‘কচি-কাঁচা’র দাদাভাই

‘লাইনে দাড়িয়ে বুক কেঁপে উঠলো। কি জানি কী, হয়তো আমার অঙ্ক কষা শেষ না হতেই অন্য প্রতিযোগীরা নির্দিষ্ট জায়গায় পৌঁছে যাবে। শুরু হলো প্রতিযোগিতা। মাঠের ও-প্রান্তে গিয়ে অঙ্ক কষলাম। কাগজটি নিয়ে দৌড় দিলাম এ-প্রান্তে। আমি ছিলাম তৃতীয় প্রতিযোগী। সবাই কাগজ জমা দিল। ভাবলাম অঙ্কটা শুদ্ধ হলে অন্তত থার্ড প্রাইজ তো পাব। কিন্তু থার্ড নয় ফার্স্ট হলাম। কারণ আমারটি ছাড়া আর কারো অঙ্কই শুদ্ধ হয়নি। আমার স্কুল জীবনের এটি ছিলো অপূর্ব স্বাদের-আনন্দের দিন।’

রাশেদ শাওনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2013, 08:46 AM
Updated : 11 April 2013, 06:38 AM

দাদাভাই কিন্তু মৃত্যুর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ভেবেছেন শিশুদের কথা। আর তিনি বসে বসে ভাবেননি শুধু, শিশুদের কাজে ছুটে বেরিয়েছেন সারা দেশে, এমনকি দেশের বাইরেও। নিরলস প্রচেষ্টায় তোমাদের জন্য গড়ে তুলেছিলেন একটি শিশু সংগঠন- ‘কচি-কাঁচার মেলা’।

এই ‘কচি-কাঁচার মেলা’ প্রতিষ্ঠার গল্প শোনা যাক দাদাভাইয়ের কাছ থেকেই- ‘১৯৫৬ সালের ৫ই অক্টোবর। শরতের আকাশে রোদ আর মেঘের লুকোচুরি। হঠাৎ করে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল কিছুক্ষণ আগে। নির্ধারিত সময়ে সবাই এসে গেলেন ঢাকার তারাবাগে, বেগম সুফিয়া কামালের বাসা। সব্বাই, অর্থাৎ ১৪-১৫ জন শিশু-কিশোর ভাই-বোন; আর সেইসঙ্গে অধ্যাপক অজিত কুমার গুহ, আবদুল্লাহ আল-মুতী এবং এম. এ. ওয়াদুদ (দৈনিক ইত্তেফাকের সে সময়ের ম্যানেজার ও পূর্ববঙ্গ ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) সঙ্গে আমি। বেগম সুফিয়া কামাল আমাদের নাস্তার ব্যবস্থা করেছিলেন।

‘সেদিন সভা শুরু হয় ঘাসের ওপরে মাদুর বিছিয়ে। সভাপতি ছিলেন আবদুল্লাহ আল-মুতী। সেই সভায় ঠিক হয়, কচি-কাঁচার মেলা নামে একটি শিশু-কিশোর সংগঠন গড়ে তোলা হবে। এর সদস্যদের প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ও দেশাত্মবোধে উদ্ধুদ্ধ করা হবে। তারা গুণীজনদের সম্মান দেবে। শুধু চেয়ারের মর্যাদা নয়- গুণের মর্যাদা দেবে। দৈনিক ইত্তেফাকের ছোটদের বিভাগ কচি-কাঁচার আসরকে কেন্দ্র করে এই সংগঠনের জন্ম হয়েছিলো।’ পরে এই সংগঠনের সঙ্গী হন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, এম. এ. ওয়াদুদ প্রমুখ। দাদা ভাই পরে আরেক লেখায় বলেন, ‘অনেক কর্মী, শুভানুধ্যায়ী আজ হারিয়ে গেছেন। অনেকের ঠিকানা আমার জানা নেই। কিন্তু বিগত ৩৩ বছর আগে যে কয়েক লক্ষ কচি-কাঁচা বয়ঃপ্রাপ্ত হয়েছেন। সদস্য পদ থেকে প্রাক্তনের পর্যায়ভুক্ত হয়েছেন, তারা আজ ছড়িয়ে পড়েছে শুধু বাংলাদেশের শহর-বন্দর-গ্রামেই নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন শহর-বন্দরে।’

এতোক্ষণ তো দাদাভাইয়ের কাছ থেকে শুনছিলে তার প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত সংগঠন কচি-কাঁচার মেলা-র কথা। কিন্তু কেন যে হঠাৎ দাদাভাই আর কচি-কাঁচার মেলা-র গল্প শুরু করলাম, বলো তো? কারণ, ৯ এপ্রিল যে দাদাভাইয়ের জন্মদিন!

দাদাভাইয়ের ছোটবেলা

দাদাভাই নামেই তিনি সবার কাছে পরিচিত। আসল নাম রোকনুজ্জামান খান। নামটি রেখেছিলেন তার নানা, রওশন আলী চৌধুরী। সবাই আদর করে ডাকতো নান্নু বলে। তাহলে তার নাম দাদাভাই হলো কী করে? ১৯৫৫ সালের ২ এপ্রিল, দৈনিক ইত্তেফাকের শিশুদের বিভাগ কচি-কাঁচার আসর প্রকাশিত হতে শুরু করে। তখন তিনি শিশু বিভাগের সম্পাদক হন; আর সম্পাদক হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন ছদ্মনাম- ‘দাদাভাই’। সেই শুরু; পরে তো তার এই ‘দাদাভাই’ নামের আড়ালে তার আসল নাম রোকনুজ্জামান খান-ই হারিয়ে গেল!

সে যা হোক, দাদাভাইয়ের জন্ম ১৯২৫ সালের ৯ এপ্রিল, রাজবাড়ী জেলার পাংশা উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামে, নানার বাড়িতে। তার নানা রওশন আলী চৌধুরী আবার ছিলেন ‘কোহিনূর’ পত্রিকার সম্পাদক। দাদাভাইয়ের বাবার নাম মৌলভী মোখাইরউদ্দীন খান, মায়ের নাম রাহেলা খাতুন। মা’র বাড়ি মানে নানার বাড়ি কোথায়, সে তো জেনেই গেছো; আর বাবার বাড়ি, যাকে বলে পৈতৃক নিবাস, কুষ্টিয়া জেলার ভেড়ামারা উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে। দাদাভাই ছিলেন মোখইরউদ্দীন খানের দ্বিতীয় স্ত্রীর একমাত্র সন্তান। বাবার বাবা, মানে দাদাভাইয়ের দাদা মুজিরউদ্দীন খান ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার মানুষ; ছিলেন সরকারি চাকুরে- সাবরেজিস্টার। ভেড়ামারা এলাকায় ছিলো তার বিরাট জমিদারি। পরে এই ভেড়ামারাতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করতে শুরু করেন।

তার শৈশব ও কৈশোর কেটেছে পাংশায়, নানাবাড়িতে। সেকালে পাংশার চৌধুরী পরিবার, মানে তার নানার পরিবার ছিল ভারতবিখ্যাত। খুব ছোট থাকতেই তিনি মাকে হারান। সে সময় তার বয়স ছিলো মোটে ৬ বছর। 

ছোট থাকতে তিনি গাছে চড়তে ছিলেন ভীষণ পটু। আম, লিচু, জাম, কাঁঠাল তো বটেই, এমনকি নারিকেল-সুপারি গাছেও চড়তেন। তার বাবা ও চাচার বন্দুক ছিলো। তিনিও বন্দুকের ব্যবহার জানতেন। তো তিনি যেদিন প্রথম গুলি ছুঁড়তে গেলেন, সেদিন কী হলো, শোনো। খেয়াল করলে দেখবে, বন্দুকটা কাঁধে ঠেকিয়ে রাখা হয়। কেন জান? নিউটনের তৃতীয় সূত্রের কথা শুনেছো না? ওই যে, প্রতিটি ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। যার কারণে, বন্দুক থেকে যখনই গুলি ছোঁড়া হয়, উল্টোদিকেও একটা ভীষণ ধাক্কা আসে। কাঁধে বন্দুক ঠেকিয়ে জোর দিয়ে সে ধাক্কা সামলাতে হয়। কিন্তু দাদাভাই যেদিন প্রথম গুলি ছুঁড়তে গেলেন, তিনি তো এমনিতেই ছোট্ট; তার উপর কেমন ধাক্কা আসে, তাও জানেন না। কাজে কাজেই, যা হওয়ার তাই হলো; ধাক্কা সামলাতে না পেরে তিনি একেবারে এক পাটকাঠির গাদার উপর গিয়ে পড়লেন।

এবার দাদাভাইয়ের একটা দুষ্টুমির গল্প বলি। একবার তার শখ হলো, এক মওলানা সাহেবের ঘোড়ায় চড়বেন। তো তিনি মওলানা সাহেবের ঘোড়ার পিঠে সওয়ারও হলেন। ওমা! তিনি ঘোড়ার পিঠে বসতেই, ঘোড়াটা কোনদিকে না তাকিয়ে সোজা মাওলানার বাড়ির দিকে দিল ছুট। দাদাভাই কতো চেষ্টা করলেন, লাগাম টেনে ধরতে, কিন্তু পারলেন আর কই! শেষমেশ, ঘোড়াটি যখন একটি গাছের নিচ দিয়ে যাচ্ছিল, তখন গাছের একটা ডাল ধরে ঝুলে পরলেন দাদাভাই। নইলে সেদিন দাদাভাই যে ব্যথা পেতেন; হাত-পাও হয়তো দু-একটা ভাঙতো হয়তো!

দাদাভাই লেখাপড়া শুরু করেন পাংশা জর্জ হাই ইংলিশ স্কুলে। স্কুলের শিক্ষকদের প্রিয় ছাত্র ছিলেন তিনি। এজন্য ক্লাস ক্যাপ্টেন হতেন সবসময়। আর ক্যাপ্টেন হওয়ার সুবাদে, অন্য ছাত্রদের দাবী-দাওয়া, অনুযোগ-অভিযোগ নিয়ে প্রধান শিক্ষকের কাছে যেতে হতো তাকেই। সেই ছোটবেলাতেই সহপাঠীদের নিয়ে হাতে লেখা পত্রিকা বের করেন রোকনুজ্জামান খান। ক্লাসের গরিব ছাত্রদের সহায্যের জন্য একটি ‘পুওর ফান্ড’-ও গঠন করেছিলেন।

আগেই বলেছি, তার ছোটবেলা কেটেছে পাংশা গ্রামে। গ্রামটি ছিলো জলা-জঙ্গলে ভরা। সে সময় রাতে জঙ্গলে বাঘ আসতো। রাতে নানার পাশে শুয়ে শুয়ে তিনি বাঘের গর্জন শুনেছেন বলেও তার একটি লেখায় বলেছেন। তিনি একই লেখায় আরো বলেছেন, ‘আমি যখন নানা বাড়ি থেকে পাঠশালায় পড়ি, পাশে হিন্দু ব্যবসায়ীদের বাড়িতে যাত্রা হতো। টিফিনের সময় যাত্রা দেখতাম।’

‘তখন থেকেই আমি মিছিল, হরতাল, স্লোগান এসবের সঙ্গে পরিচিতি। রওশন আলী চৌধুরী ছিলেন গোয়ালন্দ মহকুমা কংগ্রেস কমিটির বিশিষ্ট নেতা। আমি নানা বাড়ি প্রাঙ্গণে বহু বৈঠক, ভলেন্টিয়ারদের সমাবেশ প্রভৃতি দেখেছি।’

ছোটবেলা থেকেই তার আরো একটা পরিচিতি ছিল- ভোজনরসিক হিসেবে। যখন তিনি পাংশা জর্জ স্কুলে অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র, তখন একদিন নানির হাতে বানানো ১৮টি চালের আটার রুটি এক বসাতেই খেয়ে ফেলেছিলেন। আর যৌবনেও তার ভোজনরসিক হিসেবে সুখ্যাতিটি অটুট ছিলো।

কর্মজীবন

কৈশোর শেষ করে যৌবনে পদার্পণের সময়ে, বয়স তখন ২০ বছর, কলকাতায় চলে আসেন রোকনুজ্জামান। এর আগেই অবশ্য তার লেখালেখি শুরু হয়ে গেছে। কলকাতায় এসে উঠলেন খালার বাসায়। পরে মুসলিম সাহিত্য সমিতির মেসে গিয়ে ওঠেন। চাকরি নেন রেকর্ডকিপার হিসেবে, ‘অফিস অব দি ডেপুটি চীফ একাউন্টস-আমরিকান পারচেজ’ অফিসে।

চাকরিটি অবশ্য তার তেমন পছন্দ হলো না। নানা এয়াকুব আলী চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবুল মনসুর আহমদ, মুজিবর রহমান খাঁ, আব্দুল মওদুদ, আবুল কালাম শামসুদ্দীন, হাবীবুল্লাহ বাহার প্রমুখের সহায়তায় অন্য একটি চাকরি জোটালেন তিনি; মুসলিম সাহিত্য সমিতিতে সহকারী গ্রন্থাগারিকের চাকরি। এই চাকরিতেও বেশিদিন স্থায়ী হলেন না।

এরইমধ্যে, ১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট, কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়ে গেল। এই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যেই, ‘ইত্তেহাদ’ নামে একটি পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করলো। পত্রিকাটির শিশুপাতা ‘মিতালী মজলিস’ সম্পাদনা শুরু করলেন শিশুসাহিত্যিক মোহাম্মদ নাসির আলী। ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। তখন, পাতাটির সম্পাদনার দায়িত্ব নেন রোকনুজ্জামান খান। পাতা পরিচালনার জন্য ‘মিতাজী’ ছন্দনাম গ্রহণ করেন।

১৯৫০ সালের প্রথম দিকে আবার কলকাতায় ও ঢাকায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হয়। সে ধাক্কায় বন্ধ হয়ে যায় ‘ইত্তেহাদ’। এবার রোকনুজ্জামান খান শিশুদের মাসিক পত্রিকা ‘শিশু সওগাত’ সম্পাদনার দায়িত্ব পান। পরে, ওই বছরেরই ২৮ মে ঢাকায় ফিরে আসেন তিনি। ইতিমধ্যে, সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন সম্পত্তি বদলের মাধ্যমে, ঢাকায় সওগাত প্রকাশের ব্যবস্থা করে ফেলেন। রোকনুজ্জামানও ঢাকায় এসে পূর্বের দায়িত্বই আবার পালন করতে শুরু করেন। ১৯৫২-১৯৫৫ পর্যন্ত রোকনুজ্জামান মাসিক সওগাতের ব্যবস্থাপকসহ ঢাকার বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও সংবাদ সংস্থায় চাকরি করেন। তিনি দৈনিক মিল্লাত-এর ছোটদের কাগজ ‘কিশোর দুনিয়া’ প্রায় দুই বছর সম্পাদনা করেন ‘দরদী ভাই’ নামে। ১৯৫৫ সালের ১ মার্চ তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সম্পাদনায় প্রকাশিত হতে শুরু করে দৈনিক ইত্তেফাক। রোকনুজ্জামান প্রথমে পত্রিকাটির মফস্বল সম্পাদক, পরে ছোটদের বিভাগ কচি-কাঁচার আসরের সম্পাদক নিযুক্ত হন। এই পাতাটির সম্পাদনা করতেই তিনি ‘দাদাভাই’ নাম গ্রহণ করেন, পরে যে নামটি তার নামকেই আড়াল করে ফেলে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি এই পাতাটির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন।

লেখক জীবন

দাদাভাই-এর প্রথম প্রকাশিত লেখা ‘কচি বুকের রক্ত’। তবে প্রথম লেখাটি ছিলো পদ্য; তার নানার মৃত্যুর পরে, তাকে স্মরণ করে লিখেছিলেন পদ্যটি। তিনি ছড়ালেখক হিসেবে খ্যাতিলাভ করলেও, প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আজব হলেও গুজব নয়’ ছড়ার বই নয়, গদ্যের এবং অনুবাদ গ্রন্থ। মৌলিক ছড়ার বই দু’টি- ‘হাটটিমা টিম’ অন্যটি ‘খোকন খোকন ডাক পাড়ি’। সম্পাদনা গ্রন্থ বেশ কয়েকটি- ‘আমার প্রথম লেখা’, ‘ঝিকিমিকি’, ‘কবি আহসান হাবীব স্মারকগ্রন্থ’, ‘ছোটদের আবৃত্তি’, ‘মাসিক কচি ও কাঁচা’, ‘বার্ষিক কচি ও কাঁচা’, এবং কেন্দ্রীয় কচি কাঁচার মেলার বিভিন্ন পুস্তিকা। এছাড়া তিনি অনেক ছড়া-কবিতা লিখেছেন। লিখেছেন বড়দের গল্পও। কিন্তু কখনো এসব লেখা সংগ্রহও করেননি, প্রকাশ করারও উদ্যোগ নেননি।

শুধু তাই না, আরো আছে। দাদাভাই তো দৈনিক ইত্তেফাকের কচি-কাঁচার আসরের পরিচালক ছিলেন দীর্ঘদিন, প্রায় ৪২ বছর। তিনি এই পাতার জন্য ‘দাদাভাই-এর কথা’ শিরোনামে ছোটদের কাছে প্রায়ই চিঠি লিখতেন; চিঠিগুলো লিখতেন নির্ধারিত বিষয় নিয়ে। জীবনের শেষ দশ বছরে, তিনি প্রতি সপ্তাহে ‘দাদাভাই-এর কথা’ লিখতেন। আর চিঠিগুলোর ব্যাপারে কবি শামসুর রাহমান কী বলেছেন জানো? ‘ইত্তেফাক-এর কচি-কাঁচার আসরে প্রতি সপ্তাহে দাদাভাই-এর কথা নামে একটি ছোট কলাম লিখতেন শিশু-কিশোরদের উদ্দেশ্যে। সেসব চিঠিতে অনেক ভালো ভালো কথা আছে, যা সবার কাজে আসবে। আলোকিত করবে ছোটদের মন। যদি কোন ভালো প্রকাশক দাদাভাই-এর চিঠিগুলো ছাপার উদ্যোগ নেন, তাহলে তোমরা-আমরা সবাই একটি ভালো বই পেয়ে যাবো।’

দাদাভাইয়ের পুরস্কার

দাদাভাই বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সাহিত্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। এরমধ্যে কয়েকটি পুরস্কারের কথা না বললেই নয়-

১. বাংলা একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৬৮)

২. শিশু একাডেমী শিশুসাহিত্য পুরস্কার (১৯৯৪)

৩. একুশে পদক (১৯৯৮)

৪. স্বাধীনতা পদক (১৯৯৯)

দাদাভাইকে উৎসর্গিত গ্রন্থ ও গ্রন্থকার

বাংলাদেশের অন্তত পঞ্চাশ জনেরও বেশি লেখক দাদাভাইকে তাদের বই উৎসর্গ করেছেন। যেমন ধরো, প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আতোয়ার রহমান তার ‘শিশুসাহিত্যের নানা প্রসঙ্গ’, এখলাস উদ্দীন আহমদ তার ‘তুনু ও ক্ষুদে বন্ধুর গল্প’, সুব্রত বড়–য়া (ড. আবদুল্লাহ আল-মুতীর সঙ্গে) ‘বিজ্ঞানের ইতিকথা : সন্ধানী মানুষ’, খালেক বিন জয়েনউদ্দীন (আফলাতুন-এর সঙ্গে) ‘আতা গাছে তোতাপাখি’, লুৎফর রহমান রিটন, তার চারটি বই ‘আহসান হাবীবের ছেলেবেলা’, ‘হামটি ডামটি’, ‘১০০ রিটন’, এবং ‘ছড়া সমস্ত’ উৎসর্গ করেছেন দাদাভাইয়ের নামে।

মৃত্যু

১৯৯৯ সালের শেষ দিককার ঘটনা; সেদিন দাদাভাইয়ের ছুটির দিন ছিল। তবুও তিনি সেদিন দুপুরে কর্মস্থল ইত্তেফাক ভবনে যান, শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উপরে বিশেষ সংখ্যার লেখা জমা দিতে। কাজ শেষ করে দুপুর ১২ টায় বাসায় ফিরেও যান। গোল বাঁধে বাসায় ফেরার পরপরই; তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এক প্রতিবেশী তাঁকে প্রথমে স্থানীয় একটি নার্সিং হোমে, পরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে দীর্ঘ ২০ দিন মৃত্যুর সাথে লড়াই করেন দাদাভাই। শেষ পর্যন্ত আর পেরে ওঠেননি তিনি, শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সেখানেই। ১৯৯৯ সালের ৩ ডিসেম্বর, মারা যান সবার প্রিয় দাদাভাই। তাকে পরদিন বিকেলে মেলা ভবনের দক্ষিণ পূর্ব কোণে সমাহিত করা হয়।