সমুদ্রের জাহাজ উট!

উটটার নাম খারাই উট। বাড়ি ভারতের গুজরাট প্রদেশের একটি জেলার নাম কোচ। কোচ বেশ বড়সড় একটা জেলা। এর আয়তন ৪৫ হাজার ৬শ ৭৪ স্কয়ার কিলোমিটার। মানে এই একটা জেলাই সমুদ্র বাংলাদেশের তিন ভাগের একভাগ প্রায়। তবে এই জেলার বৈশিষ্ট্য শুধু জেলার আকারে নয়, এর অনেক রকমের বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য আছে তবে সবচেয়ে অনন্য বৈশিষ্ট্যটি হচ্ছে এই জেলায় একটা উটের জাত রয়েছে যারা শুধু মরুভূমি নয়, সাগরও দিব্যি পারি দিতে পারে। এদের নাম খারাই উট।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 August 2017, 03:34 AM
Updated : 12 August 2017, 04:41 AM

ভারতের গুজরাট ও রাজস্থান এই দুই প্রদেশ মরুভূমিময় এলাকা। বিশাল মরু অঞ্চল থার মরুভূমির অংশ এই দুই প্রদেশ। তবে থারের বিস্তৃতি এই দুই প্রদেশেই সীমাবদ্ধ নয়। এই মরুভূমির ২৫ শতাংশ এলাকা পাকিস্তানেরও। বলা হয় থার সবচেয়ে প্রাণী বহুল মরুভূমি যেখানে অনেক প্রজাতির প্রাণী ও উদ্ভিদের অনন্য কিছু পাওয়া যায়। থারের যে প্রান্তে গুজরাটের কোচ জেলাটি অবস্থিত সেই প্রান্তে আরব মহাসাগর অবস্থিত। মরুভূমি অংশ পানির অপর্যাপ্ততার কারণে প্রায়ই ভীষণ খাদ্য সংকট হয়। থারে বিশেষ করে বছরে একবারের বেশি বৃষ্টিপাত খুবই বিরল ঘটনা। ফলে তীব্র খরায় মাটি শুকিয়ে যায়। উদ্ভিদ জন্মায় না। খারাই প্রজাতির উটেরা সাগর পাড়ি দিয়ে কাছের কোন দ্বীপে উঠে যেখানে প্রাকৃতিক ভাবেই একটা ম্যানগ্রোভ বন থাকে। মানগ্রোভ বনের গাছই ওদের মূল খাদ্য। এভাবে লবণ জল বা ক্ষারের মধ্যে বসবাস কারার কারণে এই উটকে খারাই উট নাম দেওয়া হয়েছে।

জাট ও রাবরি সম্প্রদায়ের লোকেরা মূলত এইসব উটদের প্রতিপালন করে। তারা মূল ভূখণ্ড থেকে অদূরে কোনো ম্যানগ্রোভ মনে ওদের নিয়ে দুই তিনদিন ছেড়ে দেয়। এরপর আবার মূল ভূখণ্ডে ফিরিয়ে আনে স্বাদু পানি খাওয়ানোর জন্য। এই উটের প্রতিপালনই এই সম্প্রদায় দুটির লোকেদের জীবিকা। এরা মূলত যাযাবর সম্প্রদায়। আজকেই এখানে তো কালই উটের পাল নিয়ে পাড়ি দিবে অন্য কোনো কোনো জায়গায়। উটের দুধই ওদের মূল খাদ্য।

খারাই উটকে বলা হয় ইকো টোনার স্পিসিস। এর অর্থ এই প্রজাতিটি সমুদ্র ও মরুভূমি দুই ধরণের ইকো সিস্টেমে দারুণভাবে বসবাস করতে পারে। অন্য উটরা সাগরে দূরে থাক পুকুর বা ছোট জলাশয়েই টিকতে পারবে না। এই বিশেষ কাজ করার জন্য খারাইদের শারীরিক গঠন বিন্যাসও কিছুটা ভিন্ন। সাধারণ উটের তুলনায় খারাইদের শরীর ছোট হয়। কিন্তু এদের মুখের আকৃতি সাধারণ উটের চেয়ে বড় হয়, কান বড় এবং ভিতরের দিকে ঢুকানো হয় এবং পাগুলোও লম্বা লম্বা হয়। এর ফলে খারাই যে পানিতে শুধু সাতার কাটতে পারে তাই নয়। খারাই পানির গভীরতা অনুযায়ী পানির নিচে কখনও সাতার কাটে কখনও হাঁটে। মোটকথা পানির নিচেও তারা ততটাই সাবলীল যতটা তারা মরুভূমির উপরে।

মজার কথা হচ্ছে উটের যে এমন একটা প্রজাতি আছে এটার কথাই লোকে জানত না। গুজরাটের এককোণে থাকা কিছু স্থানীয় জনগণ বাদে খারাইর সম্পর্কে কারও কোনো ধারণাই ছিল না। বর্তমানে কিছু এনজিও যখন খারাইয়ের প্রতিপালক যাযাবর সম্প্রদায়দের  সঙ্গে কাজ শুরু করে তখন তারা এই প্রজাতি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। এখন পর্যন্ত এই প্রজাতির নাম নথিবদ্ধ হয়নি। এমনকি ভারত সরকারও এই প্রজাতির বিষয়ে খুব বেশি জানত না। বিজ্ঞানীরা মনে করেন এটি একটি একদম অনন্য প্রজাতি এদের জিনগত বৈশিষ্ট্যও আলাদা। এছাড়াও গত প্রায় ছয় বছরে সারা পৃথিবীতে ৬২টি জাতের উট হারিয়ে গিয়েছে। শীঘ্রই এই প্রজাতির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ না করলে এটাও হারিয়ে যাবে। বিজ্ঞানীরা এটাও ভাবছেন খারাই হয়তো কোনো অনন্য প্রজাতি নয়, এটি স্থানীয় মানুষদের জীবনধারণের ফলে বিবর্তিত একটি জাত। তাই শুধু উটের জাত নয় এই জাত যাদের পরিশ্রমের ফল তাদের জীবনটাও সামনে আনা প্রয়োজন।

খারাই উটের জন্য এখন সবচেয়ে বড় হুমকি ঐ এলাকায় হওয়া বিদ্যুৎ ও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি। এসব ফ্যাক্টরির জন্য প্রচুর গাছ কাটা পরছে। ফলে উটদের পরতে হচ্ছে তীব্র খাদ্য সংকটে। কিছু জায়গা সংরক্ষিত করা হচ্ছে। যেখানে আগে উটেরা চলাচল করত সেখানে এখন ফ্যাক্টরির নিষিদ্ধ এলাকা। উন্নয়নের দেবতারা জানে না এই উন্নয়ন আসলে কাদের উন্নয়নে আসছে, কাউকে শেষ করে এই উন্নয়ন আর যাই হোক পৃথিবীর জন্য মঙ্গলজনক কিছু বয়ে আনবে না।