।”

কথাটা জবর ঠাট্টা মনে করে জোবেদ বেপারি হো হো করে হাসতে লাগল। হেসে জবাব দিল, “তোর এত ক্ষমতা বলেই তো তোর মায়ের এত কষ্ট রে বাবা। শোনো আকালুর মা, এইটুকু ছেলের উপর ভরসা করে থাকলে সংসার তোমার চলবে না। তারচেয়ে দেখেশুনে একটা নিকা কর, পুরুষ মানুষ না হলে সংসার চলে? আকালুর একটা সৎ বাবা এলে সেই তোমার সংসারের সব কাজ করে দেবে, আকালুও আবার আগের মতো স্কুলে যাবে।”

এমনিতেই বেপারি লোকটা আকালুর দুচক্ষের বিষ। তার উপর এত বড় একটা বাজে কথা আকালুর সামনেই বলা হল দেখে রাগে চোখ লাল হল। মা হুকুম দিলেই এখুনি লোকটাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে বের করে দিতে পারে সে।

আকালুর মা শান্ত কণ্ঠে বলল, “আকালু আছে বলেই ছোট দুইটারে নিয়ে এখনও এ বাড়িতে টিকে আছি। না হলে যে কোথায় ভেসে যেতাম।”

জোবেদ বেপারি বলল, “আকালু ছোট বলেই এখনও মায়ের কথা শুনছে। বড় হলে নিজেই বিয়ে-সংসার করে তোমাকে লাথি দিয়ে তাড়াবে। মেয়ে মানুষের স্বামী ছাড়া চলে না, বুঝলে?”

আকালু বড়দের চেয়ে কম কাজ করে না, বরং অনেক বড় মানুষের চেয়েও বেশি কাজ করে। এ গাঁয়ে এক বুড়ো আকালু ছাড়া আর কেউ চতলার বিল থেকে একবার জাল ছুঁড়েই এমন বড় তেলাপিয়া তুলে আনতে পারবে? একটা প্রমাণ দেওয়ার পরও জোবেদ বেপারির এ রকম তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর সহ্য হল না আকালুর। লোকটাকে ভয় দেখাতে মন্ত্রের রহস্যটা এবার ফাঁস করল।

“এই যে চাচা, আমি মন্ত্র পড়লেই আমার শরীরে বড় বড় পালোয়ানের চেয়েও বেশি শক্তি ভর করে, জানেন সে খবর?”

জোবেদ চাচা আবারও ঠাট্টার হাসি দিয়ে জানতে চায়, “কী ভর করে তোর উপর?”

আকালু আরও জোর গলায় বলল, “আমি চাইলেই আপনাকে এখনই ভ্যানিশ করে দিতে পারি।”

জোবেদ বেপারি আকালুর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “হ্যাঁ... কয় কী ছেলেটা? আমারে ভ্যানিশ না ফিনিশ করবি তুই!”

“দেখবেন? দাঁড়ান।” বলেই ঘরে ছুটে গেল আকালু।

ঘর থেকে দা হাতে বেরিয়ে এসে আকালু দাখানা শক্ত হাতে চেপে ধরল। তারপর চোখ বুজে বিড়বিড় করে মন্ত্র পড়তে লাগল। দা হাতে মন্ত্রপড়া আকালুর ভয়ঙ্কর চেহারা দেখতে লাগল সবাই। জোবেদ বেপারি হঠাৎ ভয় পেয়ে উঠে দাঁড়াল এবং আকালু চোখ খোলার আগেই দিল ভোঁ দৌড়।

আকালুর মা ও ছোট ভাইবোন দুটি অবাক চোখে আকালুর কাণ্ড দেখছিল। মন্ত্রপড়া শেষে চোখ খুলল আকালু, তারপর জোবেদ বেপারিকে চোখের সামনে না দেখে হাতের দাখানা শূন্যে ছুড়ে মারল। আকালুর হাতের দা শূন্যে কোথায় কোনদিকে উড়ে যায়, অপলক তাকিয়ে থেকেও বাড়ির কেউ তা দেখতে পেল না।