সুন্দরবনে ঢোকার পথে এক বৃদ্ধ জেলে কথাটা বলেছিলেন আমাদের। এ বনে ঢোকার পথ বলতে আছে কেবল নদী আর খাল। আমরা চাঁদপাই এলাকার মৃগামারি খাল ধরে চলছিলাম। আমাদের ছিপ-নৌকার হাল ধরে বসে আছে ছিপছিপে এক কিশোর। আমরা এসেছি বিরল পাখির ছবি তুলব বলে। সবাই ক্যামেরা তাক করে পাটাতনে গুটিসুটি হয়ে বসে আছি। জোয়ারের টানে গুড়ি গুড়ি করে নৌকা ঢুকে যাচ্ছে বনের গহীনে। কুয়াশা-ঢাকা বনে সাত-সকালে আমরা শীতে কাঁপছি।
তিনি কি তবে ভুল তথ্য দিলেন? মোটেই তা নয়। ‘গরম’ বলে তিনি উষ্ণতা বোঝাননি, এ বন আজ বিপজ্জনক-- তাই বলেছেন।
সুন্দরবনে বিপদের শেষ নেই। সব চেয়ে বড় বিপদ, বাঘের আক্রমণ। বাঘের কবলে অনেক মানুষ এখানে প্রাণ হারায়। সুন্দরবনে ত্রাসের নাম ‘বাঘ’। মানুষ এখানে বাঘের নামও মুখে আনে না; ‘বাঘ’ শব্দটিও এড়িয়ে চলে। বাঘকে এরা বলে ‘তিনি’, ‘মামা’, ‘বড়-মিয়া’ ইত্যাদি; বনে বাঘ এলে বলে ‘বন গরম’।
সুন্দরবনের জনপদে বড়দের মতো শিশু-কিশোরও বাঘকে প্রতাপশালী প্রতিবেশী হিসেবে জানে, সমীহ করে চলে। কিন্তু নিত্যদিনের কাজ ফেলে তারা দোরে খিল দিয়ে বসে থাকে না। আমাদের খুদে মাঝি বিশ্বাস করে, দিনের আলোয় দল বেঁধে নৌকা নিয়ে খালে ঢুকলে মানুষকে বাঘে ধরে না। তার বিশ্বাসে নাড়া দেওয়ার জন্য বললাম, “মনে হয় আমাদের একজন আজ চাঁদপাই ফিরবে না, রাতে বাঘের পেটে শুয়ে ঘুমাবে।”
অমনি চাপা গলায় সে জানাল, “না না, আমাদের গুণিন বড়-মিয়ার মুখ খিলেন করেছেন।” এর অর্থ, দোয়া-দরূদের শক্তি দিয়ে গাঁয়ের এক ‘গুণীজন’ বাঘের মুখ বন্ধ করেছেন। সুন্দরবনের মানুষ মন্ত্র-তন্ত্র, তুক-তাক আর দোয়া-দরূদে বিশ্বাস করে। বিশ্বাসই তাদের এ ভয়ংকর বনের গা-ঘেঁষে বাস করার শক্তি জোগায়।
আমাদের কিশোর মাঝিও অন্ধ-বিশ্বাসে ভর করে আজ বনে এসেছে। সে জানে, মন্ত্রবলে গুণিন বাঘের মুখ বন্ধ রেখেছেন। কিন্তু আমাদের তো সে বিশ্বাস নেই। আমাদের নাগালে পেলে বন্ধ চোয়াল নিয়ে বাঘ শরমে মুখ লুকাবে, এ কথা ভেবে ভুয়া সাহসে ভর করে কি আমরা চলতে পারি! চাচা-মিয়ার পরামর্শ মতো আমরা চোখ-কান খোলা রেখেছি। ঠিক করেছি, নৌকা ছেড়ে হুট করে বনের মাটিতে পা রাখব না। বনে নামলে কখনও কেউ দলছুট হব না। বড়-মিয়া কাছে আছে সন্দেহ হলে ঝোপ-ঝাড় পিটিয়ে শোরগোল করে তাকে ভাগানোর চেষ্টা করব। সূর্য ডোবার আগেই বন ছেড়ে যাব ...
আরে, গরম বনে ঢোকার শর্ত হিসেবে গুণিনেরা যা বলেন সবই দেখি আমরা মেনে চলছি! এখন আমাদের গৃহে ত্রুটিপূর্ণ বা ত্রুটিহীন কোন স্ত্রীই যেহেতু নেই, এ বনে আর ভয় কীসের!
লেখক : বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞ এবং পরিব্রাজক