২০ শতকের শ্রেষ্ঠ গল্প-কথক

তোমরা কি মাটিলডা সিনেমাটা দেখেছো? অথবা চার্লি এন্ড দ্যা চকলেট ফ্যাক্টরি? ছোটদের মধ্যে এই সিনেমা দুটি ভীষণ জনপ্রিয়। এই সিনেমা দুটি যতটা জনপ্রিয় এর লেখক রোয়াল ডালও ঠিক ততখানিই জনপ্রিয়। তবে তাঁর জনপ্রিয়তার মাপ কাঠি শুধু বলে বোঝানো যাবে না। বিশ্বসাহিত্যে তাঁর অবদানের জন্য ১৩ সেপ্টেম্বর তাঁর জন্মদিনকে রোয়াল ডাল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ভাবা যায় মানুষটা শুধুমাত্র গল্প লিখে কতটা খ্যাতি অর্জন করেছেন! তোমরা যারা রোয়াল ডালকে মোটেই চিনো না অথবা কিছুটা চিনো তাদের জন্য এই অসাধারণ গল্পকারের জীবনের গল্প নিয়ে আজকে তাঁর জন্মদিনে এই আয়োজন।  

>>রাসয়াত রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2015, 09:46 AM
Updated : 15 Sept 2015, 04:44 AM

জনপ্রিয় শিশু সাহিত্যিক রোয়াল ডালের জন্ম ১৯১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখ ল্যান্ডাফ (Llandaff) সাউথ ওয়েলসে। তাঁর বাবা ছিলেন নরওয়ের অধিবাসী। যখন ছোট ছিলেন তিনি গ্রীষ্মকালীন ছুটি কাটাতে দাদাবাড়ি অসলোতে যেতেন। ৪ বছর বয়সে তিনি তাঁর বাবাকে হারান। 

ল্যান্ডাফ ক্যাথড্রাল স্কুলে তাঁর লেখাপড়ার হাতেখড়ি হয়। সেখানে চঞ্চলতা ও দুষ্টুমির কারণে এক শিক্ষকের কাছে তিনি তিরস্কৃত হন। এ ঘটনার পরে তাঁর মা তাকে বোর্ডিং স্কুলে পাঠিয়ে দেন। তাঁর মৃত বাবারও এক সময়ের ইচ্ছা ছিলো ছেলে বোর্ডিং স্কুলে যাবে। তখনকার ইউরোপিয়ানদের মধ্যে এই রীতিটা খুব চালু ছিলো। প্রায় সবাইই চাইতেন তাঁর ছেলে বোর্ডিং স্কুলে পড়ুক। সেই বোর্ডিং স্কুল থেকে রোয়ালকে রেপটন নামে আরেকটি স্কুলে পাঠানো হয়। এই স্কুলটি বেশ বিখ্যাত একটি স্কুল ছিলো। মায়ের ইচ্ছে ছিলো স্কুল শেষে ছেলেকে ক্যামব্রিজ বা অক্সফোর্ডে ইউনিভার্সিটিতে পড়াবেন। কিন্তু ডাল চাচ্ছিলেন অন্য কিছু, তাঁর অটো বায়োগ্রাফি ‘টেলস অফ চাইল্ডহুডে’ তিনি বলেন, “না ধন্যবাদ, আমি স্কুল থেকে সরাসরি কোম্পানিতে কাজ করতে যেতে চাই, একটা সুন্দর স্বপ্নময় জায়গা, আফ্রিকা বা চায়নার মতো। তিনি সেটাই করেছিলেন। ১৯৩২ সালে রেপটন থেকে গ্রাজুয়েশনের পর তিনি অনেকটা এডভেঞ্চারের নেশায়ই নিউফাউন্ডল্যান্ডে যান, শেল ওয়েল কোম্পানির চাকরি নিয়ে, তানজানিয়ায়, আফ্রিকায় , এবং ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই ছিলেন।

এডভেঞ্চার প্রিয় ডাল ১৯৩৯ সালে রয়েল এয়ারফোর্সে যোগদান করেন। কেনিয়ার নাইরোবিতে ট্রেনিং নেওয়ার পর তিনি ২য় বিশ্বযুদ্ধে ফাইটার পাইলট হিসেবে অংশ নেন। সেখানে এক দুর্ঘটনায় তিনি মাথায় আর মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত হন। সেখান থেকে তিনি ওয়াশিংটন ডিসিতে চলে যান। শেষ হয়ে যায় ডালের আকাশে উড়ার দিন।

ওয়াশিংটন ডিসিতে এসে ডালের জীবনে একটা নতুন মোড় আসে। এমনিতে ডাল আর দশটা মানুষের থেকে আলাদা ছিলো। তাঁর চিন্তা ভাবনাও বেশ অনন্য ধরণের ছিলো। সবচেয়ে যেটা আকর্ষণীয় ছিল তা হলো ডাল যে কোনো ঘটনা বলতে পারতেন খুব সুন্দর করে। এমনিতেও আফ্রিকা বাস এবং এয়ারফোর্সের জীবনের অনেক গল্প তাঁর ঝুলিতে যোগ হয়ে গিয়েছিলো। সেই সময় ডালের সঙ্গে সি এস ফরেস্টারের সঙ্গে দেখা হয়। ফরেস্টার নিজেও একজন বিখ্যাত সাহিত্যিক। ডালের ভিতরে লেখালেখির যে বীজ অঙ্কুরিত হবার অপেক্ষা করছে সেটা ফরেস্টার খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন। তিনি ডালকে লেখালেখি শুরু করতে বলেন। ডাল তাঁর প্রথম ছোট গল্প স্যাটারডে ইভিনিং পোস্টে ছাপানোর তোড়জোড় শুরু করে। গল্পটা বেশ ভালো প্রতিক্রিয়া পায়। সেই সুবাদে ডাল সেখানেই গল্প ও কলাম লেখা শুরু করার সুযোগ পান, পাশাপাশি অন্যান্য পত্রিকাতেও লেখেন।

প্রথম দিককার লেখা সম্পর্কে ডাল বলেন, গল্প লেখার সময় আমি বাস্তববাদী হওয়ার থেকে কল্পনাপ্রবণ হওয়াটাকে বেশি প্রাধান্য দিতাম। লেখালেখি জগতে এসে পরাকে ডাল একটা দৈবাৎ ঘটনা হিসেবে মনে করতেন। তাঁর নিজের এমনিতে লেখক হওয়ার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না।

ছোটদের জন্য তাঁর প্রথম লেখা ছিল দ্যা গ্রেমলিন্স, সময়কাল ১৯৪২। এই লেখাটি একদম অসফল হয়। তেমন কেউই এটা পছন্দ করে না। ডালের মনে হতে থাকে হয়তো তাঁর দ্বারা শিশু সাহিত্য সম্ভব নয় তাই তিনি বয়স্কদের জন্যই ভয়ংকর এবং রহস্যময় লেখা শুরু করলেন। সেই ধারা বজায় রেখেই তিনি লেখেন সামওয়ান লাইক ইউ এবং কিস কিস ইউ।

ডাল বিয়ে করেছিলেন চলচ্চিত্র অভিনেত্রী প্যাট্রিসিয়া নীলকে যিনি একজন একাডেমী এওয়ার্ড বিজয়ী। তাদের ছেলেমেয়ের সংখ্যা ছিল পাঁচ। ডালের ভাষ্যমতে, তাঁর শিশু সাহিত্যের ক্যারিয়ার শুরুই হয়েছিল রাতের বেলা ঘুমানোর সময় বাচ্চাদের গল্প বলতে বলতে। তাঁর বেশির ভাগ লিখির গল্পের ভিত্তিই ছিল এইসব গল্পগুলো। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, বাচ্চাদের খুশি করা সবচেয়ে কষ্টকর ব্যাপার, তারা কঠোর সমালোচক, এবং খুব তাড়াতাড়িই তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। 

বাচ্চাদের গল্প লেখার ক্ষেত্রে আগ্রহ বজায় রাখা খুবই জরুরী। যদি গল্পের কোনো অংশে তারা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে খুব তাড়াতাড়ি এমন কিছু ঘটাতে হবে যাতে আগ্রহ দিরে আসে। আপনাদের বুঝতে হবে শিশুরা এমনই। প্যাট্রিসিয়া নীলের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর তিনি বিয়ে করেছিলেন এন ক্রসল্যান্ডকে।  

১৯৬১ সালে ডাল প্রথম শিশু সাহিত্যিক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। জেমস এন্ড দ্যা জায়ান্ট পিচ প্রকাশিত হওয়ার পর সেটা সমালোচকদের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয় এবং প্রচুর বিক্রি হয়। ৩ বছর পর আরেক বেস্ট সেলার বই লিখেন নাম- চার্লি এন্ড দ্যা চকলেট ফ্যাক্টরি। এই দুটা গল্পই পরবর্তীতে বিখ্যাত চলচ্চিত্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটার নাম ছিল ইউলি ওয়াঙ্কা এন্ড দ্যা চকলেট ফ্যাক্টরি। ২০০৫ সালে জনি ডেপের অভিনয়ে সিনেমাটার রিমেক হয় অরিজিনাল বইটার নামেই। জেমস এন্ড দ্যা জায়ান্ট পিচ মুক্তি পায় ১৯৯৬ সালে। এই সিনেমাগুলোর জনপ্রিয়তার পরে ডালের আরও কিছু জনপ্রিয় শিশুদের বই ১৯৭০ সালের ফ্যান্টাস্টিক ফক্স, ১৯৮৩ সালে দ্যা উইচেস এবং ১৯৮৮ সালের মাটিলডা সিনেমায় রূপান্তরিত হওয়া শুরু করে। ততদিনে অবশ্য ডাল এই পৃথিবী ত্যাগ করে একটি অনন্ত রহস্যের গল্পের জগতে চলে গিয়েছেন।

১৯৯০ সালের নভেম্বরে ২৩ তারিখ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি সবমিলিয়ে ১৯ টি বাচ্চাদের বই, ৯ টি ছোট গল্প সংকলন লিখেছেন। এছাড়াও তিনি অনেক টেলিভিশনের জন্য এবং সিনেমার জন্য স্ক্রিপ্ট লিখেছেন।

এই মজার গল্প কথকের জন্মদিনকে রোয়াল ডাল দিবস হিসেবে পালন করা হয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই দিনটি আমরা কীভাবে পালন করবো। আমাদের যে এটি বড় করে পালন করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমরা নিজের মতো করে পালন করতে পারি। যেমন আমরা আজকে রোয়াল ডালের কোনো বই পড়তে পারি। উনার লেখা গল্প নিয়ে বানানো কোনো সিনেমা দেখতে পারি। তবে সবচেয়ে মজা হবে কী করলে জানো? যদি আমরা উনার লেখা কোনো চরিত্রের মতো কোনো কাজ করে ফেলি। ধরো মাটিলডার মতো আজকে একটু পাজি, দুষ্ট, অত্যাচারী কোনো মানুষকে একটু শিক্ষা দিয়ে দেই যেন সে আমাদের বা অন্যদের সঙ্গে আর কোনো সমস্যা না করে।