ঢাকার পূজা দর্শন

সভ্যতা আর ঐতিহ্য খুব খুশি কারণ পূজার ছুটিতে নানাভাই এসেছেন ওদের বাসায়, থাকবেন কিছুদিন। নানাভাই মানেই মজার মজার সব গল্প, সঙ্গে এদিক-সেদিক ঘুরতে যাওয়া!

শারমীন রেজওয়ানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Oct 2015, 11:18 AM
Updated : 5 Oct 2016, 06:54 PM

সেদিন বিকেলে ওরা নানার কাছে বসে বসে তাঁর ছেলেবেলার গল্প শুনছিলও। ওদের বাসার কাছেই একটা বারোয়ারী দুর্গাপূজা মন্ডপ তৈরি হয়েছে, সন্ধ্যায় সেখান থেকে ঢাকের শব্দ ভেসে আসে; বেশ লাগে শুনতে।

নানা ভাই বলছিলেন, ঢাকা শহরের এই গা ঘেঁষাঘেষি করে দাঁড়িয়ে থাকা ইট-কাঠের প্রকাণ্ড জঙ্গলে ষড়ঋতুর খেলা তো বোঝাই যায় না! দুর্গার পূজার সঙ্গে শরতের মিষ্টি আবহাওয়া মিলেমিশে কী যে সুন্দর একটা আবহ তৈরি হয় সেটা অনুভব করতে হলে গ্রামে যেতে হবে, বুঝলে?

সারাদিন ঝকঝকে নীল আকাশ, হঠাত হঠাত বয়ে যাওয়া উত্তুরে হাওয়ায় দুলে ওঠা কাশের বন যেন শীতের আগমন বার্তা বলে যায়,সেই সঙ্গে দুর্গাপূজারও। সন্ধ্যাবেলাটা জমে ওঠে শিউলি ফুলের হালকা সুবাসে। পাড়ায়-পাড়ায় দুর্গাপূজার মণ্ডপে ছেলে বুড়োদের ভিড় জমে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে বাড়িতে নারকেলের নাড়ু, তিলের নাড়ু, মোয়া, সন্দেশ তৈরির ধুম পরে যায়। আর সে সবের ভাগ কিন্তু পড়া প্রতিবেশীরা সবাই পায়।

নানার কাছে গল্প শুনতে শুনতে সভ্যতা আর ঐতিহ্য বললো, নানা চলো না আমরাও যাই পূজা দেখতে যাই।

নানা বললেন, যেতে চাও?  তবে চলো বাড়ির কাছের মন্ডপ দিয়েই তাহলে শুরু করি। সেদিন বিকেলে ওরা গেলো কলাবাগান মাঠের মন্ডপ দেখতে। সেখানে রাস্তা থেকেই চোখে পরে মণ্ডপের গেটের আলোকসজ্জা। গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে এক পাশে একটা মঞ্চ, সেখানে গান হচ্ছে।  আরেক পাশে দোল মঞ্চের আকারে তৈরি মন্ডপ। উঁচু মঞ্চের উপর দশভুজা দেবী দুর্গা, দুপাশে তাঁর ছেলেমেয়েরা-- লক্ষ্মী,সরস্বতী, কার্তিক এবং গণেশ, যার যার বাহন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। দুর্গার পায়ের কাছে রয়েছে তাঁর বাহন সিংহ এবং তারও পরে শূলবিদ্ধ মহিষাসুর। সারা বাংলায়  মোটামুটি এই রূপেই দুর্গা পূজিত হন।

ওরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে সামনের দিকে পেতে রাখা চেয়ারে বসলো। নানা ভাই ওদের জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কি দেবী দুর্গার এই দশভুজা রূপের পৌরাণিক উপাখ্যানটি জানো?

ঐতিহ্য বললো, কিছু কিছু জানি নানা, তবু তুমি আরেকবার বলো।

নানাভাই বলতে লাগলেন, সেই পুরাকালে মহিষাসুর নামের এক অসুর ছিল। একবার তার  ধারণা হলো কোনো দেবতা তাকে বধ করতে পারবে না; এই অহংকারে মহিষাসুর দেবতা ইন্দ্রকে সর্তক করে দেয় যে, সে স্বর্গ জয় করে নেবে। মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ইন্দ্র,  ব্রহ্মা, শিব ও বিষ্ণুর আশ্রয় নেয়। দেবতারা ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন এবং তাদের পবিত্র দেহ থেকে স্বর্গীয় সুষমায় আচ্ছন্ন, অপূর্ব সুন্দরী এক নারীর জন্ম হয়, ইনিই দুর্গা। তখন সব দেবতারা মিলে দুর্গাকে বিভিন্ন অস্ত্র দিলেন, দিলেন বাহন সিংহ। এরপর যুদ্ধে দুর্গা সমস্ত অসুর-কূলসহ মহিষাসুরকে বধ করে পৃথিবী এবং স্বর্গে শান্তি স্থাপন করেন।

তোমরা তো রাম-লক্ষণের নাম জানো, তাই নাই? রামায়ণে আছে, সেই রামচন্দ্র সীতাকে উদ্ধারের জন্য কালিদহ সাগর থেকে ১০১ টি নীল পদ্ম সংগ্রহ করে সাগর কূলে বসে বসন্তকালে সর্বপ্রথম  দুর্গোৎসবের আয়োজন করেছিলেন।

-ঐতিহ্য জানতে চাইলো, নানা এতো গেল পুরাণের কথা। আমাদের এই বাংলায় ঠিক কবে থেকে দুর্গাপূজার প্রচলন হলো?

নানা মুখ খুলতে শুরু করেছিলেন, কিন্তু ততক্ষণে মণ্ডপে ঢাকিরা ঢাক বাজানো শুরু করে দিয়েছেন। আর সেই ছন্দময় বাজনা এত মনোমুগ্ধকর যে, না শুনে উপায় নেই। বেশ কিছুক্ষণ ঢাকের বাদ্য শুনে নানা বললেন, চলো, এবার আমরা যাবো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পূজা দেখতে। যেতে যেতে দুর্গাপূজার বাকি ইতিহাস তোমাদের বলবো।

গাড়িতে উঠে আরাম করে বসার পর সভ্যতা বললো, নানা এবার তাহলে শুরু করো।

নানা ভাই বললেন, কোথায় যেন ছিলাম আমরা? ও আচ্ছা বাংলায় কীভাবে দুর্গাপূজা শুরু হলো, তাই তো?

ভাই বোন সমস্বরে বলে উঠল, হ্যাঁ নানা ভাই।

ঐতিহাসিকগণ বলেন, আজ আমরা মণ্ডপে যেভাবে দুর্গাপূজা দেখছি, প্রাচীন বাংলায়  ঠিক সেভাবে দুর্গাপূজার প্রচলন ছিল না। বাংলায় পূজার প্রচলন দ্বাদশ শতক থেকে। অর্থাৎ, গীতগোবিন্দের রচয়িতা কবি জয়দেব যে শতাব্দীতে বেঁচে ছিলেন সেই শতাব্দীতে। অবশ্য দুর্গাপূজার বিধান রচিত হয়েছিল আরও অনেক আগেই। যাই হোক, ঠিক কবে থেকে বাংলায় দুর্গাপূজার আয়োজন হয়েছিল তা নিয়ে আবার পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে। কারো কারো মতে,  বাংলায় প্রথম দুর্গাপূজা  আয়োজন করেন তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ,আবার কেউ কেউ বলেন ১৬০৬ সালে  নদীয়ার ভবনানন্দ মজুমদার দুর্গাপূজার চালু করে। ছেলে মেয়ে সহকারে দুর্গার সপরিবারে পূজা চালু করেছিলেন কলকাতার সাবর্ণ রায়-চৌধুরী পরিবার, সেটা ছিল ১৬১০ সাল। সেই সময়ে  দুর্গাপূজা পারিবারিকভাবে পালন করা হত। জমিদার ও ধনাঢ্য বৈশ্যরাই ছিল এর উদ্যোক্তা আর বাকিরা দর্শক। কালক্রমে সেই পারিবারিক পূজাই হয়ে ওঠে বারোয়ারি পূজা।

গল্প করতে করতে এক সময়ে ওরা দেখলো গাড়ি জগন্নাথ হলে যাবার রাস্তায় ঢুকে পরেছে, সেখান থেকেই রাস্তার দুপাশের আলোকসজ্জা চোখে পরে। হলের গেটের সামনে গাড়ি থেকে নামতে প্রথমেই শিউলি ফুলের মৌ মৌ সুবাসে মন ভরে গেলো, সেই সঙ্গে যেন তাল মিলিয়ে ভেসে আসছে ঢাকের শব্দ! চারপাশে কেমন একটা উৎসবের আমেজ। আলোর ঝালর দিয়ে ছাওয়া রাস্তার ধরে কিছু দূর হেঁটে গিয়ে ওরা সবিস্ময়ে দেখলো, গৌতম বুদ্ধের বিশাল এক মূর্তি, এরপর পুকুরের পাশেই দুর্গামণ্ডপ। আর ওপাশে তৈরি হচ্ছে স্বামী বিবেকানন্দের আরেকটি মূর্তি। পুকুরের পানিতে আলোর প্রতিফলনে কি সুন্দর একটা মোহময়তা তৈরি হয়েছে। এরমধ্যে ছোট বাচ্চারা শিউলি ফুলের মালা বিক্রি করছিলো, নানা ওদের দু ভাই-বোনকে মালা কিনে দিলেন। নরম তুষারের মতো ফুলের সেই মালা হাতে জড়িয়ে ওরা গেলো প্রতিমা দেখতে। মণ্ডপের ওপাশের মাঠে জমেছে চরকি আর চটপটি-ফুচকার মেলা।

বেশ কিছুক্ষণ প্রতিমা দেখে, ঢাকিদের ঢোলের বাজনা শুনে নানা ভাই বললেন- চলো এবার বেড়িয়ে পরা যাক।

এখন আমরা কোথায় যাবো নানা? ঐতিহ্য জানতে চাইলো।

নানা বললেন, এখন আমরা যাবো ঢাকার সবচেয়ে প্রাচীন মন্দিরটি দেখতে, তার নাম হলো ঢাকেশ্বরী মন্দির!

সভ্যতা বলে উঠলো, ঢাকেশ্বরী নামটা কেমন অদ্ভুত না? এমন নাম কেন হলো নানা?

সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মনে করেন ঢাকেশ্বরী ঢাকার অধিষ্ঠাত্রী দেবী। ঢাকেশ্বরী নামটি নিয়ে বেশ কিছু কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এর মধ্যে কয়েকটা বলছি তোমাদের—

কথিত আছে, একবার রাজা বল্লাল সেন স্বপ্নে দেখলেন যে এই জায়গায় জঙ্গলের মধ্যে এক দেবী ঢাকা পরে আছেন। তিনি তখন জঙ্গল থেকে দেবী মূর্তি উদ্ধার করে আনেন এবং এখানে সেই দেবীর জন্য মন্দির তৈরি করে সেখানে দেবীকে অধিষ্ঠিত করেন। সেই থেকেই এই মন্দির ঢাকেশ্বরী দেবীর মন্দির হিসেবে পরিচিত হয়।

আবার আরেক উপাখ্যান অনুসারে, বল্লাল সেনের মা লাঙ্গলবন্দ থেকে ফেরার পথে এই স্থানেই তাকে জন্ম দিয়েছিলেন। বড় হয়ে রাজা হবার পর নিজের জন্মস্থানটি স্মরণীয় করে রাখার জন্যই বল্লাল সেন এই মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

নাতি-নাতনী সহকারে নানা যখন ঢাকেশ্বরী মন্দিরের গেটে নামলেন তখন সেখানে বেশ ভীর হয়ে গেছে। মন্দির চত্বরে ঢুকে ওরা দেখলো ওখানে আসলে বেশ কিছু মন্দির রয়েছে। নানা দেখালেন এদিকে রয়েছে প্রাচীনতম ঢাকেশ্বরী দেবীর মন্দিরটি। তবে অনেকবার সংস্কার করার ফলে আগের আকার আর নেই। নানা বললেন, ঐ যে দেখছো মন্দিরের পাঁচটি চূড়া, এর জন্য এই রকমের মন্দিরকে বলে পঞ্চরত্ন মন্দির।

ঢাকেশ্বরী মন্দিরের মূল আকর্ষণ হচ্ছে চারটি শিবমন্দির। ইন্টারনেট কিংবা বই পত্র ঢাকেশ্বরী মন্দির হিসেবে এই শিবমন্দিরগুলোর ছবিই বেশি দেখা যায়। মন্দিরগুলোর আকার অনেকটা গ্রামের কুঁড়েঘরের মতো, নানা বললেন। এই ধরনের মন্দিরকে চৌচালা-রীতির মন্দির বলে।

এই মন্দিরগুলোও কি বল্লাল সেন বানিয়েছিলেন?  সভ্যতার প্রশ্ন।

নানা বললেন, নাহ, এগুলো বল্লাল সেনের বানানো নয়। অনেকে বলেন যে, শিবলিঙ্গসহ এই মন্দির চারটা বানিয়েছিলেন ষোড়শ শতকের রাজা মানসিংহ। সেই তথ্যের অবশ্য কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

হেঁটে হেঁটে মন্দির ও প্রতিমা দেখা শেষ করে ওরা এক সময়ে বাইরে বেরিয়ে এলো। গেটের দুপাশের রাস্তা জুড়ে দোকানীরা খাবার-দাবারসহ ছোট ছোট খেলনা, চুড়ি ইত্যাদি হরেক রকমের পণ্য সাজিয়ে বসে আছে, যেন ছোটখাটো একটা মেলা বসেছে সেখানে।

সভ্যতা বললো, সবগুলো মণ্ডপেই দেখলাম হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের সঙ্গে আমাদের মতো আরও অনেকে পূজা দেখতে এসেছে। এই বিষয়টা আমার খুব ভাল লেগেছে। 

ঐতিহ্য সঙ্গে যোগ করলো, এই জন্যই বোধহয় একে সার্বজনীন দুর্গা উৎসব বলা হয়!

নানাভাই মুচকি হেসে বললেন ঠিকই বলেছো তোমরা, এবার তবে চলো বাড়ির দিকে রওনা হই।