টুঙ্গিপাড়া থেকে টুঙ্গিপাড়া

বঙ্গবন্ধুকে আমি সরাসরি কিছুটা কাছ থেকে প্রথম দেখি ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে। বঙ্গবন্ধু সেবার বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করতে এসেছিলেন।

>> সুব্রত বড়ুয়াবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2013, 12:31 PM
Updated : 15 August 2013, 12:31 PM

আমার ঠিক মনে নেই; তবে সেবার অনুষ্ঠান ছিল বোধহয় তিনদিনের। খোলা মঞ্চ। প্যান্ডেলও ছিল না। মাত্র আড়াই মাস আগে অনুষ্ঠিত জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছে আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছেন, “পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।”

দেশে সামরিক শাসনের অবসান ঘটতে যাচ্ছে। আবার কায়েম হবে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। সবার মনে সুদিনের প্রত্যাশা। মানুষ প্রাণখুলে কথা বলতে পারবে। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হবেন। উন্নতির পথে, প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে দেশ।

কিন্তু সত্যিই তা হবে তো? সুসময়ের প্রত্যাশার পাশাপাশি স্বপ্নভঙ্গের আশঙ্কাও যে ছিল। বঙ্গবন্ধু উঠে দাঁড়ালেন ভাষণ দিতে। সে ভাষণের সব কথা আজ আর পুরোপুরি মনে নেই। মনে থাকার কথাও নয়। কিন্তু দুটি বিষয় বেশ ভালোভাবেই মনে আছে। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, তিনি পণ্ডিত নন, বুদ্ধিজীবীও নন। তিনি একজন সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষদের সঙ্গে নিয়েই রাজনীতি করেন। পণ্ডিতজনের হিসেব করা, মাপজোক করা তত্তে¡র বন্ধনে আবদ্ধ রাজনীতি করতে তিনি জানেন না। সাধারণ মানুষই তার রাজনীতির জগত। তাদের ভালোমন্দই তার রাজনীতির সাধনা।

আরেকটি কথা বলেছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেটি তার ভয়ের কথা, আশঙ্কার কথা, উদ্বেগের কথা। তিনি বলেছিলেন, ফেব্রুয়ারি মাস, মার্চ মাস বাঙালির রক্ত ঝরার মাস। নির্বাচনে জেতাই শেষ কথা নয়। নির্বাচনের রায় বানচাল করে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। বাঙালিরা যাতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনক্ষমতায় যেতে না পারে, তার জন্য ষড়যন্ত্র চলছে। অতএব সতর্ক থাকতে হবে, সজাগ থাকতে হবে। পূর্ব বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম যাতে ব্যর্থ না হয়, তার জন্য সারাক্ষণ প্রস্তুত থাকতে হবে আমাদের সবাইকে।

বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই আশঙ্কা মিথ্যে ছিল না। ইতিহাসই তার প্রমাণ। মাত্র দশ-এগারদিন পরই প্রকাশ পেল ষড়যন্ত্রের ঘটনা। কিন্তু বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র, ভয় দেখিয়ে, ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে, গণহত্যা সংঘটিত করে বাংলার মানুষকে সেদিন স্তব্ধ করা যায়নি। সাতই মার্চ (১৯৭১) রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের উত্তাল সমাবেশে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

তার সে উচ্চারণ সত্য হয়েছিল তিরিশ লক্ষ মানুষের আত্মদানের মাধ্যমে। লাখো মা-বোনের সম্ভ্রম হারানোর মাধ্যমে। আর বাংলার চাষি-মজুর-ছাত্র-জনতার মরণপণ সংগ্রামে।

স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জনের জন্য বাংলার মানুষের যে সংগ্রাম, সে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি-- একা, নিঃসঙ্গ। তার মনোবল চূর্ণ করার জন্য পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বাইরের দুনিয়া থেকে তাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল। বাইরের পৃথিবীর কোনো খবর জানতে পারতেন না তিনি। বাংলাদেশে কী ঘটছে, সে খবরও জানতে পারেননি তিনি।

কিন্তু অনুপস্থিত বঙ্গবন্ধুই ছিলেন নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের আসল নেতা। তাঁর সাতই মার্চের ভাষণই হয়ে দাঁড়িয়েছিল বাংলার মানুষের প্রেরণার মন্ত্র। তিনিই ছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান-- রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম পালন করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব।

কারাগারে থাকলে কী হবে, বঙ্গবন্ধুর সাহসী নেতৃত্বই ছিল স্বাধীনতা অর্জনের মূলশক্তি। তারই স্বীকৃতি রয়েছে আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে। তিনিই এ দেশের প্রধান স্থপতি-- জাতির জনক।

ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের এই মানুষটি ছিলেন সাধারণ এক মধ্যবিত্ত কৃষক পরিবারের সন্তান। তিনি খুব ঘনিষ্ঠভাবেই পরিচিত ছিলেন বাংলার খেটে-খাওয়া গরিব মানুষদের প্রতিদিনের জীবনসংগ্রামের সঙ্গে। তার রাজনীতির কেন্দ্রে ছিল এই মানুষদেরই জীবন। তাদের প্রতি ভালোবাসাই ছিল তার রাজনীতির শক্তি। আর সে রাজনীতি ছিল বাস্তব জীবনের সঙ্গে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ। তাই সে রাজনীতি কখনও স্বার্থপরতার মধ্যে বন্দি হয়ে থাকেনি; নিশ্চল নিথর হয়ে থাকেনি কোনো ছকবাঁধা পথের মধ্যে।

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়েছিলেন তিনি। সে বন্ধু জীবনে আর কখনও ছিন্ন করতে পারেননি। কারণ, রাজনীতি নয়, আসলে মানুষের ভালোবাসার কাছেই বাঁধা পড়েছিলেন তিনি। আর তিনি তো সত্যিই জানতেন, ভালোবাসার বন্ধন এক নিষ্ঠুর বন্ধন, জীবন দিয়ে শোধ করতে হয় তার দাম।

আর রাজনীতি? সেখানেও আছে তার অনন্য বৈশিষ্ট্য। নিজেকে পরিণত করেছেন প্রতিনিয়ত, বেরিয়ে এসেছেন প্রশস্ততর পরিসরে, নতুন সময়ের নতুন দাবির সঙ্গে অনায়াসে যুক্ত করেছেন নিজেকে। আর এই যুক্ত করার মধ্যে তার কোনো চালাকি ছিল না, মতলব ছিল না, আখের গোছানোর বুদ্ধিও ছিল না।

বাংলার শান্ত নিরিবিলি ছায়াঢাকা-পাখিডাকা এক গ্রাম টুঙ্গিপাড়া থেকে উঠে এসেছিলেন তিনি। সিক্ত হয়েছেন মানুষের ভালোবাসায়। মানুষের মধ্যে মানুষেরই জন্য বেঁচে থাকতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু নিয়তির কাছে পরাজিত হলেন শেষ পর্যন্ত। কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের হাতে সপরিবারে নিহত হলেন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫, ভোরে। এমনকি ঘাতকদের বুলেট সেদিন রেহাই দেয়নি শিশু ও নারীদেরও।

বঙ্গবন্ধু সেদিন নিহত হয়েছিলেন বটে, তাই বলে কি হারিয়ে গেছেন বাঙালির হৃদয় হতে? মোটেই হারাননি। আজও তিনি বেঁচে বাঙালির হৃদয়ে। তিনি যে আমাদের জাতির জনক।

লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও বিজ্ঞান-লেখক