আল্লায় বলিয়া নাও খোল রে

আল্লায় বলিয়া নাও খোল রে ভাই সক্কলি। আল্লাহ বলিয়া খোল।। ওরে আল্লা বল নাও খোল শয়তান যাবে দূরে।।

>>মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Jan 2017, 12:40 PM
Updated : 22 Jan 2017, 12:40 PM

উপরে যে গানটি পড়লে এটা হলো বাংলাদেশের একটা জনপ্রিয় সারি গান, নৌকা বাওয়ার সময় এই গানটা গাওয়া হয়। সারি গানের বৈশিষ্ট্য হলো এই গান শুধু গাইলে হয় না। গানের সঙ্গে কাজ করতে হয়। সারি গান হলো কর্মঠ মানুষের গান যারা কঠিন শারীরিক পরিশ্রম করে আর নিজেদের উদ্দীপনা বজিয়ে রাখতে গান গায়। তবে এটা সারি গানের ইতিহাস, আমরা আজ জানবো নৌকা বাইচের সম্পর্কিত সব কথা-বার্তা।

নৌকা বাইচ কোথা থেকে আমাদের সংস্কৃতিতে যুক্ত হয়েছে সেটা বলা মুশকিল। কারণ নৌকা বাইচ বেশ প্রাচীন একটা লোক সংস্কৃতি। এটার বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে কিছু বলা সম্ভব নয়। তবে দুই ধরণের কথা প্রচলিত রয়েছে। কেউ বলে নৌকা বাইচ এসেছে জগন্নাথ দেবের স্নান যাত্রাকে উপলক্ষ করে। এই স্নান যাত্রায় যোগ দেওয়ার জন্য মাঝি-মল্লারা প্রতিযোগিতা লাগাতো কে কার আগে যেতে পারে। সেটারই বিবর্তিত রূপ নৌকা বাইচ।

আবার কেউ কেউ বলেন আঠেরো শতকে কোনো এক গাজী পীর মেঘনা নদীর এক পাড়ে দাঁড়িয়ে অপর পাড়ে থাকা তার ভক্তদের কাছে ডাকেন। সেসময় ঘাটে কোনো নৌকা ছিল না। ভক্তরা তার কাছে আসতে একটি ডিঙ্গি নৌকা খুঁজে বের করেন। সেই নৌকাটি মাঝ নদীতে ঝড় উঠে। তখন চারপাশের যত নৌকা ছিল তারা খবর পেয়ে ছুটে আসেন। সারি সারি নৌকা একে অন্যের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটে চলে। এ থেকেই নৌকা বাইচের গোড়াপত্তন হয়।

নৌকা বাইচ যেখান থেকেই আসুক এটা নদীর দেশ বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় একটা খেলা বিশেষ করে গ্রাম অঞ্চলে যেখানে অনেক অনেক নদী আছে। এটার পিছনে মূলত ভূমিকা মুসলমান শাসকদের। নবাব-বাদশাহি আমলে শাসকরা নৌ বাহিনী প্রতিষ্ঠা করে। পূর্ববঙ্গের ভাটি অঞ্চল জয় এবং রক্ষার জন্য এটা তাদের কৌশল ছিল। এদিকে বাংলার বারো ভূঁইয়ারা তো নৌবলেই মুঘল আর মগদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। বারো ভূঁইয়ার অন্যতম একজন ছিলেন মুসা খাঁ। মুসা খাঁয়ের প্রবাদতুল্য জাহাজ ছিল ‘সুন্দল’। মাঝি-মল্লাদের শক্তিতে চালিত পাল তো সেই জাহাজের ভয়ে মগ আর হামার্দ জলদস্যুরা কাঁপত। তবে দ্রুত বেগে জলদস্যুদের পিছু করতে বা যুদ্ধ শুরু করতে দরকার ছিলো দ্রুতবেগের ছিপ জাতীয় নৌকা। যেগুলো পরবর্তীতে যুক্ত হয় নৌকা বাইচে।

বাইচ একটা ফারসি শব্দ এর অর্থ বাজি। বাজি বাংলায় এসে হলো বাইজ সেটা আবার বিবর্তিত হয়ে হলো বাইচ। এই শব্দের মূল অর্থ হলো খেলা। তো নৌকা রেসে বাজি বলো অথবা খেলা বলো তার নাম হলো নৌকা বাইচ। তবে শুধু নৌকা নিয়ে চালিয়ে গেলেই তো বাইচ হলো না। এটার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ রোয়িং ফাউন্ডেশন গঠিত হয় বাইচের নিয়ম ঠিক করে দেওয়ার জন্য। বাংলাদেশে যত বাইচ হয় সেগুলোর দূরত্ব হয় ৬৫০ মিটার। আর বাইচ অনুষ্ঠিত হওয়ার সময় হলো ভাদ্র আশ্বিন মাস কারণ তখন বর্ষার পরে নদী পানিতে টৈ-টুম্বর থাকে।

নৌকা কিন্তু সব এক রকমের হয় না। কাজ এবং কোন নদীতে চালানো হবে এর উপর নির্ভর করে নৌকা ভিন্ন ভিন্ন রকমের হয়। যেমন মাল বহনকারী নৌকা বেশ বড় হয়, সেটা কিন্তু মাছ ধরার নৌকা থেকে বেশ আলাদা। আবার নদীর পানির ঘনত্ব এবং যেই নদীতে চালানো হবে তার আবহাওয়ার উপর নির্ভর করে নৌকার গঠন। যেমন লোনা পানির ঘনত্ব কম তাই সেই পানিতে যে কোনো জিনিস সহজে ডুবে যায়। এ সমস্যা থেকে বাঁচানোর জন্য সমুদ্রের কাছের নদী কর্ণফুলীতে যে নৌকা চলে তার নাম সাম্পান। এই নৌকার তলা বেশ চ্যাপ্টা যেন অনেকটা জায়গা জুড়ে ভরটা বহন করা যায়।

তবে বাইচের নৌকার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো লম্বা এবং সরু নৌকা। যেন দ্রুত পানি কেটে এগিয়ে যেতে পারে। আর যে নৌকা আগে যাবে সেই তো বিজয়ী হবে। বাইচের নৌকাদের আবার খুব সুন্দর কারুকাজ করে সাজানো হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গলুইয়ের সামনে একটা রাজহাঁস ময়ূর বা অন্য কোনো পাখির মুখ। সঙ্গে উজ্জ্বল রঙ আর কারুকাজ দিয়ে নৌকাকে সুন্দর করার একটা প্রতিযোগিতাও প্রতিযোগীদের মধ্যে দেখা যায়।

নৌকার সামনের গলুইটাকে খুব সুন্দর করে সাজানো হয়। তাতে কখনো করা হয় ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস বা অন্য কোনো পাখীর মুখাবয়ব। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয়। সর্বোপরি নৌকাটিকে দর্শকের সামনে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করে তোলার চেষ্টা থাকে।

নৌকা বাইচের নৌকা ১৫০ থেকে ২০০ ফুট পর্যন্ত লম্বা হয়। কিছু কিছু এলাকায় এর পরেও আরও চার বা পাঁচ ফুট যুক্ত করা হয়। কোথাও কোথাও নৌকার দৈর্ঘ্য ১০০-১২০ ফুটেই সীমাবদ্ধ থাকে। তবে দৈর্ঘ্য যাই হোক না কেন প্রস্থ কিছুতেই চার থেকে ছয় ফুটের বেশি রাখা হয় না। অধিকাংশ নৌকা পিছনের দিকে পানিতে মিশে থাকে আর সামনে পানি থেকে পাঁচ ফুট উপরে থাকে। এভাবে নৌকার গতি পেতে সুবিধা হয়। 

বাইচের নৌকা সাধারণত কোষা বা ছিপ জাতীয় হয়। এগুলো হালকা এবং সরু। তবে এলাকা ভেদে সাম্পান, সারেঙ্গী, গয়না এ সব ধরণের নৌকাও ব্যবহৃত হয়।

ভীষণ যত্ন নিয়ে বানানো এই নৌকাগুলোর নামও খুব সুন্দর হয়। সেই নামগুলো গতিময় কোনো জিনিসের সঙ্গে মিলিয়ে হয় যেমন, পঙ্খিরাজ, সাইমুম (মরুঝড়), ঝড়ের পাখি, তুফান মেল, অগ্রদূত ইত্যাদি।

বাইচের দিন যে এলাকায় বাইচ হবে সেখানে সাজ সাজ রব উঠে। সূর্যের আলো ফোটার সঙ্গেই বাইচের এলাকার দুই পাড়ে মানুষের ঢল নামে, প্রতিযোগী নৌকাগুলোর মাঝিরা সকালে গোসল করে পবিত্র হয়ে, নিজ নিজ দলের অন্য মাঝিদের সঙ্গে একই রঙের রুমাল বেধে, গেঞ্জি পরে নৌকায় চড়ে বসেন।  প্রতিটি নৌকায় সাত, ২৫, ৫০ বা ১০০ এরকম সংখ্যার মাঝি থাকতে পারে। মাঝিরা যখন নৌকা চালান তখন নৌকার মধ্যখানে একজন থাকেন নির্দেশ দেওয়ার জন্য। আর নৌকায় বসে এক দল গায়েন গান গেয়ে মাঝিদের উৎসাহ দেন। এই গানের তালে তালে মাঝিরা এক তালে নৌকায় বৈঠা চালান। এতে একটা তাল তৈরি হয়। এই তাল না মিললেই একে অন্যের বৈঠায় ঠুকাঠুকি খাবে কিন্তু।

তোমরা কি জানো ১৯৯০ সালে বাংলাদেশে একটা আন্তর্জাতিক নৌকা বাইচের প্রতিযোগিতা হয়েছিলো। সেবার অন্য দেশ থেকেও মাঝিরা এসেছিলেন। ভেবো না নৌকা বাইচ শুধু আমাদের দেশে জনপ্রিয়। অন্য অনেক দেশেই নৌকা বাইচ হয়। হ্যাঁ সেগুলোর নাম নৌকা বাইচ না। ভিন্ন ভিন্ন দেশ নিজ নিজ নৌকার বাইচ হয় এগুলোর নাম দেশ ভেদে ড্রাগন বোট রেস, রোয়িং বোট রেস, সোয়ান বোট রেস, কাইয়াক ও কেনিয় বোট রেস ইত্যাদি নামে পরিচিত।