কান পেতে শুনি কী বলিতে চাইছে জল্লাদখানা বধ্যভূমি

মা যাবেন মিরপুরে, টুনুও তার সঙ্গী হলো। যদিও দরদাম, কেনাকাটা এই সব বিষয়গুলো টুনুর খুব একটা ভাল লাগে না, তবুও নতুন জায়গা দেখা হবে বলে সে মায়ের সঙ্গ নিতে রাজি হয়েছে।

>>শারমিন রেজওয়ানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Dec 2016, 02:01 PM
Updated : 7 March 2017, 06:18 AM

গাড়িতে টুনু সব সময় জানালার পাশে বসে , চলন্ত গাড়িতে বসে মনে হয় পাশ দিয়ে দালানকোঠা, দোকান সবাই ছুটছে, আরও কত যে মজার দৃশ্য দেখা যায় মধ্যে মধ্যে। এই যেমন আজকে যখন তারা বেনারসি পল্লী আসার জন্য মিরপুর দশ নম্বর গোল চত্বর থেকে এগার নম্বরের দিকে কিছুটা এগিয়ে মিরপুর বেনারসি পল্লীর প্রথম গেট ধরে সামনের দিকে এগুচ্ছিল, সেখানে হঠাৎ টুনুর চোখে পড়ল বড় একটা কালো সাইনবোর্ডের ওপর সাদা বড় বড় অক্ষরে লেখা ‘এই সেই বহুল আলোচিত জল্লাদখানা।’

'জল্লাদ' নামটা তো টুনু অনেক পড়েছে রূপকথার গল্পে, রাজাদের আদেশে এরা মধ্যে মধ্যে মন্দ লোকদের মেরে ফেলে আবার দুষ্টু রাজাদের নির্দেশে ভাল লোকরাও এদের হাত থেকে রক্ষা পায় না। কিন্তু এখানে যে লিখেছে সত্যিকারের জল্লাদখানার কথা। টুনু খুব অবাক হয়ে মা'কে জিজ্ঞেস করলো- 'মা তুমি কি জল্লাদখানা লেখা সাইনবোর্ডটা দেখলে? এটা কী আসলে?"

মা খুবই ব্যস্ত ছিলেন, দ্রুত গলায় বললেন, এখানে একটা বধ্যভূমি আছে, ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়ে এখানে অনেক নিরীহ বাংলাদেশী মানুষদের হত্যা করা হয়েছিল।'এইটুকু বলেই মা ব্যস্ত হয়ে গেলেন। কিন্তু টুনুর তো কৌতূহল মেটেনি।

টুনু জানে এইসব জানার জন্য দাদাইয়ের কাছেই যেতে হবে। পরদিন ভোর ঘুম থেকে উঠে কোনরকমে নাস্তা শেষ করে দৌড় দিল টুনু দাদাইয়ের বাসায়! দাদাই বারান্দার আরাম কেদারায় বসেছিলেন, টুনুকে দেখে বললেন, কী ব্যাপার টুনু সাহেব?

-'দাদাই, কাল আমি একটা অদ্ভুত সাইনবোর্ড দেখেছি মিরপুরে, সেইটা বলতে এসেছি'- টুনু হাঁপাতে হাঁপাতে বলল।

- কী সাইনবোর্ডরে?

-কাল আম্মুর সঙ্গে মিরপুর বেনারসি পল্লী গিয়েছিলাম, সেখানে বেনারসি পল্লীর প্রথম গেট ধরে পাকা রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে একটা সাইনবোর্ডে লেখা দেখলাম "এই সেই বহুল আলোচিত জল্লাদখানা"। দাদাই, মা বললেন এখানে নাকি একটা বধ্যভূমি ছিল, তুমি আরও কিছু জানলে বলো না! আমরা সবটা জানতে ইচ্ছে করছে।

দাদাই গম্ভীর হয়ে বললেন, আজকে তারিখ কত রে টুনু? টুনি চট জলদি জবাব দিলো, ১৪ই ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস দাদাই।

সবাইকে একটু ডেকে আন। অনেক কিছু আছে বলার।

সেদিন হিন্দু মুসলমান ঝগড়ার পরে আসিফ, আসফার, লাবিব দাদাইর কাছে আসতে একটু লজ্জা পায়। ওরা দলের একদম পিছনে মুখ লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নীলাঞ্জনা সবাইরে ঠেলা গুঁতা দিয়ে সামনে গিয়ে বলল, দাদাই কেন ডেকেছো গো সবাইকে? আমরা কিন্তু আর ঝগড়া করিনি। আমরা বিজয় দিবসের প্রস্তুতি নিচ্ছি। সুদীপ্ত আর আসফার মিলে একটা পেল্লাই কাগজের প্লেন বানাচ্ছে। ওটা আমরা তোমার বাড়ির সামনে লাগাবো।

দাদাই খুব খুশি হলেন। এরপর মুখ খুললেন—

আমাদের টুনু মিরপুর গিয়েছিল। সেখানে জল্লাদখানা দেখে এসেছে। ও সেটার গল্প জানতে চায়। তাই ভাবলাম তোদেরও ডাকি।

বেলি চটজলদি জবাব দিল, জল্লাদখানা? সে তো বধ্যভূমি ছিল একটা তাই না দাদাই?

আনুশ দলের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। সে জিজ্ঞেস করল, ও দাদাই বধ্যভূমি আবার কী গো?

দাদাই এক মুহূর্ত চোখ বুজে রইলেন। টুনু ভাবল দাদাই আবার অসুস্থ হয়ে পড়ল কি-না! কিন্তু সবাইকে খুশি করে দিয়ে দাদাই মুখ খুললেন,

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে যখন স্বাধীনতা যুদ্ধ চলছিল তখন পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস দেশের সাধারণ নাগরিক, বুদ্ধিজীবী, মুক্তিযোদ্ধা,সরকারি - বেসরকারি চাকুরীজীবী ও সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের ধরে নিয়ে হত্যা করে ফেলে দেওয়ার জন্য কিছু নির্দিষ্ট স্থানকে ব্যবহার করতো। সেগুলো পরবর্তীতে বধ্যভূমি হিসেবে পরিচিত হয়। সেই সময়ে মিরপুরের অনেকগুলো জায়গাই হয়ে উঠেছিলো বধ্যভূমি, কারণ এই এলাকাটা ছিল বিহারী অধ্যুষিত, এরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অন্যতম সহযোগী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে ধরে এনে এসব বধ্যভূমিতে হত্যা করা হতো, আবার অনেক সময়ে এলাকার বিভিন্ন স্থানে শহীদ হয়েছেন এমন আরও অনেকের লাশও টেনে এনে ফেলা হতো এখানে। টুনু কাল যে জল্লাদখানার সাইনবোর্ড দেখেছিস সেটা এমন একটা বধ্যভূমি ছিল। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী আর তাদের সহযোগীরা বাংলাদেশী নিরীহ নারী-পুরুষ-শিশুদের উপর যে বিভীষিকাময় হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল তার স্মৃতি বহন করছে মিরপুর এই জল্লাদখানা বধ্যভূমি। সেই সময়ে এখানে একটা পাম্প হাউজ ছিল, মানুষকে নির্যাতনের পর শিরশ্ছেদ করে সেই পাম্প হাউজের কুয়ায় ফেলে দেওয়া হতো!

- কী ভয়ংকর, নৃশংস! আমার গা শিউরে উঠছে দাদাই! বলল টুনু।

- ভয়ংকর তো অবশ্যই। স্থানীয় বিহারীদের সহযোগিতায় এখানে ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী। স্থানীয়ভাবে এই জায়গা দুটি পরিচিত ছিল জল্লাদ খানা ও নূরী মসজিদ বধ্যভূমি নামে। ১৯৯৯ সালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর; বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ৪৬ স্বতন্ত্র পদাতিক বিগ্রেডের সহযোগিতায় এখানে খননকাজ চালায়। সেই খননে বধ্যভূমি থেকে ৭০টি মাথার খুলি ও ৫৩৭২টি অন্যান্য অস্থি উদ্ধার করা হয়। এছাড়াও পাওয়া গিয়েছিল ছেড়া জামা-কাপড়, ওড়না-শাড়ি-ফ্রক, জুতো স্যান্ডেল, মানিব্যাগ, তসবি ও ব্যক্তিগত ব্যবহারের অনেক জিনিস। এরপর ২০০৮ সালে তৎকালীন সরকার পুনরায় জল্লাদখানা কর্মসূচি শুরু করেন এবং স্থপতি রবিউল হুসাইন এর সার্বিক পরিকল্পনায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রচেষ্টায় তৈরি করা হয় “জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ”। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত নিদর্শন প্রদর্শিত হচ্ছে।

-দাদাই, আমার খুব দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে, আজই। নিয়ে চলো না প্লিজ! -যাবি! আমার হাতে অবশ্য কোন কাজ নেই। আচ্ছা যা তাহলে যার যার বাসা থেকে অনুমতি নিয়ে আয়।

দাদাই যখন গাড়ি সার্ট দিলেন তখন প্রায় দুপুর হয় হয় ভাব। ছুটির দিন বলে রাস্তায় তেমন জ্যাম নেই, কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে গেল তারা মিরপুর-১০’এ অবস্থিত জল্লাদখানা বা পাম্প হাউজ স্মৃতিপীঠে। বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠের প্রবেশদ্বারের দু’পাশে লেখা রয়েছে- “কান পেতে শুনি কী বলিতে চাইছে জল্লাদখানা বধ্যভূমি’ এবং অন্য পাশে ‘একাত্তরের গণহত্যা ও শহীদের কথা বলবে শতকণ্ঠে জল্লাদখানা বধ্যভূমি স্মৃতিপীঠ’! দাদাই বললেন, কী অদ্ভুত সুন্দর কথা, তাই নারে? কেমন শিহরণ জাগায় রক্ত। গেটের বাইরে থেকেই চোখে পরে পাশের ‘zaf’ লেখা চারতলা একটি ভবন, দাদাই সেটি দেখিয়ে বললেই ওখানে ছিল সেই কুখ্যাত ‘পাম্পহাউজ’। যে পাম্প হাউজের কূপের সামনে একাত্তরের ঘৃণ্য পাক হানাদার বাহিনী এবং আলবদর রাজাকাররা বহু নিরপরাধ বাঙালিকে ধরে এনে শিরশ্ছেদ ও হত্যা করে পানি ভর্তি কূপে ফেলে দিত।

দাদাইয়ের সঙ্গে প্রবেশ করল ওরা বধ্যভূমির ভেতরে। চারপাশ খুব নীরব, রোদের খেলা আর আলোছায়ায় নিঝুমপুরীর মতো। শুরুতে সবুজ ঘাসের ভরা ছোট্ট একটা প্রাঙ্গণ, চারপাশে শান বাধানো চলার পথ। একপাশে ‘জীবন অবিনশ্বর’ নামের একটি অবাক করা স্মৃতিস্তম্ভ। এটির পরিকল্পনা ও নির্মাণ করেছেন শিল্পী রফিকুন নবী ও মুনিরুজ্জামান। ওরা শান বাঁধনো চত্বর ধরে এগিয়ে স্মৃতিস্তম্ভের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দাদাই বললেন ভাষ্কর্যটি তোমরা ভালো করে লক্ষ করে বলো তো কী কী দেখতে পাচ্ছো?

- এখানে মনে হচ্ছে ৬ টি মৃত দেহ, একটি সূর্য, টুনু বলল।

-মৃত দেহগুলো এই বধ্যভূমির শহীদদের প্রতীক আর সূর্যটা স্বাধীন বাংলাদেশেকে নির্দেশ করছে।

-দাদাই, স্মৃতিস্তম্ভটির কিছু অংশে প্লাস্টার ছাড়া লাল রঙের ইট এবং কিছু অংশ প্লাস্টার করা দেখছি, এটাও কী কোন তাৎপর্য বহন করে?- তপু জানতে চাইল।

-হ্যাঁরে। এখানে যে লাল ইটগুলো দেখছিল ওগুলো শহীদের রক্তের প্রতীক এবং প্লাস্টার করা অংশটি আমাদের দেশের মানচিত্রকে নির্দেশ করছে। স্মৃতি স্তম্ভের পাশেই একটা কাচের বাক্সে মাটির পাত্রে অন্য একটি বধ্যভূমির মাটি দেখল তারা, এরকম আরও অনেকগুলো আধারে দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন বধ্য ভূমির মাটি এনে রাখা হয়েছে। এছাড়া কিছুদূর পরপর পুরো চত্বর জুড়ে শানবাঁধানো ফলকে লেখা রয়েছে এ যাবত খুঁজে পাওয়া দেশের বিভিন্ন বধ্যভূমির তালিকা, বহু শহীদের নাম এবং বিংশ শতাব্দীতে ঘটে যাওয়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের উল্লেখযোগ্য বর্বর গণহত্যার তথ্য।

পাশের ভবনের একটি কক্ষে ‘পাম্পহাউজের’ সেই কুখ্যাত কুপটাকে সিমেন্ট বাধাই করে ভারী কাঁচ দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে বর্বরতার স্মারক চিহ্ন হিসেবে। সেখানে লাল রঙ দিয়ে লেখা রয়েছে- ‘মাথা নত করে শ্রদ্ধা নিবেদন করি সকল শহীদের প্রতি’।

নুরী মসজিদ বধ্যভূমি খননে পাওয়া শহীদের ব্যবহার্য দ্রব্যাদির কিছু নমুনা, দেহাবশেষ সর্বসাধারণের প্রদর্শনে সযত্নে রাখা আছে এই কুপটির পাশে। কূপটি যে ঘরে রয়েছে সেই ঘরে প্রবেশের মুখে আছে একটা বেশ বড় ঘণ্টা।

-এই ঘণ্টাটাও কী এখানেই পাওয়া গেছে দাদাই?

-না নীলু, এটা এখানে পাওয়া যায়নি। এটা আসলে একটি প্রতীকী ঘণ্টা। যখন আমাদের স্পর্শে এই ঘণ্টার ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয় তখন লাখো শহীদের আত্মার সঙ্গে আমাদের নতুন প্রজন্মের আত্মার সঙ্গে এক অদৃশ্য সম্পর্ক স্থাপিত হয়। তাঁরা আমাদেরকে জানায় তাঁদের অদৃশ্য উপস্থিতি। তাঁরা সাক্ষী দেয় একাত্তরে পাকিস্তানীদের নির্মমতার।

ওরা দেখলো জল্লাদখানা স্মৃতিপীঠের আয়তন খুব বেশি বড় না, তবে ছোট্ট এই জায়গায়ই মুক্তিযুদ্ধে স্মৃতিগুলোকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চমৎকারভাবে। বাচ্চারা একে একে ঘণ্টা স্পর্শ করে শহীদদের সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক স্থাপনে সচেষ্ট হলো।

মোসলেউদ্দিন উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, ঘণ্টার আওয়াজে উড়ে যাচ্ছে কিছু পায়রা। কে বলবে ওরা শহীদদের কাছে এই প্রজন্মের বার্তা বয়ে নিয়ে গেলো কি-না!