মুজিব: গ্রাফিক নভেল

বঙ্গবন্ধুকে জানতে পারবে তার নিজের জবানীতেই আর এর অসাধারণ গ্রাফিক্স বাড়তি পাওনা

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2017, 02:12 AM
Updated : 27 August 2017, 05:49 PM

বইয়ের নাম: নাম মুজিব গ্রাফিক নভেল।(১২ টি খণ্ডের মধ্যে ৩ টি প্রকাশিত হয়েছে)

লেখক: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লিখিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী অবলম্বনে

প্রকাশনা সংস্থা: সেন্টার ফর রিসার্চ এন্ড ইনফোরমেশন (সিআরআই)

পরিবেশনায়: চর্চা

মুদ্রিত মূল্য: ১৫০ টাকা (প্রতি খণ্ড)

গ্রাফিক নভেল চিত্রণ: সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময়

এ বি এম সালাহউদ্দিন ষুভ

একজন মানুষকে সবচেয়ে বেশি কে জানতে পারে সে নিজে ছাড়া? সেই মানুষটি যদি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতো বিশাল ব্যক্তিত্বের একজন মানুষ হন, তাহলে নিজের সংঘর্ষময় জীবন সম্পর্কে, তাঁর জীবনে আসা সবধরণের ঘটনার ব্যাখ্যা সবচেয়ে ভালোভাবে দিতে পারবেন শুধু তিনিই। এই ঘটনাগুলো যে শুধু গল্প নয়, এগুলো বাংলাদেশ নামে দেশটির জন্মের ইতিহাস। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যে মানুষটি সবচেয়ে বেশি চেষ্টা করেছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাঁর চেয়ে ভালো আর কে বলতে পারবেন সেই সংঘর্ষগুলো কেমন ছিল? বন্দুক গুলি রক্ত আর আগুণের যুদ্ধের সঙ্গে চলা মানসিক যুদ্ধের ভয়াবহতা কত প্রবল ছিল!

আমাদের যে মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১ সালে সংঘটিত হয়েছিল সেটার সূত্রপাত কিন্তু ১৯৭১ই নয়। এর সূত্রপাত ১৯৪৭ সালে যখন ব্রিটিশরা শুধুমাত্র ধর্মের ঘনত্বের ভিত্তিতে দুটি দেশ ভারত ও পাকিস্তান রেখে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে বিদায় নেওয়া শুরু করে। বিশাল দেশ ভারতের দুই পাশে হাজার হাজার মাইল পথের আর কোটি কোটি একক সংখ্যক মানসিক দূরত্বের একটি দেশ পাকিস্তান। এখানে পশ্চিম প্রান্তের লোকেরা মানতেই রাজি না পূর্বের মানুষেরা যে আদৌ মানুষ, তারা সামগ্রিকভাবে একটি দেশ, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিমের পাকিস্তানের উপনিবেশ নয়। দুই ভূখণ্ডের মানুষের মধ্যের মানসিক ব্যবধান আর পশ্চিমের পূর্বের প্রতি বৈরী ব্যবহার কোনোদিন তাদের এক হতে দেয়নি।

দুই প্রান্তের মানুষের প্রথম বিরোধ হয় ভাষার প্রশ্নে। এরপর ধীরে ধীরে এমন কোনো ক্ষেত্র অবশিষ্ট থাকে না যেখানে পশ্চিম পূর্বের সঙ্গে প্রবঞ্চনা না করে। আর যখনই পূর্বের নেতারা একজোট হতে চায় প্রতিবাদ করতে চায় তখনই জারি করে দেওয়া হয় সামরিক শাসন। খুব শীঘ্রই বাংলার লোকেরা বুঝতে পারে এই স্বাধীনতা মিথ্যা, এহেন স্বাধীনতা তারা চায়নি কখনও।

শেখ মুজিব তখন তরুণ নেতা। তবে তিনি তাঁর প্রজ্ঞা এবং নেতৃত্বগুণে সহসাই পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের জন্য হুমকির কারণ হয়ে উঠেন। নানান কারণে নানা অজুহাতে শেখ মুজিবকে পাকিস্তানীরা জেলে আটকে রাখতেন সবসময়। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা পেশ করার পরে বছরের শুরুর ভাগেই শেখ মুজিবকে মোট আটবার কারাগারে বন্দী করা হয়। শেখ মুজিব জীবনভর এত বেশি কারাগারে গিয়েছেন যে উনার কনিষ্ঠ পুত্র রাসেল ভাবতেন জেলখানাটাই বুঝি তার বাবার বাড়ি!

১৯৬৭ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী থাকা অবস্থায় শেখ মুজিব তার জীবন একটি স্মৃতিচারণমূলক লেখা শুরু করেছিলেন। কিন্তু দেশের দায়িত্ব, অধিকার আদায়ের আন্দোলন, পশ্চিমের শাসকদের সঙ্গে মানসিক যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে তিনি সেই লেখা আর শেষ করতে পারেননি। শেষ না করা সেই লেখাটির নাম “অসমাপ্ত আত্মজীবনী” যা প্রকাশ পায় শেখ মুজিবের মৃত্যুর অনেক অনেক পরে। এই অনেক অনেক সময়টা কেন লেগেছিল সেটা আমরা কিছুক্ষণ পরে জানবো। তার আগে জেনে নেই আমাদের অসমাপ্ত আত্মজীবনী নিয়ে করা গ্রাফিক নভেলটা সম্পর্কে।

আমরা সবাই কম-বেশি কমিক পড়তে ভালোবাসি। কমিকের টিনটিন, ফ্যান্টম, আয়রন ম্যান, স্পাইডার ম্যানদের মতো শক্তি আর বুদ্ধিতে সুপার হিরোরা আমাদের কতই না মুগ্ধ করে। আমরা তাদের বই পড়ি, সিনেমা দেখি, কমিকনে তাদের মতো সাজও দেই। অথচ আমাদের কাছে একজন জলজ্যান্ত মানুষ সুপার হিরো আছেন যাকে আমরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, বড় নেতা বড়দের বিষয় ভেবে এড়িয়ে যাচ্ছিলাম!

কার্টুনিস্ট সৈয়দ রাশাদ ইমাম তন্ময় ও এ বি এম সালাহউদ্দিন ষুভ ভাবলেন, আমাদের এই সুপার হিরোটিকে কমিকের ভাষায় সহজ করে সবার কাছে এনে দিলে কেমন হয়? বঙ্গবন্ধু তো এটিই চাইতেন, সকলের কাছের মানুষ হতে। এই দুই গুণী কার্টুনিস্টের আঁকিয়ের গুণে গ্রাফিক নভেল বইতে উঠে এসেছে সহজ অথচ দৃঢ় এক তরুণ নেতা শেখ মুজিব উঠে এসেছেন তার নিজের গল্প নিয়ে।

এখন পর্যন্ত এই গ্রাফিক্স নভেলের মাত্র তিন পর্ব প্রকাশিত হয়েছে আরও নয়টি পর্ব আসা বাকি আছে। তবে শুরুতেই যেটা বলা হয়েছে এটা একটি অসম্পূর্ণ আত্মজীবনী থেকে নেওয়া হয়েছে তাই এর গল্পের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর গল্প শেষ হয় না। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গেও বঙ্গবন্ধুর গল্প শেষ হয় না। এমনকি বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর সঙ্গেও তার গল্প শেষ হয় না।

১৯৭৫ সালে ১৫ই অগাস্ট পাকিস্তানীদের রেখে যাওয়া দোসররা যখন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর বসায় গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছিল তখনও তারা জানত বঙ্গবন্ধুর গল্প এত সহজে শেষ হবার নয়, যেখানে একটা মানুষকে মারতে মাত্র একটা বুলেট লাগে বঙ্গবন্ধুর গায়ে গুলি করা হয়েছিল ১৮টি বুলেট। বঙ্গবন্ধুর চেতনা যেন চিরতরে মুছে যায় তাই বঙ্গবন্ধু পরিবারের প্রতিটি সদস্য, অনুগত কর্মচারী, আত্মীয় জ্ঞাতিকে খুঁজে বের করে করে মারা হয়েছিল। বাদ যায়নি শিশু, মা এবং মায়ের গর্ভে থাকা শিশুও।

এত বড় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর পরেও ঘাতকরা নিরাপদ বোধ করেনি। তারা পুরো বিষয়টা ধামাচাপা দিতে একটা আইন পাশ করে ফেলে, আইনটির নাম ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ। ইংরেজি Indemnity শব্দের অর্থ, security or protection against a loss or other financial burden. অর্থাৎ এটি ছিল ক্ষতি বা দায় এড়ানোর ব্যবস্থা।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশের দুইটি অংশ ছিল,

প্রথম অংশে বলা হয়েছে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বলবৎ আইনের পরিপন্থী যা কিছুই ঘটুক না কেন, এ ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টসহ কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

দ্বিতীয় অংশে বলা আছে, রাষ্ট্রপতি উল্লিখিত ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাদের প্রত্যয়ন করবেন তাদের দায়মুক্তি দেওয়া হলো। অর্থাৎ তাদের বিরুদ্ধে কোনো আদালতে মামলা, অভিযোগ দায়ের বা কোনো আইনি প্রক্রিয়ায় যাওয়া যাবে না।

ভাবতে পারো ঘাতকরা বঙ্গবন্ধুকে নিশ্চিহ্ন করার বিষয়ে কতটা মরিয়া ছিল আর বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব তাদের কতখানি অনিরাপদ বোধ করাতো?

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার আইনি বাধা অপসারণের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সংবিধান বিশেষজ্ঞদের পরামর্শে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ (রহিতকরণ) বিল, ১৯৯৬ সালে সপ্তম সংসদে উত্থাপন করা হয়। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর আইনটি বাতিল বলে সংসদে পাস হয়। ১৪ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষরের পর এটি পরিপূর্ণভাবে আইনে পরিণত হয়। এর আগ পর্যন্ত কেউ কখনও বঙ্গবন্ধুর নাম মুখে আনার সাহসও করতে পারত না। তাই বঙ্গবন্ধুর সেই আত্মজীবনী আমাদের হাতে এসে পৌছায় এত বছর পরে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে শেষ না হওয়া গল্পের লেখক হওয়ার ভার এখন আমাদের। বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে যে আনন্দভূমি করার পরিকল্পনা করেছিলেন, ভেদাভেদহীন করার চেষ্টা করেছিলেন সেটার দায়িত্ব এখন আমাদের। ১৫ই অগাস্টের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু বা বাংলাদেশকে শেষ করা যায় না। বঙ্গবন্ধু একটি আদর্শের নাম। আমদেরই এখন এই আদর্শ বাঁচিয়ে রাখতে হবে বাংলাদেশ নামক এই রক্তের বিনিময় ভূমিতে।