প্রবাদের গল্প: মাছি মারা কেরানি

প্রবাদ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হচ্ছে প্রকৃষ্ট বাদঃ সহজ করে বললে, শ্রেষ্ঠ বা প্রশস্ত উক্তি। আরও সহজ করে বললে একটা উপযুক্ত বাক্য যা কোনো অবস্থাকে সহজেই বর্ণনা করে। এই সহজে একটা ঘটনাকে বুঝিয়ে দেওয়ার বিষয়টি কিন্তু এমনি এমনিই হলে হবে না। ধরো তুমি হঠাৎ একটা বাক্য দিয়ে কিছুকে বুঝাতে চাইলে কিন্তু অন্যরা সেটার আগা মাথা কিছুই জানে না, এমন হলে মোটেই সেটাকে প্রবাদ বলা যাবে না। প্রবাদ হবে এমন যে তুমি যাই কিছু একটা বললে অন্যেরাও সেটা আগে থেকেই বুঝলো।

মাকসুদা আজীজবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 Nov 2015, 07:42 AM
Updated : 4 June 2016, 11:51 AM

প্রবাদ একটি ভাষার খুব মূল্যবান অলংকার। কেননা একটা কথা বললে তো বলে ফেলাই যায় কিন্তু একটা কথাকে যদি তুমি সাজিয়ে গুছিয়ে সংক্ষিপ্ত এবং প্রাঞ্জল ভাবে উপস্থাপন করতে পারো তবেই নাই বক্তা বা লেখক হিসেবে তোমার সার্থকতা আসবে।

কোনো ভাষার প্রবাদ তৈরি হয় সেই জাতির দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে। তাই প্রবাদগুলোর পেছনে মজার মজার গল্পও থাকে। সেই গল্পগুলো কখনও হয় ঐতিহাসিক, কখনও পৌরাণিক তবে মজাটা সবচেয়ে বেশি হয় যদি সেটা কোনো লোককথা থেকে আসে। লোককথার গল্পগুলো মানুষ মুখে মুখেই বানায়। এর কিছুটা সত্য কিছুটা মানুষের কল্পনার রঙচঙ মেখে খুব জমজমাট গল্প দাঁড়িয়ে যায়।

আজকে আমরা যে প্রবাদটি গল্প শুনবো সেটিও একটি লোককথা থেকে এসেছে। প্রবাদটি হলো, মাছি মারা কেরানি। এর অর্থ হুবহু অনুকরণকারী ব্যক্তি। কেউ যদি কোনো কাজের অর্থ, প্রয়োগ ও গুরুত্ব বিবেচনা করে ভুলত্রুটিসহ শুধুমাত্র অনুকরণ করে যায় তাদের মাছি মারা কেরানি বলে। ধরো তোমাকে একটি জিনিস দেখে অনুকরণ করতে দেওয়া হলো। তোমার যদি জিনিসটি সম্পর্কে মোটেই জ্ঞান না থাকে তাহলে তুমি তার ভুল-ত্রুটি বুঝতেই পারবে না। শুধু অনুকরণ করেই যাবে। এভাবে কোনো ভালো মন্দের হিসেব ছাড়া যে অনুকরণ করে থাকেই বলে মাছি মারা কেরানি।

এত কিছু থাকতে কেরানিদের উপর এই বিশাল অভিযোগটা কীভাবে আসলো জানো? ভারতে তখন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন চলছিলো। তোমরা তো জানোই ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন আমলে বড় বড় সব পদ দখল করে রাখতো ইংরেজরা আর ছোট কেরানি আর্দালি ধরণের কাজ করতো এই দেশের মানুষেরা। তারা শিক্ষায় খুব পটু ছিলো না। এছাড়াও কোম্পানির শাসকেরা এদেশের মানুষকে এতো শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচারের ভয়ে রাখতো যে তারা কোম্পানির শাসকদের প্রভু মনে করতো। নির্দেশের সামান্যতম বরখেলাপ হলে কী ভয়াবহ পরিণতি হবে সেই ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকতো।

এভাবেই একদিন একজন কেরানি তাঁর কাজ করছিলেন। কাজ বলতে, একটি নথি থেকে অন্য কাগজে কপি করা। সে সময় না ছিলো প্রিন্টার না ফটোকপি করার জন্য জেরক্স মেশিন। তাই এই কাজটা কেরানিদের হাতে লিখে লিখে করতে হতো। কপি করতে করতে সেই কেরানি দেখলেন একথায় গায় একটা মাছি মরে লেখার সঙ্গে লেগে আছে। কেরানি তো জানে তাকে হুবহু কপি করতে হবে নাহলে তাঁর মনিব তাকে আস্ত রাখবেন না। কিন্তু মাছির অংশ কীভাবে একইরকম করা যায়? এরপর তাঁর মাথায় এক বুদ্ধি আসলো। উনি ঠিক করলেন একটা মাছি ধরে মেরে জায়গামতো বসিয়ে দিবেন। কিন্তু মাছি ধারা আবার মারা কি আর চারটেখানি কথা। মাছির চোখ হলো, পুঞ্জাক্ষি মানে মাছির হাজার হাজার চোখ। ওর ধারে কাছে কেউ আসার আগেই সে দেখে ফেলে আর দেয় উড়াল। এভাবে মাছির পিছনে অনেক সময় ঘুরে শেষ পর্যন্ত একটা মাছিকে মারা হলো এবং জায়গামতো বসিয়ে কেরানি সাহেব তাঁর কাজ সমাপ্ত করলেন।

এই গল্পটা থেকে আমরা যেমন শিখতে পারি, কাজ যাই হোক না কেন সেটা বুঝে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে করতে হয়। আবার এও শিখতে পারি অহেতুক ভয় এবং চাপ দিয়ে কাউকে কাজ করালে তাঁর স্বাভাবিক চিন্তা করার ক্ষমতা হ্রাস পায় ফলে কাজ সঠিকভাবে না হয়ে খারাপ কিছুর সম্ভাবনাই বেশি থাকে।