প্রকাশক, যারা প্রকাশ করেন বই

বইমেলা জুড়ে তো খুব বই কিনলে; এখন সেগুলো পড়ার পালা। তা পড়ো, আরো বেশি বেশি বই পড়ো। তার আগে বলো তো, বই যারা প্রকাশ করেন, তাদের কী বলে? হ্যাঁ, তাদেরকে বলে প্রকাশক। যেসব প্রতিষ্ঠান বই প্রকাশ করে, সেগুলোকে বলে প্রকাশনী। তোমাদের জন্য বই প্রকাশ করে, এরকম কয়েকটি প্রকাশনীর কর্ণধার, মানে প্রকাশকের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুমাইয়া রাশেদ। তাদের মধ্যে আজকে প্রকাশ করা হলো তিনজন প্রকাশকের সাক্ষাৎকার। চলো, শুনে আসি, তারা কী কী বললেন।

সুমাইয়া রাশেদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 March 2013, 05:29 AM
Updated : 4 March 2013, 05:36 AM

ওসমান গণি, প্রকাশক: আগামী প্রকাশনী

কিডস: আগামীর শুরু কিভাবে হলো?

ওসমান গণি: ‘মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তচিন্তা’ এই দু'য়ের প্রত্যয়ে আগামী প্রকাশনী। এই অঙ্গীকার নিয়ে, ১৯৮৬ সালে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। তবে প্রকাশক হিসেবে আমার কাজের শুরু ১৯৭৬ সালে। শিশু কিশোর সংগঠন ‘খেলাঘরের ইতিহাস এগিয়ে চলার বছর পঁচিশ’-এটিই আমার প্রকাশিত প্রথম বই। বইটি লিখেছিলেন ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ। তিনি সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এখন একজন শিক্ষক।

কিডস: এখন পর্যন্ত আগামী প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা কয়টি?

ওসমান গণি: এখন পর্যন্ত আগামী থেকে প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ১ হাজার ৫৬০টি। আমি মনে করি, সবসময় শিশুদের বই বেশি করে প্রকাশ করতে হবে। যখনই সুযোগ পেয়েছি, শিশুদের বই প্রকাশ করেছি। এক্ষেত্রে একটি বড় বাধাও আছে। আমাদের দেশে শিশুসাহিত্যিকের সংখ্যা খুব একটা বেশি নয়। আমাদের প্রকাশনী থেকে হুমায়ুন আজাদের ‘লাল নীল দীপাবলী’, ‘কত নদী সরোবর’, ‘ফুলের গন্ধে ঘুম আসেনা’, ‘অন্ধকারে গন্ধরাজ’, ‘আব্বুকে মনে পড়ে’ প্রভৃতি বইগুলো ঠিক শিশুদের উপযোগী না। এই বইগুলো কিশোরদের। তবুও তা শিশুদের বোঝার মতো করে তিনি লিখেছেন। এধরনের আরেকজন লেখক পাওয়া কঠিন।

আগামী থেকে আরো প্রকাশিত হয়েছে ইমরুল চৌধুরীর ‘পরীর দেশের রাখাল রাজা’। এই বইটির প্রচ্ছদ ও অলংকরণ করেছেন রফিকুন নবী। ছোটদের বইয়ের লেখার মান যেমন ভালো হওয়া দরকার, তেমনি প্রচ্ছদ ও অলংকরণও চমৎকার হওয়া দরকার। এই দু’টি বিষয় ভালো হলে, তা শিশুদের সহজে আকৃষ্ট করে। কাজেই শিশুদের বই প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রকাশকদের প্রতিবন্ধকতাও কম নয়।

কিডস: আপনারা কেন শিশুদের বই প্রকাশ করছেন?

ওসমান গণি: আমাদের লক্ষ্যই শিশুদের জন্য কাজ করা। কারণ, ছোটবেলা থেকেই তাদের পাঠক করে তুলতে হবে। তাহলেই তারা বড়ো হয়ে বই পড়বে। আর এই দৃষ্টিভঙ্গী থেকে আমরা বড়োদের বই করার পাশাপাশি, সাধ্যমত শিশুকিশোরদের উপযোগী বই প্রকাশ করছি। এই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতেও চালু থাকবে।

কিডস: এবারের মেলায় শিশুদের জন্য কী কী বই এনেছিলেন?

ওসমান গণি: এবারের মেলার (অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩) শুরুর দিকে প্রকাশিত হয়েছে বশীর আল হেলালের গল্পের বই ‘আনারসের হাসি’। আমার মতে এই বইটি শিশুদের জন্য অত্যন্ত সুখপাঠ্য। এ ছাড়াও রফিকুল হক দাদু ভাইয়ের সমকালীন ছড়ার বই ‘বর্গি এল দেশে’ এসেছে। আরো এসেছে, চিরায়ত বইগুলোর মধ্যে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘আম আটির ভেঁপু’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ‘ছোটদের মহাভারত’ প্রভৃতি।

মাসুদ রানা, ব্যবস্থাপক: অবসর প্রকাশনী ও প্রতীক প্রকাশনী

কিডস: আপনারা প্রথম দিক থেকেই কি শিশুদের বই প্রকাশ করছেন?

মাসুদ রানা: আমরা প্রথমে পেপারব্যাক দিয়ে যাত্রা শুরু করি ১৯৮৬ সালে। শুরুতে অ্যাডভেঞ্চার ধরনের বই করা হতো, যা এখনো সেবা প্রকাশনী করছে। দেশে অফসেট মেশিন আসার পরে আমরা সম্পূর্ণ অফসেট কাগজের বই প্রকাশ করতে শুরু করি। এখন আমরা পেপারব্যাকে আর কোনো বই করি না।

কিডস: ছোটদের জন্য উল্লেখযোগ্য কী কী বই প্রকাশ করেছেন?

মাসুদ রানা: ছোটদের জন্য আমরা চিরায়ত বইগুলো নিয়েই বেশি কাজ করেছি। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ছোট ছোট গল্পগুলোকে চাররঙা ছবির মাধ্যমে প্রকাশ করেছি। এছাড়া শেক্সপিয়রের ১২টি নাটককে ছোটদের উপযোগী করে, গল্প আকারে লিখেছেন হায়াৎ মামুদ। আর ঠাকুরমার ঝুলিকে সম্পূর্ণ নতুন ভাবে প্রকাশ করেছি।

কিডস: নতুন বলতে এর বিশেষত্ব কি?

মাসুদ রানা: এই বইটির পাইরেটেড কপি আমাদের দেশে বেশি প্রচলিত ছিলো। ওগুলোর বাঁধাইও ভালো ছিলো না। এখনো এই বইটি বাংলা ও ফোকলোর বিভাগের পাঠ্য আছে নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসবের পাশাপাশি শিশুরা যাতে একটি সুদৃশ্য বই পড়তে পারে, এই বইটি সেভাবেই করা হয়েছে। এই বইটির সম্পাদনা করেছেন ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ। তিনি বইটির বড়ো করে ভূমিকা লিখেছেন, যা ছাত্রদের সহায়ক হবে।

কিডস: এসব ছাড়া ছোটদের জন্য আর কী কী প্রকাশনা আছে?

মাসুদ রানা: ‘অবসর’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে হুমায়ূন আহমেদের ‘পিপলী বেগম’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘আমরা ও ক্র্যাব নেবুলা’, বিপ্রদাস বড়–য়া’র ‘সাত সমুদ্র তের নদী’, হাসান আজিজুল হকের ‘ফুটবল থেকে সাবধান’, সৈয়দ আতিকুর রহমানের ‘বিশ্বের সেরা কিশোর ক্লাসিক’, লুৎফর রহমান রিটনের ‘ছড়াসমস্ত’, আমিরুল ইসলামের ‘সাতরঙা রূপকথা’, নাসরীন জাহানের ‘পাগলাটে এক গাছ বুড়ো’। এছাড়া প্রতীক থেকে প্রকাশিত হয়েছে হায়াৎ মামুদ সম্পাদিত ‘কিশোর রবীন্দ্র-রচনাসংগ্রহ ১ম ও ২য় খ-’, মুহম্মদ জাফর ইকবালের ‘দস্যি ক’জন’, ‘আঁখি এবং আমরা ক’জন’, হুমায়ূন আহমেদের ‘পুতুল’, ‘বোতল ভূত’, ‘তোমাদের জন্য রূপকথা’ প্রভৃতি।

তারিকুল ইসলাম রনি, প্রকাশক: তা¤্রলিপি

কিডস: তা¤্রলিপি শুরু হয় কবে থেকে?

তারিকুল ইসলাম রনি: ২০০৭ সালে, গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ক বই দিয়ে যাত্রা শুরু করে প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ‘তা¤্রলিপি’। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের উদ্যোগে, সারা বাংলাদেশে যে গণিত অরিম্পিয়াড হয়, সেই গণিত অলিম্পিয়াডের বইগুলো দিয়েই আমাদের শুরু। এরপরে আমরা কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী বইসহ সব ধরনের বই-ই প্রকাশ করতে শুরু করি।

কিডস: শিশু-কিশোরদের বই কেন প্রাধান্য পেল?

রনি: একেবারে ছোটদের বই আমরা এখনো বের করতে পারিনি। কিশোরদের বই-ই মূলত বের করি। কিশোরদের প্রাধান্য দেয়ার কারণ, আমরা মনে করি শিশু-কিশোররাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। এদের জন্য ভালো এবং নির্ভুল বই বের করতে পারলে, এরা একদিন দেশের সুনাগরিক হয়ে উঠবে। এবং সত্যিকারের পাঠক হয়ে উঠবে। আর কিশোরদের বিজ্ঞান-মনস্ক হওয়া উচিৎ। এই লক্ষ্যে আমরা বিজ্ঞান-ভিত্তিক বই-ই বেশি প্রকাশ করি।

কিডস: এ পর্যন্ত তা¤্রলিপি কোন কোন লেখকের বই প্রকাশ করেছে?

রনি: ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের বই প্রকাশ করেছি আমরা। এছাড়া ‘তিন গোয়েন্দা’ সিরিজের শুরুর লেখক রকিব হাসানের বই, ‘উন্মাদ’ সম্পাদক ও কার্টুনিস্ট আহসান হাবীবের বই করেছি। এ ছাড়াও ধ্রুব এষ, সাইদ হোসেন দারা, কায়কোবাদ, মুনির হাসান প্রমুখের বই এসেছে।

কিডস: একজন প্রকাশক হিসেবে আপনার মতে শিশু-কিশোরদের বইগুলো কী ধরনের হওয়া উচিৎ?

রনি: সবার আগে বলতে চাই, বই বিষয়ভিত্তিক হওয়া ভালো। দ্বিতীয়ত, এটা নির্ভুল হতেই হবে। বানানে কোনো ভুল থাকা চলবে না এবং পরিষ্কার ছাপা হতে হবে। বইটা পড়ে শিশুরা যেন একটা মেসেজ পায়, তাদের আত্মোন্নয়নে যেন সহায়ক হয়। তাদের মনোবিকাশে যেন সহায়তা করে।

কিডস: আর ভাষার ক্ষেত্রে?

রনি: অবশ্যই শুদ্ধ ভাষা হতে হবে। যেটা পড়ে সে শুদ্ধ ভাষা শিখবে এবং বলবে।

কিডস: একজন প্রকাশক হিসেবে কিশোরদের কী ধরনের বই পড়তে বলবেন?

রনি: অবশ্যই বিজ্ঞান  ও গণিত বিষয়ক বই পড়ার জন্য বলবো। তারা যতো এ ধরনের বই পড়বে, ততই বিজ্ঞানমনস্ক হবে। এতে তারা নিজেরা যেমন সমৃদ্ধ হবে, দেশও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাবে।

কিডস: শিশুদের বই প্রকাশের জন্য ভবিষ্যতে কী ধরনের পরিকল্পনা আছে?

রনি: এবারের মেলায় (অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৩) আমরা ২৭টি বই এনেছি যার বেশির ভাগই কিশোরদের। আমরা একটা পরিকল্পনা করে বই প্রকাশ করে থাকি। এক্ষেত্রে ২০১২-এর মার্চ থেকে যে পরিকল্পনা করেছিলাম, তার ফসল এই বইমেলা। আগামী বছরের জন্য এই মার্চ থেকেই কর্মপরিকল্পনা করবো। আমরা চাই শিশুরা বই পড়ার মধ্য দিয়ে ভালো পাঠক এবং আদর্শ নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠুক।