টিফিন

রাজুর স্পষ্ট মনে আছে তাকে টিফিন দেওয়া হয়েছিল চাইনিজ ফ্রায়েড রাইস। এই ধরণের টিফিন প্রতিদিন তাকে দেওয়া হয় না। গতকাল রাতে রাজুদের মামার বাসায় দাওয়াত ছিল। মামা বাইরে খাওয়াতে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে অনেক কিছু ছিল। থাই সুপ, ফ্রাইড রাইস, চিকেন ফ্রাই আরও অনেক কিছু।

>>রাসয়াত রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Nov 2016, 09:57 PM
Updated : 1 Nov 2016, 09:57 PM

সবাই পেট ভরে খাওয়ার পরে যা রয়ে গিয়েছিল তা প্যাকেটে করে রাজু নিয়ে এসেছে। মামাই বললেন, এই এগুলো প্যাকেট করে রাজুর জন্য নিয়ে যাও। রাজুও খুশিতে নাচতে নাচতে সেগুলো নিয়ে এলো। এরপর থেকেই রাজুর মাথায় ঘুরছে, “ইশ কখন খাবো!” চাইলে বাসায় এসেও রাজু এগুলো খেয়ে ফেলতে পারও। এমনকি রাতে ঘুমের মধ্যেও বার বার মন চাইছিল ফ্রিজ থেকে খাবারগুলো বের করে খেতে, কিন্তু সে ঠিক করেছিল একবারে স্কুলে টিফিন নিয়ে যাবে তারপর টিফিনের সময় খাবে।

বাসাতেও তাই বলা ছিল। সকালে টিফিন তাই থাকবে। রাজু তার মাকে বলে রেখেছিল ফ্রিজে রাখা সেই গত কালকের চাইনিজ খাবার যেন তাকে গরম করে দেওয়া হয় টিফিন হিসেবে। সে আজকে টিফিনে তার প্রিয় চাইনিজ খাবে।

কিন্তু ছোট মানুষরা যা ভাবে তা মনে হয় কখনও হয় না। ব্যাগ থেকে টিফিন বাক্স বের রাজু দেখলো ভিতরে সেই প্রতিদিনের মতো চিনি দেওয়া পাউরুটি। এই পাউরুটি চিনি খেতে খেতে সে বিরক্ত। সপ্তাহের ৫ দিন স্কুল থাকলে ৪ দিনই তাকে এটা খেতে হয়।

রাজুর খুব অভিমান লাগা শুরু হয়। সে নিজের মনেই ফুঁপিয়ে ঠোঁট উল্টে কেঁদে ফেলে। তাড়াতাড়ি সে চারিদিকে তাকিয়ে দেখে সবাই মজা করে যার যার টিফিন খাচ্ছে। রাজুর খুব মন খারাপ হয়, স্কুলের অন্যান্য বাচ্চারা কত মজার মজার টিফিন আনে! সেদিন রাকিব টিফিনে আনল বার্গার। রাজুর খুব ইচ্ছে করল রাকিবকে গিয়ে বলে, "দোস্ত, এক কামড় দে না।" কিন্তু রাকিব যদি লজ্জা দেয়? তাই অপমানের ভয়ে আর সে কথা বলা হয়নি। এক ছোট মানুষ স্কুলে গিয়ে যদি ভাল মতো টিফিনই খেতে না পারে তাহলে আর হয় কীভাবে?

কিন্তু রাজুর বাবা ধনী কেউ নন। তিনি ছোটখাটো ব্যবসায়ী। কীরকম ব্যবসা সেটাও রাজু ভালো মতো বুঝে না। তবে খালি বাবা বলেন, "ব্যবসার অবস্থা খারাপ।" পদার্থের তিন অবস্থা সম্পর্কে রাজু জানে, কঠিন, তরল ও বায়বীয়। কিন্তু ব্যবসার অবস্থাগুলা রাজু ঠিক বুঝে না, যদি বুঝতো, তাহলে তো বাবার ব্যবসা সে ঠিক করেই দিয়ে আসতো। রাজুর বাবার ব্যবসা ভালো হলে রাজুরই তো আসলে সুবিধা।

অথচ কয়েক বছর আগেই রাজুর বাবার ব্যবসা মনে হয় ভালোই ছিল। রাজুর মনে আছে তখনও সে টিফিন হিসেবে চিকেন ফ্রাই, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এগুলা খেতে পরতো। একবার তো বাবা সসেজ কিনে এনে দিয়েছিলেন। কী যে মজা ছিল সেই সসেজ! এমনকি তখন টিফিনে পাউরুটি দিলেও সেটা নোসিলা দিয়ে দেওয়া হতো, এখনকার মতো শুধু চিনি দিয়ে না।

টিফিন পিরিয়ড আসলে চতুর্থ পিরিয়ডের পর। রাজু প্রথম পিরিয়ডেই আবিষ্কার করেছে তার টিফিন হচ্ছে পাউরুটি চিনি। এমনিতে রাজু খুবই বাধ্য ছাত্র। টিফিনের ঘণ্টা বাজার এক মিনিট আগেও সে টিফিন বাক্স খুলে না। খুব ক্ষুধা লাগলেও না। পাছে স্কুলের কোনো নিয়ম ভেঙ্গে যায় আর শিক্ষকরা বিরক্ত হন!

কিন্তু আজকে যেটা হয়েছে তা হল, বাংলা ক্লাসে বাংলা বই বের করতে গিয়ে রাজু দেখলো টিফিন বক্সের বাইরের দিকে একটু চিনি লাগানো আছে। রাজু তো অবাক, চাইনিজ খাবারে চিনি আসলো কোথা থেকে? যেই না সন্দেহ হলো সাথে সাথে রাজু ক্লাস চলাকালীন সময়েই টিফিনের বাক্স বের করে দেখলো সেখানে চিনি দেওয়া পাউরুটি।

এমনকি সেই টিফিন বাক্স দেখতে গিয়ে একটা অঘটনও ঘটে গেছে। বাংলা স্যার ক্ষেপে গিয়েছেন, বলেছেন, এই এই ক্লাসে কীসের টিফিন? কানে ধরে দাড়া। তারপর আর কী? সেই ক্লাস কানে ধরেই দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।

চতুর্থ পিরিয়ড ছিল অংক ক্লাস। কিন্তু রাজুর যেহেতু মন খারাপ তাই সে অন্যকিছু চিন্তা করতে থাকলো। সে চিন্তা করতে লাগলো, গতরাতে মামা যখন বাসায় আসলেন, মামা বললেন, কিরে রাজু কেমন আছিস? রাজু বলল, বেশি ভাল না মামা।

মামা বললেন, কেন রে কী হয়েছে?

- আজকে আম্মা ভাত রান্না করেছে কাচকি মাছ দিয়ে। এটা কোনো মাছ হল বলো?

- তাই তো। তা তোর জানি কোন মাছ খেতে ভালো লাগে?

- আমার চিংড়ি মাছ ছাড়া কোনো মাছ ভাল লাগে না।

- বলিস কী! চিংড়ি তো আর মাছ না, সেটা তো পোকা।

- ওরে বাবা! সত্যিই মামা?

- সত্যি নয়তো কি মিথ্যা? তার মানে তোর কোন মাছই ভাল লাগে না। তাহলে খাবি কী?

- মুরগি খাব।

- মুরগি তোর খুব পছন্দ না-কি রে?

রাজু দুইদিকে হাত মেলে মাথা যতটা সম্ভব ঝাঁকিয়ে বলল, হ্যাঁ মামা, খুউউউব...

মামা বললেন, আচ্ছা চল আজকে তোকে চাইনিজ খাওয়াই।

রাজুর খুশি আর ধরে না। তারপর তারা চাইনিজ খেতে গেল।

তারপর আর কি, রাজু মনে করেছিল টিফিনেও চাইনিজ খাবে তবে সেটা আর হল না। হঠাৎ রাজুর মনে পড়লো আচ্ছা, গতরাতে তো আম্মা একটা টিফিন বাক্সও কিনেছিল। সেটা কই?

রাজুর মনে আছে, চাইনিজ খেতে যাওয়ার সময় রাজুর আম্মা বলেছিল, রাজুর টিফিন বাক্সটা পুরানো হয়ে গেছে এখন নতুন একটা কিনি।

তার মানে আম্মা নতুন টিফিন বাক্সটার কথাও ভুলে গেছে, দিক পাউরুটি, অন্তত নতুন বাক্সেই দিত।

রাজু কী মনে করে যেন ব্যাগের ভিতরে হাত দিল। ব্যাগের মধ্যে একটু ভিতরের দিকে বই খাতার মাঝে সে নতুন বাক্সটাও খুঁজে পেল। সেটা বের করার প্রয়োজন হয় নাই। রাজু বাক্সটা কাছে নিয়ে গন্ধ শুকেই বুঝতে পারল এটাই সেই চাইনিজ খাবার। এটাই তার আজকের টিফিন। তাহলে পাউরুটি মনে হয় বুয়া ভুলে দিয়ে দিয়েছিল।

সেদিন চতুর্থ পিরিয়ডের পর রাজুর টিফিন ছিল চাইনিজ খাবার। রাজুর ইচ্ছা করছিল সবাইকে ডেকে ডেকে বলতে যে আজকে তার টিফিন কত ভালো। কিন্তু বন্ধুদের কী আর শুধু বলা যায়? তাই সবাইকে এক দুই চামচ খায়িয়েও দিয়েছে।

খাওয়া-টাওয়া শেষে একটা খুব আজব ঘটনা ঘটলো, রাকিব হঠাৎ রাজুকে জড়িয়ে ধরলো। রাজু তো অবাক! কিন্তু রাকিব ছাড়েই না। রাজুকে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে রাকিব বলল, দোস্ত আমি অনেক সরি! রাজু বলল, কেন সরি রে? রাকিব বলল, রোজ তুই পাউরুটি চিনি খাস আমি কোনোদিন এটা দেখতে আসি না। এমনকি আমার কাছে ভালো কিছু থাকলেও তোকে খেতে বলি না। তুই মাত্র একদিন ভালো খাবার এনেছিস আর আমাদের সবাইকে খেতে দিলি!

রাকিবের কথায় রাজু খুব লজ্জা পেলো। রাকিব রাজুকে আরও শক্ত করে ধরে বলল, আজ থেকে আমরা যাই টিফিন আনবো তা ভাগ করে খাবো। রাজু বলল, ভেবে দেখ আমি কিন্তু কাল থেকেই আবার পাউরুটি চিনি আনবো। রাকিব হেসে বলল, তাহলে অর্ধেকটা আমাকে দিস, বার্গার যা ঝাল, এরপর মিষ্টি খেতে আমার ভালোই লাগবে।