রহস্য উপন্যাস: অলীকের অভিযান, পর্ব ৩

পিঠে ভারি ব্যাগগুলো নিয়ে জঙ্গলের মধ্যে আমরা ধুপধাপ করে এগোতে লাগলাম। খানিক পরে পরে আমরা প্রত্যেকে পিছনে মাথা ঘুরিয়ে দেখছিলাম। কারণ মনে হচ্ছিল আমাদের ঠিক পিছনে আরো অনেক মানুষ দৌড়ে আসছে। তাদের পায়ের শব্দ আমরা পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছিলাম।

আফসানা বেগমআফসানা বেগম
Published : 14 Sept 2018, 12:51 PM
Updated : 14 Sept 2018, 12:54 PM

নয়

কিন্তু কিছু পরে আসল ব্যাপারটা বুঝতে পেরে আমার হাসি পেল আর আমি ফট করে থেমে গেলাম। আমাদের পায়ের শব্দগুলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে অনেক দূর পর্যন্ত গিয়ে আবার গাছের গায়ে বাড়ি খেয়ে আসলে আমাদেরই কানে ফিরে আসছিল।

বিজ্ঞান ক্লাসে টিচার বলেছিলেন, একে বলে প্রতিধ্বনি। মানে হলো গিয়ে বড়ো হল রুমে, জঙ্গলে বা পাহাড়ে কথা বলে ফেলার পরে চুপ করে থাকলে তোমার কথাটা আবার তুমিই শুনতে পাবে। আমরা ধুপ ধাপ শব্দে দৌড়াচ্ছি, আর আমাদের চারজনের পায়ের শব্দ আটজনের বা ষোলোজনের পায়ের শব্দের মতো শুনতে পাচ্ছি। আমি দাঁড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাকিরাও থামল। দৌড়ের টান থামাতে থামাতে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল তারা। তারপর পিছনে ঘুরে আমার কাছে ফিরে এল।

‘দৌড়াও, লোকদুটো আমাদের ধরে ফেলবে যে!’ নাভিদ বলল।

আমি হাসলাম, ‘আরে আমাদের পিছনে কেউ নেই। ওটা প্রতিধ্বনি। দেখ, এখন কোনো শব্দ নেই।’

আমার কথায় সবাই কয়েক সেকেন্ড চুপ করে শব্দ শোনার চেষ্টা করল। তারপর হাসল। বোকার মতো দৌড়াতে দৌড়াতে আমরা জঙ্গলের অনেক ভিতরে ঢুকে গেছি। চারদিকে চোখ বোলালাম। ডানে গাছ, বামে গাছ, পিছনে গাছ, সামনেও গাছ। পায়ের নিচের মাটি শুকনো আর শক্ত। এদিকে মনে হয় দিন দুয়েক বৃষ্টি হয়নি। আমরা বৃষ্টির খোঁজে পুরো ভুল পথে চলে এসেছি।

‘আমাদের এই ভুল পথে আনার জন্য দায়ি হলো গিয়ে লাল কলম,’ নিজের মনে বললাম আমি।

অনন্ত ভুরু কুঁচকে বলল, ‘লাল কলম মানে?’

তার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে বললাম, ‘না, মানে বলছিলাম, আমার পকেট থেকে লাল কলমটা যেন কোথায় পড়ে গেছে।’

সাধারণ কোনো কলম হারানোর কথায় কেউ তেমন পাত্তা দিল না। শুধু অনন্ত কেন যেন আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে থাকল। আমি উপরে গাছগুলোর মাথার দিকে তাকালাম। আমার দেখাদেখি বাকিরাও তাকাল; চোখ-মুখ কুঁচকে গেল সবার।

ওখানে নিশ্চয় অনেক রোদ, গাছের পাতা আর ডাল আমাদের গায়ে তা লাগতে দিচ্ছে না। ঠিক তেমনি এখানে বৃষ্টি এলেও আমাদের গায়ে সেভাবে পড়বে না। সিঁড়ির মতো পাতার পরে পাতার উপরে পানি পড়বে, তারপর আমাদের গায়ে লাগবে। তাতে কোনো মজা নেই। আমি বললাম, ‘আমার দাদু ছোটোবেলায় জঙ্গলে ঢুকে যেত। দাদুর কাছে শুনেছি জঙ্গলের মাঝখানে বিল আর ধানক্ষেত থাকে। চলো আরো সামনে যাই।’

আমার কথায় সবাই একমত হলো, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, চলো সামনে এগোই। ওখানে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে খুব মজা হবে।’

ব্যাগ ঘাড়ে নিয়ে আমরা চলতে লাগলাম। জিয়ন বলল, ‘এই গাছগুলোর নাম শাল গাছ, জানো তোমরা?’

আমরা জানতাম না। তার কথায় মাথা নাড়লাম। সে বলল, ‘ছবি আঁকতে গিয়ে শিখেছি। এই গাছগুলোর গোড়ার কাছে ছোটো ছোটো গাছ দেখতে পাচ্ছ? ওগুলো ওদের বাচ্চা। উপর থেকে বীজ মাটিতে পড়ে নিজে নিজেই বাচ্চা গাছ গজিয়েছে। কেউ লাগায়নি।’

জিয়নের কথা শুনে আমরা অবাক হয়ে প্রতিটা গাছের গোড়ার কাছে মাটি থেকে কয়েক ইঞ্চি উঁচু বাচ্চা গাছগুলোকে দেখতে লাগলাম। তারপর তাদের বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে পা ফেলে হাঁটতে থাকলাম। বহুক্ষণ হাঁটার পরেও চারপাশের দৃশ্য একইরকম। মানে হলো গিয়ে ডানে গাছ, বামে গাছ, পিছনে গাছ আর সামনেও গাছ। স্কুলের ব্যাগের পানির বোতলের পানি অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। নাভিদ বলল, ‘আমার খুব পিপাসা পেয়েছে। বৃষ্টি হলে ভেজার আগে বোতলে কিছু পানি ভরে নিতাম।’

‘এজন্যেই বেশি মোটা হতে নেই। মোটাদের খিদেও বেশি পায় আবার পিপাসাও,’ গম্ভীরভাবে বলল অনন্ত।

‘আজকে ছুটতে ছুটতেই মনে হয় শুকিয়ে যাব,’ নাভিদ মন খারাপ করে বলল। তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম থলথলে শরীরে বেচারার হাঁটতে আসলেই কষ্ট হচ্ছে। আমরা সবাই কমবেশি ঘামলেও তাকে দেখে মনে হচ্ছে গায়ে পানি ঢেলে দেয়া হয়েছে। কে জানে কখন আমরা পানির খোঁজ পাব। আর এটা ভাবতে ভাবতেই কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে এল, কে জানে আমরা কোনদিকে এগোচ্ছি!

সবদিকে একইরকমের গাছওলা জঙ্গলে দিকনিশানা ঠিক করা অসম্ভব। পিছনে রাস্তার দিকে ওই লোকদুটো আমাদের খুঁজতে আসতে পারে, তাদের হাতে পড়লে কী হয় বলা যায় না। আবার সামনে মানুষের বাড়িঘর যে কত দূরে তা-ও বোঝা যাচ্ছে না। আমি শুধু দাদুর কথামতো মনে মনে একটা বিল আর ধানক্ষেতের ছবি দেখতে দেখতে পা ফেলছি। যা গরম লাগছে, বিল দেখলে আমি শার্টটা খুলে রেখে নেমে পড়ব। নাভিদকে বলব যত খুশি ওই পানিই যেন খেয়ে নেয়। জঙ্গলটা একেবারে নিস্তব্ধ। শুকনো পাতার উপরে আমাদের পা ফেলার মচমচ শব্দ ছাড়া অন্য কোনো শব্দ নেই। পা ফেলতে দেরি হলে আমাদের নিশ্বাসের শব্দও শোনা যায়। তার মধ্যে জিয়ন হঠাৎ আমাদের দিকে তাকিয়ে ঠোঁটের উপরে আঙুল চেপে দাঁড়াল।

আমরা তিনজন থমকে গেলাম আর ঠোঁটে আঙুল চেপে একজন আরেকজনের দিকে তাকাতে লাগলাম। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলাম। কিছু পরে পরে একরকম শব্দ হচ্ছে। কখনো মনে হচ্ছে কেউ গাছের ডালপালা নাড়াচ্ছে, কখনো আবার মনে হচ্ছে ঝাড়– দিচ্ছে। তারপর একসময় পাখির ডাকের মতো সরু ডাক তার ফাঁকে ফাঁকে শোনা গেল। আমরা পা টিপে টিপে শব্দের দিকে এগোতে লাগলাম। জিয়ন সবচেয়ে আগে, তার পিছনে আমি। আমার পিছনে নাভিদ আর অনন্ত। অনন্ত কেন যেন বারবার পিছনে ফিরে তাকাচ্ছিল। তার তাকানো দেখে আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল এই এক্ষুণই ওই দুটো লোক পিছন থেকে এসে আমাদের চারজনকে চ্যাংদোলা করে উঠিয়ে ফেলবে। ওরকম ভাবলেই কেন যেন নিজের উপরে বিরক্ত লাগছিল। মানুষ এত ছোটো থাকে কেন যে বড়োদের সঙ্গে মারামরি করে জিততে পারে না?

জিয়ন হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। সঙ্গে সঙ্গে থেমে গেলাম আমরা তিন জন। যে শব্দটা আমরা কান পেতে শুনতে চেষ্টা করছিলাম সেটা বেশ খানিকক্ষণ ধরেই ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছিল। কিছুক্ষণ শুনলেই বোঝা যাচ্ছিল পাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ ওটা। তবে একটা পাখি নয়, কয়েকটা পাখির ডানা এলোমেলো ঝাপটাচ্ছে যেন। আর ফাঁকে ফাঁকে পাখির ডাক, ঠিক ডাক না, রাগের মতো চিৎকার। পাখিগুলো যেন রেগে গেছে। আমরা পা টিপে টিপে সেদিকে এগোতে লাগলাম। তারপর জিয়ন একসময় কিছু একটা দেখতে পেয়ে আমাদেরকে তাড়াতাড়ি যেতে ইশারা করল।

ছুটে গিয়ে দেখি একটা ঝোপের পাশে বড়োসড়ো একটা খাঁচা আর তার মধ্যে পাঁচটা পাখি। দুটো ছোটো আর তিনটা বড়ো। একটা দেখতে খুব সুন্দর, মাথাটা লাল তো পিঠটা নীল, আবার লেজটা হলুদ। অন্য তিনটা সবুজ আর লাল রঙের। একটা কালো। পাখিগুলো কী করে যেন আমাদের আসার কথা জেনে গেল। তারপর আগের চেয়েও বেশি জোরে ডানা ঝাপটাতে লাগল। চিৎকারও বাড়তে লাগল। তখন পিছন থেকে অনন্ত আমাদেরকে ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেল। পুরো জিনিসটায় উপর-নিচ চোখ বুলিয়ে বলল, ‘এটা একটা ফাঁদ। ওই দেখ, উপরে গাছের ডালে একটা পাতলা নেট বিছানো ছিল, তার উপরে খাবার দেয়া ছিল। বেচারা পাখিগুলো যখন খাবারের লোভে ওখানে বসেছে, হুট করে নেটে গিঁট লেগে গেছে আর নেটসহ তাদের টেনে এনে ঢোকানো হয়েছে এই খাঁচায়।’

তার কথা শুনে আমরা তখন কাছে গিয়ে দেখলাম অনন্ত ঠিকই ধরেছে। খাঁচাটা ঝোপঝাড়ের সরু ডালপালা আর দড়ি দিয়ে বানানো। পাখিগুলো নেটের একটা পোটলার ভিতরে বন্দি। তাদের নড়াচড়ার জায়গাও নেই। তাই হয়ত বারে বারে ডানা ঝাপটাচ্ছে।

অনন্ত বলল, ‘এখানে পাখি ধরার ফাঁদ আছে মানেই হলো গিয়ে এখানে মানুষ আছে। হয়ত খুব কাছেই আছে।’

‘মানে আমরা জঙ্গল পার হয়ে চলে এসেছি? আমি পানি খাবো,’ নাভিদ বলল।

‘চুপ করো। ফাঁদ যারা পেতে রেখেছে তারা আসার আগে পাখিগুলোকে আমাদের ছাড়তে হবে,’ অনন্ত বলল।

আমি আর জিয়ন মাথা দুলিয়ে অনন্তের কথায় রাজি হলাম। নাভিদ বলল, ‘তুমি ওদের পাখি ছেড়ে দেবে? ওরা যদি আমাদেরকে দেখে ফেলে, তবে?’

‘ওদের পাখি মানে? ধরলেই পাখি ওদের হয়ে গেল? এরা তো জঙ্গলের পাখি। এদেরকে বাজারে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করে দেবে আর সারাজীবন বেচারারা কারো বাড়ির বারান্দায় খাঁচার মধ্যে মন খারাপ করে বসে থাকবে,’ জিয়ন এগিয়ে গিয়ে বলল। আমি বললাম, ‘আসো তাহলে ওদের ছেড়ে দিই।’

খাঁচার দরজাটা খুললেও পাখিগুলো বেরোতে পারল না। সরু নেটে তাদের পায়ের নখ আটকে গেছে। জিয়ন ধীরে ধীরে একটার পর একটার নখ নেট থেকে খুলতে লাগল। ছাড়া পাওয়া মাত্র একের পর এক আমাদের থেকে বামদিকে উড়ে চলে গেল। সবার শেষে সুন্দর আর বড়ো পাখিটার পাগুলো ভয়ে ভয়ে খুলল জিয়ন। তার একটা বড়োসড়ো কমলা রঙের ঠোঁট দেখলাম। কে জানে আবার কামড়ে দেয় নাকি! আশ্চর্য, পাখিটা জিয়নকে কিছুই করল না। খাঁচা থেকে ছাড়া পেয়ে আমাদের মাথার উপর দিয়ে দুটো চক্কর দিয়ে সেই একই বামদিকে রওনা দিল। মনে হলো মাথার উপর থেকে আমাদেরকে ধন্যবাদ বলে চলে গেল পাখিটা। নাভিদ বলল, ‘সবগুলো একই দিকে গেল কেন বল তো? ওইদিকে ওদের বাড়ি নাকি?’

অনন্ত বলল, ‘আরে বোকা, বাড়ি না, ওইদিকে নিশ্চয় পানির কোনো উৎস আছে। কতক্ষণ ধরে আটকে ছিল বেচারারা, ডানা ঝাপটাতে ঝাপটাতে নিশ্চয় পিপাসা লেগে গেছে।’

‘পানি! চলো চলো, আমরাও ওদিকে যাই। আমি পানি খাবো।’

আর ঠিক তখনই মনে হলো কেউ যেন শুকনো পাতার উপরে পা রেখে মচমচ করে আমাদের দিকে আসছে। অনন্ত ইশারা দিল যেন না দৌড়াই। তাই আমরা পা টিপে টিপে পাখিদের মতো বামদিকে যেতে শুরু করলাম। কিছুদূর যেতেই আর শব্দ নেই, গাছ আর ঝোঁপের আড়ালে পাখির ফাঁদের জায়গাটাও দেখা যাচ্ছে না তখন। তার মনে ওখানে যদি কেউ এসে থাকে তো আমাদেরকেও দেখতে পাচ্ছে না। জিয়ন হাসল, বলল, ‘ভালো হয়েছে। এসে দেখবে নেটের পোটলাটা খাঁচার ভিতরে কিন্তু কোনো পাখি নেই। আর খাঁচার দরজাটাও খোলা... হা হা হা।’ নাভিদ আর আমিও জোরে জোরে হাসতে লাগলাম। অনন্ত ধমকে বলল, ‘আস্তে! ফাঁদ পাতা লোকগুলো শব্দ শুনতে পেলে সোজা এসে আমাদেরকে ধরবে।’ আমরা সঙ্গে সঙ্গে চুপ হয়ে গেলাম।

 

দশ

‘আরে ও দাদুভাই, কী হলো তোমার, এখনো লিখছ?’

অলীক চমকে উঠে কলমের খাপটা লাগায়। তারপর দাদুর দিকে তাকিয়ে হাসে। দাদু বলে, ‘তাই তো বলি, আজ আমার ঘুম ভাঙার এত পরেও দাদুভাইয়ের কোনো খবর নেই আবার ভিডিও গেমের ঠাসঠুস আওয়াজও নেই!’ দাদুর কথা শুনে অলীক লজ্জা পায়। তারপর কলমটাকে বাকসে ঢোকাতে ঢোকাতে বলে, ‘আজকের মতো লেখা শেষ।’ দাদু টেবিলের পাশে এসে খাতার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘বাব্বা, আজ মনে হয় অনেকখানি লিখলে?’

‘হুম, কলমটা যে আমাদেরকে বাস থেকে নামিয়ে জঙ্গলের ভিতরে ঢুকিয়ে দিল, তাই এখন ঝামেলা অনেক বেড়ে গেল।’

‘তাতে কিন্তু ভালোই হলো, গল্পটা অনেক বড়ো হবে।’

‘গল্প নয় তো, দাদু, আই মিন, গল্প, তবে সাধারণ গল্প নয়। ভিডিও গেমের গল্প। মানে হলো গিয়ে প্ল্যানিং।’

‘বলো কী? তাই নাকি?’

‘হ্যাঁ, যেমন মনে করো আজ যেটা লিখলাম সেখানে একটা কঠিন লেভেল ছিল। ফাঁদ খুলে কতকগুলো পাখিকে সেভ করা। তবে যারা ফাঁদ পেতেছে তারা আসার আগেই সেটা করতে হবে। না হলে মস্ত বিপদ।’

‘ওরে বাবা, আমার তো শুনেই ভয় লাগছে!’

‘সত্যি, খুবই ভয়ের ব্যাপার, দাদু। বিশেষ করে ছোটোদের জন্য। আর ওই যে বাস থেকে কিডন্যাপারের মতো দেখতে দুটো লোকের হাত থেকে পালানো, ওটা ছিল তার আগের লেভেল। ওটাও কি কম কঠিন ছিল?’

‘একদম। ভীষণ কঠিন ছিল, দাদুভাই। যারা ভিডিও গেমের গল্প লেখে, তাদের তবে অনেক ভাবতে হয়, তাই না?’

‘নিশ্চয়। তাদের কি আর বসে বসে ভিডিও গেম খেলার সময় আছে?’ বলেই অলীক হেসে ফেলে। দাদু তার চেয়েও জোরে হো হো করে হাসতে থাকে। তাদের হাসির শব্দে বুয়া ছুটে আসে। এসেই শুরু করে দেয়, ‘ভাইজান নেকি ল্যাখক হইয়া গেছেন গা। টেবিলের উপরে দুধ রাইখা গেছি, এহনো দেহি পইড়া আছে।’

দুধ খেতে খেতে অলীক বলে, ‘তবে কি জানো, দাদুভাই, গেমের লেভেল যতই কঠিন হোক, আমাদের হাতে কিন্তু অস্ত্র নেই।’

‘হায় হায়, তাহলে?’

‘তাহলে আবার কী, তুমি বলেছিলে না, অস্ত্র হাতে না থাকলে বুদ্ধিকে অস্ত্রের মতো করে ব্যবহার করতে হবে? সেটাই তো আমি করতে চাচ্ছি।’

দাদু অলীকের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।

‘আরেকটা কথা, বাবা-মাকে আমার এই গল্পটার কথা বোলো না যেন!’ অলীক দাদুকে অনুরোধ করে।

‘কেন, লেখা শেষ হলে ওদেরকে সারপ্রাইজ দেবে বুঝি?’

‘হ্যাঁ। বাবা যেমন বছর শেষ হলে কোনো জায়গায় বেড়াতে যাবার টিকেট কেটে এনে আমাদেরকে সারপ্রাইজ দেয়, তখন আমরা দূরে কোথাও থেকে ঘুরে আসি, তেমনি এটা শেষ হলে বাবা-মাকে পড়তে দেব। ওরা তখন সারপ্রাইজড হয়ে পড়তে পড়তে ওই জঙ্গল আর ভয়ানক লেভেলগুলো ঘুরে আসবে।’

‘বাহ্, খুব ভালো বুদ্ধি।’

‘বুদ্ধি না তো, কল্পনা। তুমিই তো বলেছ একে বলে কল্পনা। মানে হলো গিয়ে ঘরে বসে বসেই বেরিয়ে পড়েছি অভিযানে!’

দাদু এগিয়ে এসে অলীককে জড়িয়ে ধরে আদর করে।

 

এগারো

অনন্তের কথায় পাখির ফাঁদের মালিকের চেহারা কেমন হতে পারে ভাবতে ভাবতে আমার ভয় লেগে গেল। হতেও তো পারে লোকটা দেখতে আরেকটা কিডন্যাপারের মতো? সেদিকে তাকিয়ে আমি পিছনে পা ফেলে হাঁটতে লাগলাম। আমার দেখাদেখি অন্যরাও। পা টিপে টিপে হাঁটলেও উলটোদিকে হাঁটার জন্য শাল গাছের সঙ্গে বাড়ি খেতে লাগলাম।

কিছুক্ষণ পরে মনে হলো গাছ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। সোজা হয়ে তাকিয়ে দেখি, সে কী, এই তো সেই বিল আর বিলের পাড় দিয়ে ধানক্ষেত, ঠিক যেমনটা দাদু বলেছিল!

বিলের মধ্যে পানির উপরে অনেক ঢেউ। ছোটো ছেটো ঢেউ, মোটেও সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো নয়। কিন্তু পানির উপরটা সেই ঢেউয়ে উঁচু-নিচু হয়ে আছে। তার মাঝখানে লালচে বেগুনি শাপলা ফুটে আছে। তখন হলো কী, আমরা বিল দেখে হা করে তাকিয়ে আছি তো আছি, জঙ্গলের ভিতরে ওরকম জায়গা তো আমরা কখনো দেখিনি। এত চুপচাপ যে হঠাৎ কোনো পাখি বা বকের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। আমাদের কাছেই পানির ধারে একটা মাছরাঙা বসে আছে। মাছের অপেক্ষায় হয়ত। কিছু দূরে একটা সাদা বক ধ্যান করার মতো চোখ বুজে দাঁড়িয়ে আছে, আর দাঁড়িয়ে আছে একটা মাত্র পায়ে। দেখলে মনে হবে তার একটাই পা। কিন্তু ভালো করে তাকালে দেখা যাবে আরেকটা পা সুন্দর করে মুড়িয়ে রেখেছে। মুড়িয়ে রাখা পায়ের তখন বিশ্রাম।

আমরা যখন এইসমস্ত দেখে অবাক হচ্ছিলাম, তার মধ্যে নাভিদ ছুটে গেছে পানিতে। তার জুতো-মোজা কাদায় মাখামাখি। ধুয়ে নিয়ে বিল থেকে উঠে আসতে গেলে আবারো কাদা লেগে গেল। ফিরে গিয়ে ধুয়ে নিলে ফিরতে গিয়ে কাদা লাগল আবার। শেষে রাগ করে সে জুতোজোড়া দূরে ছুড়ে দিয়ে হাঁটুপানিতে নেমে হাতে পানি নিয়ে সমানে খেতে থাকল। জিয়ন আরেকদিকে গিয়ে পানির উপরে ভেসে থাকা কিছু লতানো গাছ থেকে কী যেন ছিঁড়তে লাগল। হাতে ভরে নিয়ে ফিরে এল আমাদের কাছে। বলল, ‘এই দেখ, এটা খাও। এর নাম পানি ফল।’ সবুজ খোসা খুলে ভিতরের সাদা ফলটা জিয়ন আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। তারপর নিজেই বলল, ‘দেখ, এটা দেখতে সিঙ্গাড়ার মতো না? বাড়ি গিয়ে আমি এটা আঁকতে চেষ্টা করব।’ আমরা সবাই অনেকক্ষণ সেখানে বসে বসে পানি ফল খেতে থাকলাম। আমাদের এক পাশে সবুজ আর বেগুনি ধরনের খোসা জমে গেল।

সেখানকার পাখি আর বকগুলো আমাদেরকে ভয় পাচ্ছিল না; আশপাশেই ঘোরাঘুরি করছিল। ভেজা ভেজা ঘাসের উপরে খুঁটে খুঁটে সারাক্ষণ কী যেন খাচ্ছিল। জিয়ন একটা লাঠি যোগাড় করে কাদার উপরে পানিফলের একটা ছবি আঁকল। অবিকল ফলটার মতোই অদ্ভুত হলো দেখতে। আমরা সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আশপাশে থেকে কাদা এসে ছবিটাকে মিলিয়ে দিল। জিয়ন একই জায়গায় একটা শাপলা আঁকল, দুদিকে দুটো পাতা পানির উপরে বিছানো। তাকিয়ে থাকতে থাকতে পাতাসহ সেটাও কাদার নিচে হাওয়া। শেষে একটা বক এঁকে পাখির ভঙ্গিতে নিজের দুহাত দুদিকে নাড়াতে লাগল। আমরাও নাড়াতে শুরু করলাম। এতগুলো হাতের নড়াচড়া দেখে বিলের এদিককার সব পাখি উড়ে আরেকদিকে রওনা দিল। তাদের ওড়া দেখে আমরা আরো বেশি বেশি করে হাত নাড়িয়ে লাফাতে লাগলাম।

ঠিক তখনই মনে হলো দূর থেকে কেউ আমাদেরকে ডাকছে। ফিরে তাকিয়ে দেখি দুজন মানুষ জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসছে, কী বলে ডেকেছে বোঝা যায়নি, তবে আমাদেরকেই কিছু বলেছে মনে হলো। কাছে এলে দেখলাম একজন বড়ো আরেকজন আমাদেরই মতো ছেলে তার সঙ্গে। বাবা আর ছেলে হতে পারে। আবার না-ও হতে পারে।

‘তুমরা ওইখানে জঙ্গলে খাঁচার মইদ্দে পাখি দেখছিলা?’ লোকটা আমাদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল। নাভিদ হিহি হি করে হাসা শুরু করল সঙ্গে সঙ্গে। নাভিদের মুখ দিয়ে কিছু বেরিয়ে যাবার আগেই আমি তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। উলটো জানতে চাইলাম, ‘কোথায় খাঁচা? কোন পাখি?’

‘ওই যে ওইদিকের জঙ্গলে আমরা ফাঁদ পাইতা রাখছিলাম। তুমরা পাখি ছাড়ছ নেকি?’ লোকটা বলল।

‘আমরা তো এইদিক থেকে আসলাম,’ বলে অনন্ত বিলের উলটো দিক দেখিয়ে দিল।

‘ও ...’ লোকটার মুখ দেখেই বোঝা গেল সে আমাদের কথা বিশ্বাস করেনি। বলল, ‘ওইদিকে কই থেইকা আসতেছ তুমরা? বাড়ি কই?’

‘বাড়ি ওইদিকেই,’ গম্ভীরভাবে বলল অনন্ত। লোকটা পাশের ছেলেটাকে নিয়ে যেই ফিরে যাবার জন্য ঘুরে দাঁড়াল, নাভিদ তার কাছে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা, এখানে রাস্তাটা কোন দিকে?’

লোকটা আমাদের দিকে কটমট করে তাকাল। তারপর আমাদের প্রত্যেকের মুখের দিকে একবার করে তাকিয়ে নিল। ‘তুমরা ওইদিক থেইকা আসতেছ আর রাস্তা কুনদিকে সেইটা জানো না?’ আমাদের সবার মুখ কাচুমাচু হয়ে গেল। কথাটা বলেই লোকটা হন হন করে জঙ্গলের দিকে চলে গেল। তারপর কিছুক্ষণ পরে শালগাছ আর ঝোঁপের আড়ালে তারা দুজন অদৃশ্য হয়ে গেল।

জিয়ন ছুটে গিয়ে নাভিদের মুখ চেপে ধরল, ‘আচ্ছা, তুমি কি কথা না বলে থাকতে পার না?’

‘আমি আবার কী করলাম! রাস্তা কোনদিকে সেটা তো আমাদের জানতে হবে, নাকি?’ নাভিদ উত্তর দিল। রাগের চোটে জিয়ন কটমট করতে লাগল। আমি তাদের দুজনের ঝগড়া মেটালাম, বললাম, ‘নাভিদের কথায় লোকটা যে উত্তর দিয়েছে তাতে বোঝা যাচ্ছে যে রাস্তা ওদিকেই।’ অনন্ত আমার কথায় খুশি হলো। বলল, ‘ঠিক। না জানলে আমরা খামোখা হয়ত আরেকদিকে চলে যেতাম।’ পাখির ফাঁদ পাতা লোকটা যেন আবার ফিরে এসে আমাদের ধরে না ফেলে সেই ভয়ে আমরা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে রাস্তার দিকে দৌড়াতে লাগলাম। খানিক পরে রাস্তা পাওয়া গেল, তবে পিচের রাস্তা নয়, জঙ্গলের মধ্যে চলার জন্য আঁকাবাঁকা ইট বিছানো রাস্তা।

অনন্ত বলল, ‘রাস্তার নিয়ম হলো একটা রাস্তা সবসময় আরেকটা রাস্তায় গিয়ে ওঠে। তাই এই রাস্তা দিয়ে চলতে চলতেই একসময় নিশ্চয় আমরা পিচের রাস্তা পেয়ে যাব।’ আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি বললাম, ‘কিন্তু সূর্য তো প্রায় ডুবে যাচ্ছে, দেখছ না রাস্তাটা বেশিদূর ভালোমতো দেখাও যাচ্ছে না?’

‘তাতে কী,’ বলে অনন্ত তার ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট টর্চ লাইট বের করল। জ্বালিয়ে দেখাল ভালোই আলো হয়। সুতরাং এখন আমরা রওনা দিতে পারি। আমরা তাই চলতে শুরু করলাম। আগে থেকেই ঠিক করে নিলাম, অন্ধকারে দূরে কারো আসার শব্দ বুঝতে পারলেই লুকানোর জন্য জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে পড়ব। সামান্য অন্ধকার নামতেই নাভিদ বলল, ‘আচ্ছা, এই জঙ্গলে কি বাঘ থাকতে পারে?’ আমি আর জিয়ন তার কথা না শোনার ভান করলাম। অনন্ত গম্ভীরভাবে বলল, ‘আমরা তো সুন্দরবনে নই, নাভিদ। হ্যাঁ, তবে সাপ থাকতে পারে, দেখে পা ফেলো।’ নাভিদ এমন ভাব করল যেন পারলে পা দুটো নিজের কোলের উপরে নিয়ে হাঁটত।

আঁকাবাঁকা রাস্তাটাতে ঘণ্টাখানেক হাঁটার পরে মনে হলো আমরা কোনো গ্রামের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছি। ঠিক গ্রাম নয়, কারণ দূরে উঁচু পিচের রাস্তা দেখা যাচ্ছে আর সেখানে হেডলাইট জ্বালিয়ে বাস-ট্রাক সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে। ওই রাস্তা পর্যন্ত পথটুকু আমাদের খুব সাবধানে যেতে হবে। কারণ গ্রামের কেউ যদি জানতে চায় আমরা কে তবে মুশকিল হয়ে যেতে পারে। প্রায়ই স্কুটার আর রিকসায় করে গ্রামে মানুষ এসে ঢুকছে। রাস্তায় তখন কিছু আলো পড়ছে। আমরা তাই রাস্তাটা ছেড়ে এলোমেলো বাড়িগুলোর পিছনে লুকিয়ে লুকিয়ে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে এগোতে লাগলাম। হঠাৎ উলটোদিক থেকে একটা স্কুটার আসাতে রাস্তাটায় বেশ আলো হয়ে গেল। আমরা কাছের একটা বাড়ির পাশে লুকিয়ে গেলাম। কিন্তু স্কুটারটা কেন যেন ওই বাড়িটার সামনেই এসে দাঁড়াল। আমরা তাই কাঠ হয়ে পাশের দেয়ালের সঙ্গে সেঁটে থাকলাম।

স্কুটারটা ঘুরে যেতেই যারা নেমেছে তারা বাড়িটার বারান্দায় উঠে দরজার তালা খুলল। তাদের কথা আর চাবি ঘোরানোর শব্দ পাচ্ছিলাম বলে আমরা সেখানেই চুপচাপ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। বাচ্চাদের যে কত ভয়! একা একা চলাফেরার ভয় আবার রাত হলে আরো ভয়। কেউ ধরে ফেললে নিশ্চিত আটকে রাখবে। বৃষ্টিতেও ভেজা হবে না আর কোনোদিন বাড়িতেও ফেরা হবে না। ওদিকে আমরা হয়ত এমন জায়গায় চলে এসেছি যেখানে বৃষ্টির তো নামগন্ধও নেই, গুমোট গরম শুধু। আর দেয়ালের সঙ্গে মিশে নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে লাগল ভয়ে।

চাবি ঘুরিয়ে দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা চিৎকার শুনতে পেলাম, ‘আমাকে ছেড়ে দাও। টাকা তো পেয়েই গেছ তোমরা, আর কী চাও...?’ কে যেন চিৎকার করে কথা বলছিল কিন্তু কথা শেষ হবার আগেই তার গায়ে একটা লাথি পড়ল বলে মনে হলো। কথার বদলে লোকটা ক্যাক করে একটা শব্দ করে চুপ হয়ে গেল। তারপর অন্য একজন বলল, ‘ওই খাড়ায়া কী দ্যাখস? দরজা লাগা।’ কেউ একজন দরজা লাগাতে বারান্দার দিকে এল আর তখনই নাভিদ দিল এক হাঁচি। লোকটা দরজার বাইরে এদিক ওদিক উঁকি মেরে বলল, ‘কে ওখানে?’

অনন্ত নাভিদের নাকটা চেপে ধরল। দেয়ালের যেদিকে অন্ধকার আমরা সেদিকে আরো বেশি করে সেঁটে গেলাম। দেয়ালের একদিকের উঁচু জানালা দিয়ে ঘরের ভিতর থেকে কিছু আলো বাইরে চলে এসেছে। লোকটা সেদিকে ভালোমতো দেখে ঠাস করে দরজা লাগিয়ে দিল। আমাদের সবার বুক থেকে একটা ভারি নিশ্বাস বেরিয়ে গেল। একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। জিয়ন ফিসফিস করে বলল, ‘এই ঘরে মনে হয় কেউ কাউকে আটকে রেখেছে। চিৎকারটা শুনতে পেয়েছিলে?’ আমরা সবাই মাথা দুলিয়ে ‘হ্যাঁ’ বললাম। জিয়ন ইশারায় নাভিদকে মাটিতে বসতে বলল। সে বসলে তার ঘাড়ের দুদিকে পা রেখে জিয়ন উঠে দাঁড়াল। তারপর উঁচু জানালাটা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চেষ্টা করল। নিচে আমরা একটুও নড়াচড়া করলাম না। দুদিক থেকে আমি আর অনন্ত জিয়নকে সোজা করে ধরে থাকলাম। খানিকক্ষণ দেখার পরে জিয়ন নামতে চাইল। নামতেই মনে হলো তার চোখমুখ ভয়ে কাঁপছে। অন্ধকারে ভালো করে বোঝা যাচ্ছিল না, তাই ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, ‘ভয় পেয়েছ নাকি? কী হয়েছে?’

‘ও...ওখানে ওরা একটা লোককে হাত পা বেঁধে আটকে রেখেছে। লোকটাকে মারছে আর চুল ধরে টানছে। তারপর... তারপর কী করল, জানো?’

আমরা ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘কী?’

‘লোকটাকে একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দিল। ইঞ্জেকশন দিতেই লোকটা মরে গেল।’

‘মরে গেল!’ আমরা প্রায় জোরে বলে ফেললাম।

‘ন..না না, মনে হয় লোকটা অজ্ঞান হয়ে গেল। মানে, ঘুমালো আর কী।’

‘ও...’

‘কিন্তু জানো, ওই লোকটাকে আটকে রেখেছে কারা?’

‘কারা?’

‘ওই যে, মানে, ওই যে যাদের জন্য আমরা...’

জিয়নের কথা শেষ না হতেই কে যেন পিছন থেকে এসে আমার গলাটা আঁকড়ে ধরল। বাকিরা সবাই চমকে সেদিকে তাকাল। আমি ঘুরতে পারছিলাম না। আমার শক্তি ওই হাতের শক্তির কাছে কিছুই না। অন্যরা মিলে হাতটাকে সরানোর চেষ্টা করলেও কিছুতেই সরানো গেল না। বরং লোকটা আমাকেসহ বাকিদেরকে টানতে টানতে দুটো সিঁড়ি, বারান্দা আর দরজা পার করে ঘরের মধ্যে নিয়ে ঢোকাল। আর তখনই আরেকটা লোক এসে দরজাটা ধড়াম করে দিল বন্ধ করে। বন্ধ করে ফিরে তাকাতেই দেখলাম সেই যে বাস থেকে যাদের ভয়ে আমরা জঙ্গলের ভিতরে পালিয়েছিলাম, তাদের একজন। আর এদিকে ঘরে ঢুকে আমার গলা থেকে অন্য লোকটার হাত আলগা হতেই ফিরে দেখলাম, হ্যাঁ, সেই লোকটাই, মানে, ওরা দুইজনই, মানে, ওরা আসলেই কিডন্যাপার!

 

বারো

‘দাদু, দাদু, দেখ কী হয়ে গেছে, দাদু....’ অলীক খাতা হাতে নিয়ে চিৎকার করে খাবার ঘরে এসে দাঁড়াল।

‘কী, কী হয়েছে বলো তো? এত চেঁচাচ্ছ কেন?’ দাদুও চিৎকার করে জবাব দিল।

‘আজও, আজও কি তুমি বলবে যে এসব তুমি লেখনি?’ অলীক দাদুর দিকে খাতা বাড়িয়ে ধরে। দাদু খাতার পাতা উলটে দেখে বলে, ‘বিশ্বাস করো, দাদুভাই, আমি লিখিনি। আমি কেন লিখতে যাব বলো? আমি তো তোমার লেখাটা শেষ হলে মজা করে পড়ব সেই অপেক্ষায় আছি।’

‘তবে, তবে কি সত্যিই কলম...’ অলীক কী বলবে বুঝতে পারে না। বুয়া হাতে গরম রুটি নিয়ে খাবার ঘরে আসে। বলে, ‘এই যে, দাদা আর নাতিতে মিল্যা নাস্তা খাইয়া লন।’

‘বুয়া, তুমি লিখতে পার?’ অলীক বুয়ার দিকে ঘুরে যায়।

‘কী কইলেন, ভাইজান?’

‘জানতে চাইলাম তুমি কি এসব লিখেছ নাকি, লিখতে পার?’ খাতা দেখিয়ে তাকে জিজ্ঞাসা করে অলীক।

‘হায় রে মর জ্বালা, পড়তে লিকতে পারলে কি আমি এইহানে কাম করতাম? আপনের মায়ের লাহান বাড়িত বুয়ারে কাজ বুঝাইয়া দিয়া অপিস যাইতাম। আমরার কপালে পড়াল্যাকা নাই গো, ভাইজান।’

‘হুম... তার মানে, তার মানে হলো গিয়ে ওই কলম, ওই কলমটাই তাহলে...’ অলীকের যেমন রাগ হয় তেমনি অবাকও লাগে।

দাদু বলে, ‘আহা, অত রেগে যাচ্ছ কেন? যা লেখা হয়েছে তার পর থেকে লিখে গেলেই তো হয়।’

‘মানে? তুমি জানো কী হয়েছে?’

‘কী?’

‘ওই যে বাসের দুটো লোক যারা কিডন্যাপারের মতো দেখতে, যাদের দেখে আমরা পালিয়ে গেলাম, সেই লোকদুটো আসলেই কিডন্যাপার আর সেই লোকদুটো আমাদেরকে ধরে ফেলেছে।’

‘বলো কী!’

‘হ্যাঁ, ধরে নিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকিয়েছে। এখন কী হবে? উহ্ আমি ভাবতেই পারছি না!’

‘কী আবার, বুদ্ধির খেলা খেলতে হবে। দেখ কী করে বেরোনো যায়।’

‘অত সহজ না। লোকদুটোর গায়ে খুব শক্তি আর ওরা আগে থেকে আরেকজন বড়ো মানুষকেও আটকে রেখেছে। কী যে হবে এখন, এই লেভেলটা কিন্তু খুব কঠিন হবে, দাদু।’

‘শোনো, দাদুভাই, কঠিন ছাড়া মজা কী? সবকিছু যদি সহজেই হয়ে যেত তবে তো কবেই আমাদের কাছে জীবনটা একেবারে বোরিং মনে হতো। ঘোড়ার রেস দেখনি যেখানে সামনে অনেকগুলো হার্ডল থাকে? ঘোড়াগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে একটার পরে একটা হার্ডল পার হয়ে যায়? সাধারণ রেসের চেয়ে ওটাই দেখতে বেশি মজা না?’

‘হুম,’ অলীক সায় দেয়।

‘জীবনটাও ওরকম। আমাদের সামনে যত বেশি হার্ডল আসবে, আমরা তত চেষ্টা করব আর তত বেশি জীবন নিয়ে ব্যস্ত থাকব। তবে হ্যাঁ, সবসময় হয়ত আমরা সাকসেসফুল হব না কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে। ওই চেষ্টাটাই বড়ো কথা।’

অলীক দাদুর কথা ভাবতে থাকে আর রুটি ছিঁড়ে মুখে পোরে। দাদু চুপচাপ খাওয়া শেষ করে বলে, ‘এই যে তুমি শান্ত হয়ে ভাবছ, এই ভাবনাটার খুব দরকার। ভাবো। দেখবে কিডন্যাপারদের হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় ঠিকই পেয়ে যাবে।’

 

তেরো

দরজা বন্ধ হতেই লোকটা আমার গলা থেকে হাতটা সরিয়ে নিল। ইস্ আরেকটু হলে নিশ্বাসই বন্ধ হয়ে গেছিল। গলার চামড়ায় লোকটার হাতের ঘড়ির ছাপ পড়ে গেছে মনে হয়। বিড়ালের বাচ্চাকে গলার পিছনে ধরলে যেমন আর কিছুই করতে পারে না, লোকটা আমাকে সেরকম কোনোভাবে ধরেছিল, হাত-পা ছুড়ে তো লাভ হলোই না, কেন যেন হাতের উপরে একটা কামড়ও বসাতে পারলাম না। তবে যেভাবে আমাদের আটকে ফেলল তাতে মনে হয় কামড়-টামড় দিলে বিপদই হতো। তার জন্য আরো বেশি মার খেতে হতো। কিন্তু এমনিতেও ওরা তো আর আমাদেরকে আদর করবে বলে ঘরে নিয়ে ঢোকায়নি!

দরজা লাগার শব্দ হতেই লোকটা আমাদের সবাইকে ঘাড়ে আর বুকে ধাক্কা মেরে মেঝেতে ফেলে দিল। মেঝেটা খুব এবড়ো থেবড়ো। তাই পড়েই আমরা ব্যথা পেলাম। নাভিদের মনে হয় পায়ে বেশ ব্যথা লাগল, সে ‘উহ্’ করে উঠল। আমাকে যে ধরে এসেছিল সে নাভিদের মুখের কাছে ঝুঁকে বলল, ‘চুপ! একদম চুপ।’

আমরা সবাই শুধু চুপ না একেবারে পাথর হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল আমি নিশ্বাস নিতেও ভুলে যাচ্ছি। মনে পড়লে একটু জোরে একবার টেনে নিচ্ছি। কেউ কারো দিকে তাকাতেও ভুলে গেলাম। সবাই মিলে তাকিয়ে থাকলাম ওই লোক দুটোর দিকে। তারা দুজনে আমাদের দিকে এগিয়ে এল, তাদের দুজনের হাত কোমরে। একে একে আমাদের চারজনের দিকে তাকাতে লাগল। আমাদের পা ভাঁজ করে হাঁটুগুলো উপরে ওঠানো। হাত মেঝের মধ্যে রেখে শরীরটা মেঝে থেকে উপরে ধরে রেখেছি।

লোকগুলো কি এখন আমাদেরকে মেরে ফেলবে? আমার কান্না পেল না, বরং খুব রাগ হলো। আমি যদি বড়ো হতাম তাহলে ওই লোকটা কিছুতেই গলা চেপে ঘাড় ধরে আমাকে এখানে ঢোকাতে পারত না। বেঁচে থাকলে আমি নিশ্চয় কোনো একদিন বড়ো হতাম। কিন্তু তখন মনে হলো মরেই যাব। আর বড়ো হওয়া হবে কি না বুঝতে পারলাম না।

লোকদুটোর চোখগুলো একইরকমের হিংস্র। নাকি হিংস্রভাবে তাকানোই তাদের অভ্যাস, কে জানে। তাদের চুলগুলোও একইরকমের কালো। কিন্তু তাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই। তারাও কি বুদ্ধির খেলা খেলে খেলেই মানুষকে কিডন্যাপ করে? হবে হয়ত। আবার অস্ত্র তাদের পকেটে থাকতেও পারে। হয়ত দরকার হলে বের করবে। আমাদের মতো ছোটোদের জন্য তাদের হাতই যথেষ্ট। বাসে তাদের মুখের দিকে অত ভালো করে খেয়াল করিনি। তারা যে আমাদের দিকে তাকিয়ে ছিল তখন সেটা দেখেও না দেখার ভান করে ছিলাম।

লোকদুটোর মধ্যে যে আমাকে ধরে এনেছে, তার মোচ আছে। আরেকজনের নেই। মোচ ছাড়া লোকটার দাঁতগুলো খুব বড়ো আর উঁচু। দেখে মনে হয় কিছু বললেই কামড়ে দেবে। নাভিদ হঠাৎ গুনগুনিয়ে কান্নার মতো আওয়াজ করতে শুরু করল। দাঁত উঁচু তাকে বলল, ‘ওই মোটকা, আর একটা শব্দ করলে চড় দিয়া দাঁত ফালায়ে দিব।’ দাঁত উঁচুর কাছে দাঁত নিশ্চয় বড়ো ব্যাপার। নাভিদের শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। জিয়ন নাভিদের ঘাড়ে উঠে ঘরের মধ্যে যে মানুষটাকে দেখেছিল তাকে আমরা কোথাও দেখতে পাচ্ছিলাম না। হয়ত এটা সেই ঘর না যেটার জানালা দিয়ে জিয়ন উঁকি দিয়েছিল। কিংবা ওরা লোকটাকে সরিয়ে ফেলেছে।

পাশে আরো ঘর আছে মনে হচ্ছিল। একটা দরজা দেখা যাচ্ছিল। আমাদের সামনে দুইবার পায়চারি করে আমাকে এদিকওদিক তাকাতে দেখে মোচঅলা বলল, ‘তারপর? বল এবার। গোয়েন্দাগিরি করস?’ আমরা চুপ করে থাকলাম। ‘আমগো বাড়িত উঁকি মারস ক্যা, হুম?’ বলে মোচঅলা হা হা করে হাসতে লাগল। ‘কিছু দেখছস নাকি, অ্যাঁ? সত্য বল, কী দেখছস?’ আমরা ততক্ষণে বুঝে ফেলেছি যে মিথ্যা বলে আর লাভ নেই। জিয়ন কাঁদতে কাঁদতে বলল, ‘তোমরা... তোমরা একটা লোককে মেরে ফেলেছ। না না, মানে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছ।’ এবারে দাঁতঅলা জিয়নের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বলল, ‘সাব্বাস! তরা তো সবই দেখছস তাইলে। উপায় নাই আর।’

‘কীসের উপায় নাই?’ আমি ভয়ে ভয়ে জানতে চাইলাম।

‘ছাইড়া দেওনের। সব দেইখা ফেললে আর ছাড়ন যায়? কী বলেন, উস্তাদ?’ বলে দাঁতঅলা মোচঅলার দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল।

আমরা ভয়ে কাঁপতে শুরু করলাম। নাভিদ বলল, ‘দেখ, বিশ্বাস করো, আমরা তোমাদের কথা কাউকে বলব না। ওই লোকটার কথাও বলব না যাকে তোমরা... সত্যি বলব না। আমাদেরকে ছেড়ে দাও।’

‘ওই মোটকা, তুই এত বোকা ক্যান রে? এইসব দেখনের পরে কেউ কাউরে ছাইড়া দেয়?’ দাঁতঅলা নাভিদের সঙ্গে এমন করে কথা বলল যেন স্কুলের টিচার ক্লাস নিচ্ছে। তারপর আদর করে নাভিদের ফোলা গাল দুটো টিপে দিয়ে বলল, ‘তা বাবুরা, আপনাদের লগে না টিচার আছিল, তেনারা কই? হা হা হা....’ তার প্রশ্ন শুনে নাভিদসহ আমরা সবাই আবার ভয়ে কাঁপতে লাগলাম। মোচঅলা তখন এগিয়ে এসে দাঁতঅলাকে বলল, ‘কিন্তু হ্যারা আমাদের চাইতে আগেভাগে এইখানে আইসা পড়ল ক্যামনে ক’ তো?’

‘হ্যারা জঙ্গলের ভিতরে দিয়া আসছে, উস্তাদ। দ্যাখতেছেন না সারা গায়ে কাদাকুদা মাখা? দূর হইছে কিন্তু হ্যারা মনে কয় বেশিরভাগ দৌড়ায়ে আইসা পড়ছে।’

‘তা ঠিক। আর আমরা তো জ্যাম দেইখা বাসের মধ্যে ঘুমাইয়াও পড়ছিলাম।’

‘পরে আপনে আবার দোকানপাটে ঘুরলেন না? ততক্ষণে হ্যারা চইলা আসছে। কিন্তু হ্যারা কি আগে থেইকাই আমগোরে ফলো করতেছিল?’ দাঁতঅলা মোচঅলাকে প্রশ্ন করল। তবে সে উত্তর দেবার আগেই নাভিদ বলল,‘না, না, আমরা তোমাদেরকে চিনি না। আমার তো বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ঢাকা থেকে বাসে চড়ে যাচ্ছিলাম,’

‘আহ্হা রে, কী সুন্দর মিথ্যা কতাও কয়। তোমগো ঢাকাত বিষ্টি অয় না?’ দাঁতঅলা ভেংচি কেটে নাভিদকে জিজ্ঞাসা করল।

‘বুচ্ছি। হ্যারা পলায়ে আসছে। স্কুল থেইকা পলাইছে। কী, ঠিক কই নাই?’ মোচঅলা আমাদের সবার গায়ের স্কুল ড্রেসের দিকে এক এক করে তাকাতে লাগল। তারপর হঠাৎ কিছু আবিষ্কারের মতো বলে উঠল, ‘আমগোর তো কপাল খুইলা গেছে রে! আমরা কষ্ট কইরা মানুষ উঠাইয়া আনি, আর হ্যারা চাইর চাইরজন অ্যামনে অ্যামনেই আইসা আমাগোর হাতে ধরা দিছে। তা কী খাবা বাবুরা? পরোটা-ডিমভাজি চলব? বিস্কুট খাবা বিস্কুট?’

আমরা বুঝতে পারলাম না হঠাৎ লোকটা এত খুশি হলো কেন। আবার আমাদেরকে মেহমানের মতো খাবারও দিতে চাচ্ছে! হঠাৎ লক্ষ্য করলাম অনন্ত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। যেন ইশারায় কিছু বলতে চাচ্ছে। নাভিদ বলল, ‘আমার সত্যিই খুব খিদে পেয়েছে।’ উস্তাদ লোকটা দাঁতঅলাকে বলল, ‘ওই যা দেহি, বড়ো রাস্তা থেইকা বাবুদের জন্য পরোটা, ডিমভাজি আর রসগোল্লা নিয়া আয়।’ তারপর পকেট থেকে টাকা বের করে তার হাতে দিতে দিতে হাসল একটু। গলা নিচু করে বলল, ‘ডিম পাড়া হাঁসরে এট্টু আদর যত্ন করতে হয়, বুঝলি?’ অনন্ত আমার দিকে তাকিয়ে থাকল। জিয়নও। শুধু নাভিদ খাবারের কথা শুনে খুশি হয়ে দাঁতঅলার যাবার অপেক্ষায় থাকল।

দাঁতঅলা যেই দরজার দিকে এগিয়েছে পিছন থেকে মোচঅলা হুঙ্কার দিয়ে উঠল, ‘ওই, তোর বুদ্ধিশুদ্ধি কি কুনোদিনও হইব না? বললাম আর চইলা গেলি? আগে দড়ি নিয়া আয়।’ দাঁতঅলা বড়ো বড়ো দাঁত দিয়ে নিজের জিভে কামড় দিল। তারপর পাশের ঘরের দরজা খুলে সেদিকে চলে গেল। নাভিদ আমার কানে কানে বলল, ‘পরোটা আনবে না, না?’ নাভিদের উপরে তখন আমার খুব মেজাজ খারাপ হলো। দাঁতঅলা গোল করে পেঁচানো দড়ি নিয়ে উপস্থিত হলো। তারা দুইজনে মিলে আমাদের চারজনের হাত আর পা শক্ত করে বাঁধল। দড়ি কাটার কথা তাদের মনে এল না, একই দড়িতে আমাদের চারজনকে একটা মানুষের মতো বেঁধে ফেলল।

নাভিদ বলল, ‘হাত বাঁধলে খাবো কেমন করে?’ মোচঅলা হাসল। দাঁতঅলার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ওই, বাবুরে কিন্তু লোকমা তুইলা খাওয়াইয়া দিবি। ব্যাচারার হাত বান্দা।’

দাঁতঅলা দরজা খুলে বাইরে যেতেই মোচঅলা দরজা লাগিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। যাবার আগে চোখ বড়ো বড়ো করে ঠোঁটের উপরে আঙুল রেখে আমাদেরকে চুপ থাকতে বলে গেল। না হলে যে ছুরি দিয়ে গলা কেটে ফেলবে, হাতের আঙুল নিজের গলায় ঠেকিয়ে সেই ইশারাও করে গেল। এই ঘরে এতকিছু হয়ে যাচ্ছে কিন্তু পাশের ঘর থেকে আটকে রাখা আরেকটা লোকের কোনো চেঁচামেচি বা চিৎকার শোনা গেল না, এটা অবাক ব্যাপার। এমনকি দাঁতঅলা যখন দড়ি আনতে গেল, দরজাটা খোলাই ছিল, তবু ওদিকের কিছু দেখাও যাচ্ছিল না আবার কিছু শোনাও যায়নি। জিয়ন কি ঠিক দেখেছিল তখন? আমার রীতিমতো সন্দেহ হলো। আবার এটা ভেবে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল যে লোকটাকে তারা ইঞ্জেকশন দিয়ে সত্যি সত্যি মেরেই ফেলেছে। আমাদেরকেও কি সেরকম করেই মারবে? হতে পারে। আমরা তাদের সব দেখে ফেলেছি, এটাই আমাদের অপরাধ।

রাগে-দুঃখে আমার কান্না পেল। শব্দ না করে আমি কাঁদতে শুরু করলাম।

মনে হলো আমার ঠিক পাশে জিয়নও আমার মতোই কাঁদছে। আরেকদিক থেকে অনন্ত কানে কানে বলল, ‘শোনো, বাসার ঠিকানা জানতে চাইলে ভুলভাল যা খুশি বলবে। আর ফোন নম্বর জানতে চাইলে বলবে মনে নেই।’ আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘কেন?’ অনন্ত বলল, ‘অত বুঝিয়ে বলা যাবে না এখন, সবাইকে বলে দাও।’ আমি কানে কানে জিয়নকে বললাম আর সে বলল নাভিদকে। নাভিদ কথাটা শুনেই ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে শুরু করল। এতে কান্নার কী হলো আমার মাথায় ঢুকল না।

পাশের ঘর থেকে মোচঅলা এসে বলল, ‘কী বাবু, বেশি খিদা পাইছে? আর এট্টু অপেক্ষা করো। এক্ষণই চইলা আসবে।’ সেই কথা শুনে নাভিদের কান্না আরো বেড়ে গেল। লোকটা তখন বাজ পাখির মতো লাফিয়ে নাভিদের সামনে বসে পড়ল আর পকেট থেকে একটা ছুরি বের করে নাভিদের নাকের উপরে ধরে বলল, ‘কান্দন বন কর। শব্দ করলে এক্কেরে প্যাটের মধ্যে ছুরি ঢুকাইয়া দিব। এই জন্যিই পোলাপানরে কিডন্যাপ করা কঠিন।’

শুনে আমি হা হয়ে গেলাম। আমাদেরকে কি তবে কিডন্যাপ করা হয়েছে! ভাবতেই আমার বুকটা কেঁপে উঠল। কিডন্যাপই তো, আমরা বাচ্চা তাই কিডন্যাপ। বড়োদের বেলায় ম্যানন্যাপ হওয়া উচিত। যেমন, একবার আমার বিড়াল হারিয়ে গেল, এত্ত সুন্দর সাদা ধবধবে বিড়ালটা আমার, গলায় লাল টুকটুকে একটা বেল্ট আর তার নিচে সোনালি ঘুঙুর ঝুলত। বাবা বলেছিল, ‘অলীকের বেড়ালটাকে কে যেন ক্যাটন্যাপ করে নিয়ে গেছে।’ আমি তখন কথাটা ঠিকমতো বুঝতে পারিনি। আমরা সেই বাসাটা বদলে অন্য বাসায় চলে এসেছিলাম কিছুদিন পরে। তার আগপর্যন্ত আমি বিড়ালটাকে আশপাশে হন্যে হয়ে খুঁজেছিলাম। কিন্তু পাইনি।

বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে আসার পর বিড়ালটার কথা আমার আরো বেশি করে মনে পড়ত। সে যদি ক্যাটন্যাপারদের হাত থেকে কোনোভাবে ছাড়া পেয়ে আমাদের সেই বাড়িটাতে ফিরে আসে? সে যদি এসে দেখে যে আমরা নেই? দিনের পর দিন মন খারাপ করে আমি ভাবতাম, বিড়ালটা কি এসেছিল? সে এসেছিল কিনা এটা আমার কাছে আজীবনের জন্য একটা ধাঁধা হয়ে থাকল।

আর এখন এই কিডন্যাপাররা কি আমাদেরকে ধরে রাখবে নাকি ছেড়ে দেবে? আমরা কি আর বাড়িতে ফিরতে পারব? বাড়ির কথা মনে পড়তেই বাবা-মা আর দাদুর কথা মনে পড়ে গেল। এমনকি বুয়ার কথাও। মা-বাবা এতক্ষণে নিশ্চয় অফিস থেকে ফিরে এসেছে। তারা সবাই মিলে কত যে দুশ্চিন্তা করছে আমার জন্য!

(চলবে...)

আগের পর্ব

অলঙ্করণ: হ্যাডলি হোপার

কিডস পাতায় বড়দের সঙ্গে শিশু-কিশোররাও লিখতে পারো। নিজের লেখা ছড়া-কবিতা, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, মজার অভিজ্ঞতা, আঁকা ছবি, সম্প্রতি পড়া কোনো বই, বিজ্ঞান, চলচ্চিত্র, খেলাধুলা ও নিজ স্কুল-কলেজের সাংস্কৃতিক খবর যতো ইচ্ছে পাঠাও। ঠিকানা kidz@bdnews24.com। সঙ্গে নিজের নাম-ঠিকানা ও ছবি দিতে ভুলো না!