আচারের কষ্টি বিচার

আচার বলতে আমরা কী বুঝি? খিচুরির বা ভাতের সাথে খাওয়ার জন্য টক ঝাল মিষ্টি ফল বা সবজি যেটাকে মৌসুমের শুরুতেই মা, দাদী, নানু বা অন্য কেউ বেশ করে কুটে বেছে রোদে শুকিয়ে তেল মশলা দিয়ে তুলে রেখেছে সারা বছর খাওয়ার জন্য তাই তো? 

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Nov 2016, 11:32 AM
Updated : 14 Nov 2016, 11:32 AM

এই তো, আচার সম্পর্ক আমরা কত কিছু জানি। এতটুকু জানার মধ্যেই কত কথা বের হয়ে আসলো। যেমন আচার কী দিয়ে বানানো হয়? আচার বানানো হয়, কোনো ফল বা সবজি দিয়ে, সাথে পরে তেল, লবণ, কখনও কখনও চিনি। নানান রকমের মশলা যেমন, রসুন, পেঁয়াজ, সরিষা, মৌরি, জিরা ইত্যাদি থাকে। আবার আচার কখন বানানো হয়? যখন কোনো ফল বা সবজির পূর্ণ মৌসুম থাকে যখন সেই সবজি বা ফলটা অনেক অনেক বেশী পরিমাণে পাওয়া যায় আর দামও বেশ কম হয়।

এখন যদি আমি তোমাদের বলি আচার বানানো একটা প্রযুক্তি তবে কি তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে? ঠিক আছে আমি আরও ভেঙ্গে বলছি। প্রযুক্তি হল এমন সব যন্ত্র বা পদ্ধতি যা প্রকৃতির স্বাভাবিক সীমাবদ্ধতাকে পার করতে পারে। আচার বানানো আসলে একটা পদ্ধতি, যে পদ্ধতিতে একটা ফল বা সবজিকে তার মৌসুমের পরেও বেশ কিছুদিন খাওয়ার উপযোগী রাখা যায়। বলতে পারো আচর একটা প্রাচীন প্রযুক্তি, যখন ফ্রিজ ছিল না, ড্রাইয়ার ছিল না, বড় বড় হিমাগারও ছিল না তখন ফল বা সবজিকে এমনভাবে সংরক্ষণ করে রাখা হত।

আমরা যদি আচারের উপাদানগুলো চিন্তা করি তাহলে এই প্রযুক্তি বুঝতে আমাদের আরও সুবিধা হবে। বড়রা যখন আচার বানান তখন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে তারা ফলটাকে বা সবজিটাকে রোদে শুকানোর ব্যাপারে খুব জোর দেন। দিনের পর দিন সেগুলোকে রোদে শুকান। এর মূল লক্ষ্য হল ফল বা সবজিতে থাকা পানিটা পুরো শুকিয়ে ফেলা। কারণ আর্দ্র বা পানি মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া, ফাঙ্গাস ইত্যাদি জন্ম নেয় এবং বংশ বিস্তার করে। এগুলো মূলত ফল বা সবজির পচনের কাজটা করে থাকে। তাই এদের মৃতজীবীও বলে। এখন যদি আমরা পানিটাই না রাখি তাহলে কীভাবে আর তারা জন্ম নিবে আর কীভাবেই বা বংশ বৃদ্ধি করবে?

অধিকাংশ আচারেই লবণ বা চিনির একটা গাঢ় দ্রবণ তৈরি করা হয়। এগুলোও মৃতজীবীদের বংশ বিস্তার এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে বাধা প্রদান করে। সর্বশেষে একটা তেল মাধ্যম ব্যাবহার করা হয়। ধরো কোনোভাবে যদি ভিতরে পানি থেকেও যায়, তেল এই পানি পর্যন্ত মৃতজীবীদের পৌছাতে দেয় না বা পৌঁছে গেলেও বংশ বিস্তার করতে দেয় না। এভাবে আচর অনেকদিন ফল ও সবজিকে খাওয়ার যোগ্য রাখে।

আমাদের জন্য আচার যত মজাই হোক। মৃতজীবীদের জন্য আচার বিরাট বিপদজনক জিনিস। এতই বিপদের যে ইংরেজি ভাষায় “বিরাট ঝামেলায় পড়েছি” বুঝাতে গেলে মানুষ বলে, “Getting into pickle” মানে হল, আমি বিরাট বিপদে আছি।

এখন বলো তো দেখি যে কোনো ফল বা সবজিকে এতদিন আচার বানিয়ে রাখার কারণ কী? হ্যাঁ অনেকদিন ধরে খাওয়া তো বটেই, তবে এতদিন সেই রাখার মানে হলো আমরা সেই ফল বা সবজিটার পুষ্টিও অনেকদিন ধরে পেতে পারি। এই পুষ্টি আমাদের শরীরে ভিটামিন, মিনারেল, প্রোবায়োটিক ইত্যাদির যোগান দেয়। আর হজম ভালো করতে, যকৃতকে রক্ষা করতে, বিভিন্ন রোগকে নিরাময় করতে সহায়তা করে। পাশাপাশি আচারে স্বাদ ও গন্ধ তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরণের বীজ, পাতা ইত্যাদি ব্যবহৃত হয় যেগুলোর নিজস্ব ঔষধি গুণ আছে। সেগুলো থেকে আমরা নানাও ধরণের অ্যান্টি অক্সিডেন্টও পাই।

পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কোনো না কোনো ধরণের আচার বানানো হয়। ভিন্ন ভিন্ন দেশে আচারের জন্য ব্যবহৃত ফল ও সবজি এবং আচার দেওয়ার পদ্ধতি আলাদা হয়। বেশিরভাগ সময়ই যে দেশে যেই ফল ও সবজি প্রচুর পরিমাণে জন্মায় সেই দেশে সেই ফল-সবজির আচার হয়। যেমন আমরা কি আপেলের আচারের কথা ভাবতে পারি? কিন্তু যেসব দেশে খুব আপেল হল তারা দিব্যি আপেলের আচার খায়। আমরা যেমন আমের আচার খাই। ফল সবজি তো বটেই আমাদের দেশে কিছু জায়গায় ইলিশ মাছেরও আচার দেওয়া হয়।

আচারের এত গুণ আর আচার নিয়ে এত বিশদ ইতিহাসের বিষয় মনে রাখতে আমেরিকাতে সেই ২০০১ সাল থেকে ১৪ নভেম্বর দিনটিকে আচারের দিন বা Pickle Day হিসেবে পালন করা হয়। এদিন সবাই মনে করে খাবারের সাথে আচার খায় আর এঁকে অন্যকে আচার উপহারও পাঠায়।