রাজকন্যার জন্মদিন

সকাল হতেই আদৃতা কেমন দাঁত বের করে হাসছে। আদৃতার ভাই আদন ওর পেটে গুঁতো মেরে জিজ্ঞেস করল, আদি তুমি হাসছো কেন? আদৃতাও একইভাবে আদনের পেটে গুঁতো মেরে বলল, কারণ আদু, আজ যে আমার জন্মদিন।

>>রাসয়াত রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Oct 2016, 04:43 AM
Updated : 7 Oct 2016, 04:44 AM

আজ আদৃতার বয়স হবে ছয় বছর। সে এ বছর প্রাইমারি স্কুলে ভর্তি হয়েছে। স্কুলটা অন্য স্কুলগুলোর মতো ছোট-খাটো না। বেশ বড় স্কুল। সেখানে বড় একটা মাঠ আছে, অনেকগুলো বড় বড় গাছ আছে, বাচ্চাদের খেলার জন্য সি-স, স্লিপার আছে। এমনিতে স্কুলে বাঁদরামি করা নিষেধ কিন্তু আদৃতাদের স্কুলে বাঁদরামি করা একদম নিষেধ না। বরং খেলার জায়গায় একটা লোহার টারজন গাছ আছে। সেই গাছে ছোট ছোট দূরত্বে ডাল বানিয়ে দেওয়া যেন ছোট ছেলেমেয়েরাও ডাল বেয়ে বেয়ে উপরে উঠতে পারে আর ডাল ধরে ঝুলতেও পারে। এই স্কুলের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে এখান থেকে যখন খুশি আকাশ দেখা যায়।

স্কুলটা আদৃতার খুব পছন্দ। আগে আদৃতা একটা স্কুলে যেত সেটাকে বলে প্রি-স্কুল। মানে আসল স্কুলে যাওয়ার আগে তৈরি হওয়া আর কি! সেই স্কুলটাও খুব সুন্দর সাজানো গোছানো। বল পুল আছে, স্লিপার আছে, ক্লাস রুমে এসি আছে। তবে সেখান থেকে আকাশ দেখা যেত না, পাখি ছিল না, গাছ ছিল না। শুধু কোথা থেকে মাঝেমধ্যে একটা বিড়াল ক্লাসে ঢুকে যেত। সেটা দেখতে এত আদুরে ছিল! কিন্তু টিচার বলতেন, ডোন্ট টাচ, বিড়ালটা ডার্টি।

নতুন স্কুল আদৃতার খুব পছন্দ। এখানে ক্লাস করতে করতে ফাঁকে ফাঁকে আকাশ দেখা যায়। টিচাররা যখন পড়াতে থাকেন তখন টুক করে একটু আকাশ দেখে আসা যায়। যখন বৃষ্টি আসে তখন মিষ্টি একটা গন্ধ পাওয়া যায়। জানালার পাশে বসলে জানালা বন্ধ করার আগ পর্যন্ত একটু বৃষ্টির ছাঁটও পাওয়া যায়। সকালে স্কুলে গিয়ে কাঠগোলাপ কি শিউলি ফুল কুড়ানো যায়। ক্লাস শুরু হতে হতে সেই ফুল দিয়ে মালাও গাঁথা যায়, মাঝে মাঝে একটা দুইটা ছোট পাখি ক্লাসের বারান্দায় আসে। চড়ুই পাখির ছোট একটা বাসাও ক্লাস রুমের ঘুলঘুলিতে আছে।

আদনের পাশে বসে আদৃতা এত সব রাজ্যের কথাই ভাবছিল। আজ তার জন্মদিন! কী মজা! কিছু দিন আগে আদৃতা বন্ধু অরণির জন্মদিন ছিল। অরণি ক্লাসের সবার জন্য চকলেট নিয়ে এসেছিল। ওরা সবাই মিলে অরণির জন্য ‘শুভ জন্মদিন তোমার’ গান গেয়েছে এরপর কেউ অরণিকে বেলি ফুলের মালা গেঁথে দিয়েছে, কেউ দিয়েছে কাঠগোলাপের আংটি, সবাই নিজের টিফিন থেকে অরণিকে একটু খায়িয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ ড্রয়িং খাতা থেকে কাগজ ছিঁড়ে রঙ পেনসিল দিয়ে ছবি এঁকে কার্ডও বানিয়ে দিয়েছে। কী যে ভালো লেগেছে!

আদনের বয়স মোটে ৩ বছর। সে এই বছর শেষে প্রি স্কুলে যাওয়া শুরু করবে। বোকাটা জানেই না স্কুল কী মজার! তবে প্রি স্কুল একটু কম কম মজা। একটু বড় হলে যে স্কুলে যায় সেটা বেশি মজার।

আদৃতা এত সব ভাবতে ভাবতে ওর ছোট ফুপি বাসায় আসলো। তার হাতে ছোট্ট একটা বিড়াল, কী নরম আর তুলতুলে। এটাই নাকি আদৃতার জন্মদিনের উপহার! এত সুন্দর উপহার পেয়ে আদৃতা খুশিতে একদম কেঁদেই দিল। আদন বলল, “আদি বোকা, আদি কাঁদে।”

স্কুলেও খুব মজা হল, সবাই আদৃতাকে অনেক ভালোবাসা দিল। ব্ল্যাক বোর্ডের একদম উপরে রঙিন চক দিয়ে ক্লাস টিচার লিখে দিলেন, ‘শুভ জন্মদিন আদৃতা’ সারাদিন সেই লেখাটা জ্বল জ্বল করে জ্বলল।

রাতে আদৃতার জন্মদিনের অনুষ্ঠান হবে। বাবা বলেছেন, ধুম ধাম ধামাস অনুষ্ঠান হবে। আদৃতা খিল খিল করে হেসে বললে, বাবা ধুম ধাম ধামাস কী? বাবা বললেন, ধুম ধাম তো হল ঢোলের আওয়াজ। আর আমরা সেই এই উৎসবের ঢোল ততক্ষণ বাজাতেই থাকব যতক্ষণ সেটা ধামাস করে ফেটে না যায়! কারণ আজ যে আমাদের আদৃতা রাজকুমারীর জন্মদিন।

জন্মদিন এত ধুম ধাম করে হবে যে আদৃতার বন্ধুরা তো বটেই, প্রতিবেশীরা, বাবার বন্ধুরা, মায়ের বন্ধুরা, এমনকি আদনের মাত্র তিনজন বন্ধু আছে তারাও আসবে। আদৃতার সব আত্মীয়-স্বজন আসবেন। এত মানুষ কী আর বাসায় দাওয়াত দেওয়া যাবে? তাই সবাইকে বড় একটা রেস্টুরেন্টে দাওয়াত করা হয়েছে।

সেখানে কেক থাকবে, ক্যান্ডি থাকবে, বেলুন থাকবে, পমপম থাকবে, হাওয়াই মিঠাই থাকবে। এখানেই শেষ না। আদৃতা সত্যিকার রাজকুমারীদের মতো জামা পরবে, তার লাল-নীল ঝকমকে পাথর লাগানো মুকুটও থাকবে। চকচকে জুতো থাকবে।

সব পরে সুন্দর করে তৈরি হওয়ার পরে আদৃতা, তুলতুলকে কোলে তুলে নিলো। তুলতুল হল আদৃতার বিড়াল, সকালেই ছোট ফুপি উপহার দিলো যে!

তুলতুলকে কোলে তুলতেই সবাই হায় হায় করে উঠলো। নানু বললেন, আদি সোনা তোমার এত সুন্দর জামাটা নষ্ট হয়ে যাবে তো! মা বললেন, তুমি কী সুন্দর করে সেজেছো তুমি যদি এখন বিড়ালটা ধরো তবে তো সব সাজ এলোমেলো হয়ে যাবে! সবাই পচা বলবে।

আদৃতার কী হল কে জানে! সে তার সব সাজ এলোমেলো করে খেলে ফেলে তুলতুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। কান্নার চোটে ওর কথা ভালো বোঝা যাচ্ছিল না। তবে সম্ভবত ও বলছিল, “সবার সঙ্গে মিশতে পারে না, সবাইকে ভালোবাসতে পারে না এমন রাজকন্যা আমি হতে চাই না। আমি পচাই থাকতে চাই।”

রেস্টুরেন্টে সব অতিথি চলে এসেছে, আদৃতা আর আদনও এসেছে। আদৃতার কোলে চরে তুলতুলও এসেছে। কান্না করার ফলে আদৃতার চোখ একটু ফুলে আছে। চুলও পুরোপুরি গোছানো সম্ভব হয়নি। তবে আদৃতার বিশাল হাসির সামনে এসব ভালোভাবে বোঝা যাচ্ছে না।

তুলতুল এতসব মানুষ দেখে একটু ঘাবড়ে গিয়েছিল। এখন সে বেশ মানিয়ে নিয়েছে। আদৃতার কোলে বসেই এদিক সেদিক থাবা দিচ্ছে। আদৃতা সবার সঙ্গে তুলতুলকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছে, এ হল তুলতুল। আমার নতুন বন্ধু।