সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিবিজড়িত বাহাদুর শাহ পার্কে

বৃহস্পতিবার রাতে নানাভাইয়ের সঙ্গে বসে আমির খান অভিনীত ‘মঙ্গল পাণ্ডে-দ্যা রাইজিং’ সিনেমাটি দেখছিলো সভ্যতা ও ঐতিহ্য। পরদিন স্কুল ছুটি, তাই সকাল সকাল ঘুমিয়ে পরার তাড়া নেই। নানাভাইয়ের সঙ্গে যে কোনো কাজেই ওরা খুব আনন্দ পায়, এই যেমন এখন সিনেমা দেখার পাশাপাশি একটু একটু সিপাহী বিদ্রোহের ইতিহাস শুনছিলো, এতে সিনেমাটির প্রতি ওদের আগ্রহও বেড়ে যাচ্ছে বহুগুণে।

>>শারমিন রেজওয়ানাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Sept 2015, 11:23 AM
Updated : 10 Sept 2015, 11:23 AM

নানা বলছিলেন, ১৮৫৭ সালের ১০ মে ভারতে মিরাট শহরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে শুরু হওয়া ভারতীয় সেনাদের এই বিদ্রোহকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধও বলা হয়। বিদ্রোহের সূচনা হয়েছিলো মঙ্গল পাণ্ডে নামক সৈনিকের হাত ধরে, ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পরে মিরাট, দিল্লি এবং ভারতের অন্যান্য অংশে। তবে এই বিদ্রোহ বেশি দিন স্থায়িত্ব লাভ করেনি, ১৮৫৮ সালের ২০ জুন ভারতের গোয়ালিয়রে বিদ্রোহীদের পরাজয়ের পর সমগ্র বিদ্রোহ দমন করা সম্ভব হয়।

চমৎকার সিনেমাটা শেষ হবার পরও দু’ ভাই-বোন মঙ্গল পাণ্ডে এবং সিপাহীদের সেই প্রবল বিদ্রোহ, বীরত্বের কথা ভুলতে পারছিলো না। তাই অনেকক্ষণ ধরে নানা ভাইয়ের কাছ থেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জেনে নিচ্ছিলো সিপাহী বিদ্রোহের নানান কথা।

ঐতিহ্য জিজ্ঞেস করলো বাংলাদেশের সিপাহীদের কথা, তাঁরাও কি বিদ্রোহ করেছিলো?

নানা বললেন, হ্যাঁ, বাংলা কি আর চুপ থাকে? সিপাহী বিদ্রোহের সময়ে ১৮৫৭ সালের ১৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের পদাতিক বাহিনী প্রকাশ্য বিদ্রোহ শুরু করে, তাঁরা জেলখানা থেকে সকল বন্দিদের মুক্তি দিয়ে দেয়। এরপর যত অস্ত্রশস্ত্র এবং গোলাবারুদ আছে সব দখল করে নিয়ে; অস্ত্রাগারে আগুন ধরিয়ে দিয়ে ত্রিপুরার দিকে যাত্রা শুরু করে অন্য বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য।

আর ঢাকার কী অবস্থা হয়েছিলো? সভ্যতা জানতে চায়।

নানাভাই বললেন, বিদ্রোহের রেশ ঢাকাতেও পৌঁছেছিলো, হয়তো ঢাকাও জোরেশোরে অংশ নিতো এই বিপ্লবে। কিন্তু চট্টগ্রামে সিপাহিদের বিদ্রোহ দেখে ঢাকায় অভ্যুত্থানের আশংকায় কর্তৃপক্ষ ৫৪তম রেজিমেন্টের তিনটি কোম্পানি এবং একশত নৌ-সেনা ঢাকায় প্রেরণ করে।এছাড়া ঢাকার তৎকালীন নওয়াব খাজা আবদুল গনি ইংরেজদের পক্ষ নিয়েছিলেন, তাঁর ছিলো ঢাকাবাসীর উপর প্রবল প্রভাব। ফলে এই দুপক্ষ মিলে ঢাকার সিপাহীদের বিপ্লব খুব সহজেই দমন করে ফেলে। কোম্পানির সৈন্যরা লালবাগে নিয়োজিত ২৬০ জনের ভারতীয় সেনাদলকে আক্রমণ করলে তারা প্রতিরোধ সৃষ্টি করে। সংঘটিত খণ্ডযুদ্ধে বেশ কিছু সিপাহী নিহত ও বন্দি হয় এবং অনেকেই ময়মনসিংহের পথে পালিয়ে যায়।

আচ্ছা নানাভাই, ভারতের লক্ষনৌর ‘রেসিডেন্সিতে’ যেমন এখন সিপাহী বিদ্রোহের স্মৃতিচিন্থগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে, আমাদের বাংলাদেশেও কি তেমন কিছু আছে?’- ঐতিহ্য জানতে চাইলো।

নানা বললেন, সেভাবে কিছু নেই। তবে তোমাদের আমি এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে পারি, যেখানে ঢাকার বিদ্রোহী সিপাহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিলো!

এমন জায়গা আছে এখনও! আমরা দেখতে চাই-দু’ ভাই-বোন সমস্বরে বলে উঠলো।

নানা ভাই বললেন, চলো তাহলে দেখে আসি বাহাদুর শাহ পার্ক; এখানেই এক সময়ে বিদ্রোহী সিপাহীদের ফাঁসীতে ঝুলিয়ে হত্যা করা হয়েছিলো।

পরদিন শুক্রবার, তাই বেশ ভোরেই ওরা রওনা হলো বাহাদুর শাহ পার্কের উদ্দেশ্য। যাত্রাপথে অটো রিক্সা চালককে ‘বাহাদুর শাহ’ পার্ক গন্তব্য বলায় কিছুটা বিপত্তি বাঁধলো, এই নামে কোনো পার্কই নাকি কেউ চিনে না! অবশেষে এক বয়স্ক গম্ভীর চেহারার চালক বললেন, ‘বুচ্ছি আপনেরা ভিক্টোরিয়া পার্ক যাইবেন, হেইডা আগে কইলেই তো পারতেন!’ বিষয়টা হলো কাগজপত্রে নাম ‘বাহাদুর শাহ’ পার্ক হলেও বেশিরভাগ মানুষ এখনও একে ভিক্টোরিয়া পার্ক নামেই চিনে! যেতে যেতে নানা বললেন, বাহাদুর শাহ পার্কের বিভিন্ন সময়ের নামের পরিবর্তনটা কিন্তু বেশ চমকপ্রদ! ১৮ শতকের শেষভাগে এখানে আর্মেনীয়দের একটা ক্লাব ছিলো, তারা সেখানে বিলিয়ার্ড খেলতো। বিলিয়ার্ডের সাদা গোল বলগুলোর ডিমের মতো দেখতে বলে-স্থানীয় বাঙ্গালিদের চোখে ছিলো অদ্ভুত রকমের 'ডিম’-যা আবার লাঠি দিয়ে ঠেলে খেলতে হয়! সুতরাং তারা এই ক্লাবের নাম দিল ‘আন্ডাঘর’! ধীরে ধীরে অপভ্রংশ হয়ে আন্ডাঘর উচ্চারিত হয় ‘আন্টাঘর’ নামে! পরবর্তীকালে অর্মেনীয়রা রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান দুর্বল হয়ে পরলে তারা ক্লাবটা বিক্রি করে দেয় ইংরেজদের কাছে। ইংরেজরা ক্লাব ঘরটা ভেঙ্গে একে খোলা পার্ক বানিয়ে ফেলে, তখন এটা পরিচিত হয়ে ওঠে ‘আন্টাঘর ময়দান’ নামে। পার্কের চারিদিক লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা ছিলো আর ছিলো চারকোণায় চারটি দর্শনীয় কামান! আন্টাঘর ময়দানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ঢাকার নবাব আব্দুল গণি ও নবাব আহসান উল্লাহ। এরপর ১৮৫৮ সালে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে; রানী ভিক্টোরিয়া ভারতবর্ষের শাসনভার গ্রহণ করার পর এই ময়দানেই সেই সংক্রান্ত একটি ঘোষণা পাঠ করে শোনান ঢাকা বিভাগের কমিশনার। তারপর থেকে আন্টাঘর ময়দানের নামকরণ হয় ‘ভিক্টোরিয়া পার্ক’।

গল্প করতে করতে এক সময়ে ওরা পৌঁছে গেলো সবুজ গাছের প্রাচীরে ঘেরা বাহাদুর শাহ পার্কে সামনে। পার্কের ভিতরে সকালে স্বাস্থ্য সচেতন মানুষদের সমাগম। প্রচুর বড় বড় গাছের ভিতর দিয়ে হাঁটার জন্য সিমেন্টের রাস্তা করা আছে, আর আছে ব্যায়াম করার কিছু যন্ত্রপাতি।

নানা বললেন বললো, এই পার্ক এক সময় অনেক পামগাছ ছিলো। সেই পামেগাছের সারিতেই ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের সময় ঢাকার ধরা পরা বিদ্রোহীদের ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো! আর জানো, সেই বিদ্রোহীদের মধ্যে একজন নারীও ছিলো! এখন অবশ্য সেই পুরাতন গাছগুলোর কোনটাই আর অবশিষ্ট নেই, সব কেটে ফেলা হয়েছে। বিদ্রোহী সিপাহীদের ফাঁসি দেবার পর বহুদিন পর্যন্ত আন্টাঘর ময়দানের আশপাশ দিয়ে হাঁটতে ঢাকাবাসী ভয় পেত, কারণ এ জায়গা নিয়ে বিভিন্ন ভৌতিক কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিলো।

হেঁটে হেঁটে গল্প করতে করতে এক সময়ে পার্কের এক পাশে উপরের দিকে ক্রমশ: সরু হয়ে যাওয়া কোনা মিনারের মতো দেখতে একটা সৌধ দেখে ওরা এগিয়ে গেলো সেদিকে। একজন বেশ তাগরা জোয়ান চেহারার লোক তার উপরে উঠে ডন-বৈঠক দিচ্ছিলেন।

ঐতিহ্য জিজ্ঞেস করলো, ওটা কীসের মিনার নানা?

নানা বললেন, গ্রানাইট পাথরের এই সৌধটি ঢাকার নবার আবদুল গনির নাতি খাজা আফিজুল্লাহর। ১৮৮৪ সালে খাজা আফিজুল্লাহ মারা গেলে তার বন্ধুরা চাঁদা তুলে সৌধটি নির্মাণ করেছিলেন। ওরা এগিয়ে গিয়ে দেখলো লালচে গ্রানাইট পাথরের উপরে কাল রঙের এপিটাফে সব লেখা আছে।

খাজা আফিজুল্লাহর সৌধটির উল্টো পাশে আরেকটি স্মৃতি সৌধ দেখে ওরা সেটা দেখার জন্য এগিয়ে গেলো। এই সৌধটা দেখতে খুব সুন্দর এতে রয়েছে চারটি পিলার এর উপর দাঁড়ানো চারকোনা একটি কাঠামোর উপরে গোলাকার গম্বুজ । নানা বললেন-এই সৌধটি বানানো হয়েছিলো ১৯৫৭ সালে (মতান্তরে ১৯৬১)। সিপাহি বিদ্রোহের শতবার্ষিকী পালন উপলক্ষে সে বছর এই একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করে এ পার্কের নামকরণ করা হয় ‘বাহাদুর শাহ পার্ক’।

ঐতিহ্য জানতে চাইলো বাহাদুর শাহ কে ছিলেন? উত্তরে নানা বললেন, বাহাদুর শাহ জাফর ছিলেন শেষ মুঘল সম্রাট। সিপাহী বিদ্রোহের শুরুর দিকে বিদ্রোহী সিপাহীরা দিল্লীর লালকেল্লায় প্রবেশ করে নামেমাত্র মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে ভারতের স্বাধীন সম্রাট বলে ঘোষণা করেছিলেন এবং তাঁর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ভারত স্বাধীন করার শপথ নেন। বাহাদুর শাহ জাফর সিপাহিদের বিপ্লব তথা ভারতবর্ষের প্রথম সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এ সংবাদে কানপুর, লক্ষনৌ, বিহার, ঝাঁসি, বেরিলি থেকে শুরু করে পশ্চিম ও পূর্ববাংলার সর্বত্র সিপাহিরা গর্জে ওঠে, ‘খালক-ই খুদা, মুলক ই বাদশাহ, হুকুম ই সিপাহি’, অর্থাৎ আল্লাহর দুনিয়া, বাদশাহর রাজ্য, সিপাহির হুকুম। এরপর একের পর সেনাছাউনিতে বিদ্রোহ হতে থাকে। ১৮৫৮ সালে সিপাহী বিদ্রোহ দমন করার পর ইংরেজরা তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে রেঙ্গুন (বর্তমান বার্মা) নির্বাসিত করে এবং সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।

সিপাহী বিদ্রোহের প্রতি সম্মান জানাতে তাই এই পার্কটির নাম ভিক্টোরিয়া পার্কের বদলে বাহাদুর শাহ পার্ক রাখা হয়েছিলো। বাহাদুর শাহ পার্কটির আয়তন খুব বেশি বড় নয়, এক সময়ে পুরো পার্কটাই তারা চক্কর দিয়ে ফেললো। ততক্ষণে রোদ বেশ চড়ে গিয়েছে, ওরা পার্কের সামনের গেটের পাশের বেদিতে গিয়ে বসলো। সেখান থেকে উত্তরের দিকে গাছপালার ফাঁক দিয়ে ধবধবে একটা গির্জার চূড়া দেখা যাচ্ছিলো। নানা বললেন, ওটা বাংলার প্রাচীনতম চার্চগুলোর মধ্যে একটি, নাম সেইন্ট থমাস চার্চ! এর মাথায় একটা ঘড়ি আছে, সামনের দিকে গেলে তোমরা দেখতে পাবে। সেই ঘড়ির জন্য লোকে একে ঘড়ি চার্চ বলেই চেনে। আর ওদিকে গেলে ঢাকার প্রথম পানি সরবরাহ করার ট্যাংকটিও দেখতে পাবে তোমরা!

আরও নতুন জায়গা দেখার আনন্দে দু’ ভাই-বোনের চোখ মুখ খুশিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠলো!

তবে সেই গল্প তোমাদের কাছে আরেকদিন বলবো, আজ এটুকুই থাক।

তোমরা যারা বাহাদুর শাহ পার্কে ঘুরতে যেতে চাও, জেনে রাখ এই পার্কটি পুরানো ঢাকা এলাকার সদরঘাটের কাছে লক্ষ্মীবাজারে অবস্থিত। পার্কটির উত্তর-পূর্ব কোনে রয়েছে কবি নজরুল সরকারী কলেজ এবং ইসলামিয়া হাই স্কুল, পূর্ব দিকে ঢাকার অন্যতম প্রাচীন বিদ্যালয় সরকারী মুসলিম স্কুল এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সময় হাতে নিয়ে গেলে এক জায়গাতেই পুরানো ঢাকার অনেক ঐতিহ্যবাহী দর্শনীয় স্থান দেখে আসতে পারবে।