সায়ন্তনের মা যে রাতে বিদেশ গেল

সায়ন্তনের বয়স যেদিন তিন বছর দশ মাস চব্বিশ দিন, ঐ দিন সন্ধ্যায় ওর মা অফিসের একটা কাজে বিদেশে গেলেন। চারদিন থাকবেন। এর আগে একটা রাতও সায়ন্তন আর তার মা আলাদা থাকেনি। প্রতি রাতেই টুনটুনির গল্প, রাজার নাক কাটার গল্প এসব শুনতে শুনতে মায়ের গায়ে সেঁটে থেকে ঘুমায় সায়ন্তন। সন্ধ্যায় মা যখন গাড়িতে চেপে বিদেশ যাবার জন্য এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হবার জন্য তৈরি তখন মা-ছেলে দু’জনেরই ভারি মন খারাপ। সায়ন্তন কাঁদে, আর মা-ও চোখ মুছে লুকিয়ে।

আসমার ওসমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Oct 2016, 09:02 PM
Updated : 19 Oct 2016, 09:02 PM

ওই রাতে বিছানায় ওরা দু’জন। সায়ন্তন আর তার বাবা। অন্য সবসময় ওরা তিনজন থাকে। একদিকে মা, অন্যদিকে বাবা, মধ্যেখানে সায়ন্তন। ঘুম আসছে না দু’জনেরই। মনে পড়ছে মায়ের কথা। সয়ন্তন বাবার গা ঘেঁষে শুয়ে ছল ছল চোখে জিজ্ঞেস করল, “বাবা, বিদেশ কত দূর?”

“অনেক দূর।”

“বিদেশ কি চিড়িয়াখানার চেয়েও দূরে?”

“হ্যাঁ, সোনা।”

“ওরে বাবা, তাহলে তো অনেক দূর।”

“হ্যাঁ, বাবা অনেক দূর।”

“একটুক্ষণ চুপ করে থেকে সায়ন্তন আবার বলল, বাবা বাবা, মা বিদেশ গেল কেন?”

“অফিসের কাজে গেল, বাবা। চাকরি করলে এমন মাঝেমধ্যে যেতে হয়।”

“মা, চাকরি করে কেন বাবা?”

“চাকরি করলে বেতন দেয়। আর ঐ বেতনের টাকা দিয়ে তোর জন্য চকোলেট, স্ট্রবেরি সিরাপ, খেলনা এসব কিনতে পারে তোর মা।”

কী ভেবে প্রশ্ন করে সায়ন্তন, তুমিও তো চাকরি করো। তুমিও তো চকোলেট স্ট্রবেরি সিরাপ, খেলনা এসব আমাকে কিনে দিতে পারো। তাহলে মা চাকরি করে কেন? মা যদি চাকরি না করত তাহলে তো বিদেশ যেতেও হতো না আর আমার এত মন খারাপও হতো না। দেখো, আমার এত মন খারাপ যে কান্না পেয়ে যাচ্ছে।”

বাবা সায়ন্তনকে শক্ত করে পেঁচিয়ে ধরে একটা চুমু দিয়ে বললো, “হ্যাঁ, আমিও তোকে হয়তো এগুলো দিতে পারি, কিন্তু তখন তো মা আর এগুলো তোকে দিতে পারত না। যেমন গত সপ্তায় আমি তোর জন্য একটা টম অ্যান্ড জেরির ডিভিডি আনলাম, আর তোর মা আনল একটা বড় কৌটা ভর্তি চকোলেট। যদি মা চাকরি না করত তাহলে ঐ চকোলেট পেতি কেমন করে?”

“আমার চকোলেট চাই না”, গাল ফুলিয়ে বলে সায়ন্তন, “তুমি মাকে ফোন করে বলে দাও যে আমার চকোলেট লাগবে না। মা যেন চাকরি না করে এখনই বিদেশ থেকে বাসায় ফিরে আসে।”

“কিন্তু এখন ফোন করবো কী করে?” বাবা বলে, “মা তো এখন প্লেনের মধ্যে আকাশে। প্লেন যখন আকাশে থাকে তখন ফোন কন্ধ হয়ে যায়। ফোন করা যায়না। কিন্তু, বাপ আমিও তো বিদেশে গিয়েছিলাম অফিসের কাজে ক’মাস আগে। তখন যেমন মা’র কাছে লক্ষী হয়ে ছিলি তুই, তেমনই এবার থাকবো তুই আর আমি। তাছাড়া, শুধু আমি কেন দাদাভাই আছে, দাদিমা আছে, খালামনি আছে, ফুপি আছে আমরা সবাই তোর সাথে অনেক মজা করব। দেখবি, দেখতে দেখতে চারদিন কেটে যাবে মা চলে আসবে।”

“না, এসব বললে হবে না”, একটু কেঁদে ওঠে সায়ন্তন “মাকে আমার চাই এখনই। এক্ষুনি চাই।”

“আচ্ছা, মা প্লেন থেকে নামলে ফোন করব আমরা। এখন কত রাত হয়ে গেছে রাত একটা। আয়, আমার হাতে শুয়ে ঘুমা। আমি তোকে কিং কং-এর গল্প শুনাই?”

“কিং কিং আর গডজিলা সায়ন্তনের খুব প্রিয়। প্রিয় ব্যাটম্যান, ব্যাটগার্ল আর জোসর-ও। তাই কিং কিং এর গল্পের কথা শুনে সে একটু শান্ত হয়। বাবা হাতে শোয়, কোল বালিশটা দু’পায়ের মাঝে রেখে বলে, কিন্তু বাবা, কিং কং আর গরজিলা না বিদেশে থাকে।”

“হ্যাঁ, বিদেশেই তো থাকে।”

“বলে কী?” গলায় উত্তেজনা নিয়ে বলে সায়ন্তন, “তাহলে তো মা’র খুব বিপদ। মা তো বিদেশেই গেল। কিং কং গডজিলার লড়াই বাঁধলে তো চারদিকের সব মানুষ একদম ভর্তা হয়ে যায়। তাহলে কী মাও ভর্তা হয়ে যাবে?”

“না না, তোর মা’র তো অনেক সাহস আর শক্তি। কিং কং গডজিলা ওরা কেউই মা’র কিছু করতে পারবে না। বরং, ওরা মাকে দেখে ভয়ে কাঁপবে।”

যেন হাফ ছেড়ে বাঁচে সায়ন্তন। বলে, “জানো বাবা, আমারও না অনেক শক্তি! আজ যখন সন্ধায় মা গাড়ি নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে রওয়ানা হলো, তখন আমি গাড়ির চে’ও জোরে দৌড় দিয়ে গাড়ির কাছে চলে গেলাম। তখন মা গাড়ির জানালা খুললো। আমি মাকে তিরিশটা চুমু দিলাম। মা অনেক খুশি হলো। আমি মাকে বললাম, দেখলে আমি তোমাকে এত ভালোবাসি যে উসাইন বোল্ট এর চেয়েও জোরে দৌড়ে এসে তোমাকে চুমু দিলাম।”

“উসাইন বোল্ট কে?”

‘উসাইন বোল্টকে চেনো না?’ বাবার অজ্ঞতায় ভারি মজা পায় সায়ন্তন, “অলিম্পিকে সবচেয়ে জোরে দৌড়িয়ে সোনার মেডেল পেয়েছে। কিন্তু যদি আমি অলিম্পিকে যেতাম, তাহলে কি উসাইন বোল্ট পারত জিততে?”

“প্রশ্নই ওঠে না”, বাবা জানায়, “আমাদের সায়ন্তন গেলে জিততো সায়ন্তনই। হেরে কাঁদতে কাঁদতে ভারি ফিরতে হতো উসাইন বোল্টকে।”

বাবা এমন উত্তরে ভারি খুশি হয় সায়ন্তন। সন্ধ্যার পর থেকে এই গভীর রাতে এসে প্রথমবারের মতো হাসি ফোটে সায়ন্তনের মুখে।

“বাবা, তাহলে এর পরেরবার যখন অলিম্পিক হবে তখন আমাকে ওখানে পাঠিয়ো কিন্তু। আমি দৌড় দিয়ে উসাইন বোল্টকে একদম হারিয়ে দিব।”

“ঠিক আছে, পাঠাবো। কিন্তু অলিম্পিক যে হবে বিদেশে! তুই বিদেশে গেলে এদিকে যে ভারি মন খারাপ হবে আমার আর তোর মায়ের।”

“কিন্তু বাবা, দৌড়াতে তো আমাকে হবেই! নইলে উসাইন বোল্টকে হারাবো কী করে? তোমরা বেশি মন খারাপ কোরো না। আমি তো মাত্র কয়েকদিন থাকব।”

এবার সুযোগ পায় বাবা। বলে, “তাহলে, মা-ও না হয় ক’দিন থেকে আসুক বিদেশে? বেশি তো নয়, মাত্র চার দিন।”

“চারদিন? একটু ভেবে উত্তর দেয় সায়ন্তন, ঠিক আছে, সকালে উঠে মাকে ফোন করব। বলে দেবো, তুমি চিন্তা কোরো না। সব কাজ ভালোমত শেষ করে আসো। আমি লক্ষী হয়ে থাকব।”

“ঠিক আছে”, ঘুম-ঘুম চোখের সায়ন্তনকে বুকে টেনে বাবা বলে, “এখন তাহলে ঘুমিয়ে পরি আমরা? আমি কিং কিং এর গল্প বলি, শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে যাব আমরা।”

গল্প শুনতে শুনতে যখন চোখ বন্ধ করল সায়ন্তন, তখন ঘড়ির কাটায় রাত দু’টো একচল্লিশ মিনিট। স্বপ্নে সায়ন্তন উসাইন বোল্ট না কিং কং নাকি মা কাকে দেখলো কে জানে!