সেদিন থেকে রাকা যেটা বুঝতে পারলো তা হলো, স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু পরীক্ষা করার আগে গাছদের জীবন ছিল না, একদিন তিনি পরীক্ষা করলেন, গাছেরা জীবন ফিরে পেল।
রাকা ভাবল, আচ্ছা এই পরীক্ষাটা সে নিজে করলে কেমন হয়? এই চিন্তাটা মাথায় নিয়ে সে স্কুল বাস থেকে নেমে বাসার পথে রওনা হলো। যেতে যেতে বাসার কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাছকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, কেমন আছিস গাছ?
গাছ কোনো জবাব দিল না।
রাকা বলল, তোদের নাকি জীবন আছে তাইলে কথা বলিস না কেন রে?
গাছ তারপরেও কোনো কথা বলল না।
তখন পাশ দিয়ে এক লোক বলে, কী করছ খুকী?
রাকা বলল, গাছের সঙ্গে কথা বলি আংকেল।
লোকটি বলল, গাছ তো কথা বলতে পারে না খুকী।
লোকটির কথায় রাকা বেশ অবাক হয়ে বল, বা রে! গাছের না জীবন আছে?
জীবন তো আছেই, কিন্তু মানুষের মতো কথা বলতে পারে না যে। রাকাকে বুঝানোর চেষ্টা করলেন লোকটি।
রাকা এবার বেশ ধাঁধাঁয় পরে গেলো, তাহলে আমাদের কথা ওরা বুঝবে কীভাবে?
লোকটি কিছুক্ষণ মাথা চুলকে বলল, আমাদের কথা ওদের বুঝতে হবে কেন তা ঠিক বুঝছি না।
লোকটিকে কথা বুঝতে না পেরে হতাশ হয়ে রাকা আশেপাশের জিনিসপত্রের বিষয়ে মনোযোগী হলো, আচ্ছা এখানে ছোট ছোট অনেক গাছ আছে দেখি।
এটা নার্সারি খুকী। এগুলা সব চারাগাছ। আমি এগুলা বিক্রি করি।
রাকা ভাবলো বিক্রি করে তার মানে টাকা লাগবে। কিন্তু রাকার কাছে টাকা নেই। সে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলো, আমাকে একটা চারা গাছ দিবেন?
লোকটি কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। তারপর বলল, একটা টব তোমাকে এমনিতেই দিয়ে দেওয়া যায়। তবে তুমি তো তা বহন করতে পারবে না। এক কাজ করো, তুমি বাসায় চলে যাও। আমি সালাম সাহেবের বাসায় টব দিয়ে আসব।
রাকা বলল নাহ আমি এটা এখনই নিতে চাই। লোকটিকে ওকে বললেন তাহলে তুমি চারাটা হাতে করে নিয়ে যাও আমি তোমাদের বসায় টব দিয়ে আসবোনে।
রাকার বাবার নাম সালাম সাহেব। এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত। মোটামুটি সবাই তাকে চিনে। নার্সারির মালিকও চিনেন।
এই চারা বোনার জন্য রাকার কাছে কোনো টব নেই। লোকটি যদিও বলেছে টব দিয়ে যাবেন, কিন্তু রাকার আর তর সইছে না। সে অনেক খুঁজে একটা মগ পেল। মগটা বেশ বড় তবে সামান্য ফেটে যাওয়ার কারণে সেটা এখন আর ব্যবহার করা হয় না। রাকা গাছের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্লাস্টিক কেটে গাছটা মগে বুনল। নার্সারির মালিক বলেছে, নিয়মিত পানি দিতে হবে, রোদ যেন পায় সে খেয়াল রাখতে হবে। রাকা গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ত হয়ে পরল।
সেদিন বিকালে কী যেন হলো, সালাম সাহেব মানে রাকার বাবা হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে গেলেন। তাকে হাসপাতালে নেওয়া হল। জানা গেল সালাম সাহেবের ডেঙ্গু হয়েছে।
ডাক্তার জিজ্ঞেস করলেন, বাসায় কোথাও জলাবদ্ধতা আছে কিনা?
সালাম সাহেব বললেন, না তো, জল আবদ্ধ থাকবে কোথায়?
ডাক্তার আবার জিজ্ঞেস করলেন, বাসায় কোনো গাছের টব আছে?
সালাম সাহেব নিশ্চিত করে বললেন, না তো, টব গাছ নেই।
ঠিক তখন রাকার আম্মা বললেন, আছে একটা গাছ, রাকা নিয়ে এসেছে।
রাকা অনেক ভেবে বুঝল না গাছ থেকে কীভাবে ডেঙ্গু হবে? সবাই তো বলে গাছ খুব ভালো, গাছ আমাদের অক্সিজেন দেয়। তাহলে?
একদিন ভয়ে ভয়ে ডাক্তার আংকেলকে জিজ্ঞেস করে ফেলল। মা এমন ভাব করছিলেন যেন এই প্রশ্ন করে রাকা বেশ ভুল করে ফেলেছে। তবে ডাক্তার আংকেল খুব সহজভাবে নিলেন। তিনি রাকাকে একটা চার্ট বের করে দেখালেন, কীভাবে গাছে জমে থাকা পানিতে এডিস নামের এক ধরণের মশা ডিম পারে। এই এডিস মশা ডেঙ্গু রোগের বাহক। ডেঙ্গু রোগটা বেশ খারাপ। মানুষের রক্তের অণুচক্রিকা নামে একটি কণিকাকে কমিয়ে দেয়। এই অণুচক্রিকার কাজ হলো, রক্তকে জমাট বাঁধানো। রাকা যদিও সব কিছু ভালো বুঝল না তবে এটা বুঝল বাসা ভিতরে গাছ লাগানো একটা বিপদজনক কাজ। সে খুবই অপরাধবোধে ভুগতে লাগলো!
কয়েকদিন লেগে গেলো সালাম সাহেবের সুস্থ হতে। তিনি বাসায় আসার আগেই কীভাবে যেন সবাই জেনে গেলো রাকার কাছে একটা কাছে একটা গাছ আছে, এই গাছের জন্য রাকার বাবার অসুখ হয়েছে। সবার কথা শুনে রাকা খুব মন খারাপ করল। তারপর বারান্দায় গিয়ে টবের গাছকে বলল, তোমার জন্য আব্বুর ডেংগু হয়েছে। সব তোমার দোষ।
সেদিনই রাকা নার্সারির লোকটিকে গিয়ে বলল, আপনার গাছ আমি একটা মগে বুনেছি। তবে মগটা আমার আর লাগবে না। আপনি গাছটাকে নিয়ে যান।
এই কয়দিন কিন্তু রাকার সঙ্গে গাছের বেশ সখ্যতা হয়েছিল। রাকা নিয়মিত গাছকে পানি দিত। গাছের সঙ্গে নানারকম কথা বলত। যদিও গাছ জবাব দিত না, কারণ গাছ তো আর মানুষের মতো কথা বলতে পারে না।তবে গাছটা একটু বড় হয়েছিলো। একটা কুঁড়ির মতো কিছু দেখাও গিয়েছিলো…
গাছটার জন্য রাকার খুব মন খারাপ হতে লাগলো। সবাই রাকাকে অনেক কথা বলে গিয়েছে। এগুলোর জন্যও খুব মন খারাপ হলো। অভিমানে রাকা বলে বসল, এই পৃথিবীতে গাছেরা যেন না থাকে, গাছ থাকলে ডেঙ্গু হয়।
সেদিন রাতে রাকা স্বপ্নে দেখল সে এমন এক জায়গায় চলে গিয়েছে যেখানে কোন গাছ নেই। রাকার খুশি হওয়ার কথা কিন্তু কেমন যেন লাগল। হঠাৎ করে তার শ্বাস নিতে কষ্ট হল, মনে হল যেন দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। রাকা বলতে লাগল, আহা কষ্ট হচ্ছে আমার।
তখন দূর থেকে কে যেন বলল, গাছ না থাকলে তো কষ্ট হবেই!
রাকা অবাক হয়ে বলল, গাছ না থাকলে কষ্ট কেন?
অদৃশ্য কেউ গুম গুম আওয়াজ তুলে বলল, গাছ না থাকলে অক্সিজেন আসবে কোথা থেকে? রোদের মধ্যে ছায়া পাওয়া যাবে কোথায়? সমুদ্রের পানি উপচে পৃথিবী ভেসে যাবে।
রাকা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, কিন্তু গাছে যে ডেংগু হয়!
গুমগুম আওয়াজ করছিলেন যিনি, তিনি যেন আরও রেগে উঠলেন, বজ্রপাতের মতো শব্দ করে চিৎকার করে বললেন, এখানে গাছের দোষ কোথায়? পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা মানুষের কাজ, গাছের না...
ঠিক এই অবস্থায় রাকার ঘুম ভেঙ্গে গেল। সকাল হয়ে গিয়েছে। রাকা ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে দেখল, সেখানে অনেকগুলো মগ। ওর মগটাও আছে। সেই গাছে কী সুন্দর একটা ফুল ফুটেছে। মগগুলোর পাশে পানি দেওয়ার একতা ঝাঁঝরি আর একটা নিড়ানিও আছে। গাছে পানি দিচ্ছে রাকার আব্বু সালাম সাহেব।
একি আব্বু, গাছ থেকে না ডেংগু হয়?
আব্বু বললেন, আরে বোকার কথা বলিস কেন? গাছ না থাকলে কি আর জীবন বাঁচে। আমি তোর গাছ নিয়ে এসেছি, আমার জন্য আর তোর আম্মুর জন্যও এনেছি। প্রতিদিন আমরা পানি দিবো আর যত্ন নিবো। গাছের গোড়ায় পানি জমে থাকলে ডেঙ্গু হয় বুঝলি? সেখানে থেকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
রাকা আর তার আব্বু এখন প্রতিদিন গাছের যত্ন নেয়।