যে পথ চলার জন্য নয়

কেবল ফুটপাথ নয়, রাস্তার প্রায় পুরোটাই হকারদের দখলে। আম-কমলা, শাড়ি-চুড়ি কি নেই! ধাক্কা খেতে খেতে এর মধ্যেই চলতে হবে পথ; এই চিত্র রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানের।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2015, 04:40 AM
Updated : 13 July 2015, 07:17 AM

রোববার গুলিস্তান এলাকা ঘুরে দেখা যায়, স্টেডিয়াম প্রান্ত থেকে ফুলবাড়িয়া এলাকার সংযোগ সড়কগুলো সম্ভব সব উপায়ে দখল করা হয়েছে। কয়েকটি সড়কে দখলদারিত্বের মাত্রা এমনই যে, সেখানে রিকশা বা গাড়ি চলা তো দূরের কথা, পায়ে হেঁটে পার হতেও হিমশিম খেতে হয়।

যাত্রীবাহী ও মালবাহী যানবাহনের অবৈধ পার্কিংয়ের কারণে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে গুলিস্তান অংশের সড়কে এখন আর অন্য বাহন চলাচলের উপায় নেই। সংযোগ সড়কগুলোর এই দশার কারণে গুলিস্তানে অস্বস্তিকর যানজট লেগেই থাকে।

অথচ এই গুলিস্তানেই ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কার্যালয়, ফায়ার সার্ভিসের প্রধান কার্যালয়সহ বহু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি দপ্তর রয়েছে। সেইসঙ্গে তৈরি পোশাক, জুতাসহ বিভিন্ন পণ্যের পাইকারি বাজার থাকায় প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষকে গুলিস্তানে আসতে হয় এবং পোহাতে হয় ভোগান্তি। 

পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দিনভর যানজট লাঘবের চেষ্টা করতে দেখা গেলেও বেদখল রাস্তা নিয়ে তারা নির্বিকার।

হকারদের দাপটে যান চলাচলের জায়গা নেই রাজধানীর মহানগর নট্যমঞ্চ থেকে গোলাপশাহ মাজারমুখী সংযোগ সড়কে।

মহানগর নাট্যমঞ্চের পাশে ‘আন্ডারগ্রাউন্ড মার্কেট’ থেকে গোলাপ শাহর মাজারের দিকে আসার সংযোগ সড়কটি পুরোপুরি ফুটপাতের ‘ব্যবসায়ীদের’ দখলে।

এ সড়কের একপাশে ‘প্রবেশ নিষেধ’ লিখে ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে পুলিশ। ভেতরে কেউ কাগজ পেতে, কেউ টুকরিতে, আবার কেউ ফুটপাতে অস্থায়ী ঘর বসিয়ে নতুন ও ব্যবহৃত জুতার পসরা সাজিয়েছেন। ফলে এ পথ দিয়ে যান চলাচল বন্ধ।

রাস্তার একপাশে এই ব্যারিকেডের অভিনব ব্যাখ্যা পাওয়া গেল ট্রাফিক পুলিশের এএসআই শামিনুলের কাছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সড়কে হকাররা দোকান বসানোর ফলে গাড়ি ঢুকলে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতেই একপাশের সড়ক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।”

রাস্তা কি তাহলে চলাচলের জন্য নয়? - এ প্রশ্নের উত্তরে অসহায়ত্ব প্রকাশ করলেন শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বে থাকা এই পুলিশ সদস্য।

“আমরা তাদের যতবারই সরিয়ে দেই, তারা আবার এসে বসে পড়ে। গুলিস্তান এলাকার ফুটপাতের দোকান সরানো ট্রাফিক পুলিশের পক্ষে সম্ভব না, এটা তাদের কাজও না।”

একই পরিস্থিতি দেখা গেল একটু দক্ষিণে নবাবপুর রোড থেকে ফুলবাড়িয়া যাওয়ার সংযোগ সড়কটিতে। উপরে ফ্লাইওভার, নিচে হকারদের দখলে পুরো রাস্তা।

গুলিস্তানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের অংশে যান চলাচল পুলিশই বন্ধ রেখেছে। সেখানে এখন হকারদের পণ্যের পসরা।

যানজটে ‘বিশৃঙ্খলা’ হয়, তাই রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছে পুলিশ। গুলিস্তানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের দৃশ্য এটি।

ফুলবাড়িয়া থেকে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে বঙ্গবাজারে যাওয়ার সড়কটি পরিণত হয়েছে মহানগর ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় চলাচলকারী বাসের ‘গ্যারেজে’। সেখানে গাড়ি রেখে কলকব্জা খুলে মেরামত চলে। চালক ও তাদের সহকারীরা বাস থামিয়ে বিশ্রাম নেন।

রোববার ওই সড়কে ঘুরে দেখা যায়, ঢাকা-ধামরাই রুটের ঢাকা পরিবহন, শুভযাত্রা পরিবহন, গ্রামীণ সেবা, গাজীপুর রুটে গাজীপুর পরিবহন, গুলিস্তান আব্দুল্লাহপুর (১৩২), প্রভাতী বনশ্রী পরিবহন, গোপালগঞ্জ রুটের মধুমতি পরিবহন, ইমাদ পরিবহনের অর্ধশতাধিক বাস সড়ক আটকে দাঁড়িয়ে। এর অনেকগুলোতে চলছে মেরামতের কাজ।

তবে এসব গাড়ি সরিয়ে রাস্তা আবার চলাচলের উপযুক্ত করার ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশকে খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হল না। 

ফুলবাড়িয়ায় ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট ফোরকান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সড়কের ওই স্থানটি গাড়িচালকরা গ্যারেজ হিসেবে ব্যবহার করছে। তবে তাদের এটা করতে দেওয়া না দেওয়া ট্রাফিকের কাজ নয়। বিআরটিএ, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের ১২টি সংস্থা এ নিয়ে কাজ করে। সবাই উদ্যোগী না হলে এর সমাধান কঠিন।” 

ফুলবাড়িয়া সিটি সুপার মার্কেটের জেরিন সুজ এর স্বত্বাধিকারী তাজাম্মুল হক আকন্দ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত ২০ বছর ধরে এই এলাকায় তিনি ব্যবসা করেন। শুরু থেকেই অবৈধ দখলদারিত্বের এই চিত্র তিনি দেখে আসছেন।

মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে সড়কের একপাশ থামিয়ে রাখা বাসের দখলে, অন্যপাশে হকারদের জুতার ব্যবসা।

গুলিস্তানে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে রাস্তার একপাশ ব্যবহার হচ্ছে গাড়ির গ্যারেস হিসাবে।

“মাঝে মধ্যে কিছু হকারকে উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু তাদের ফিরে আসতে সময় লাগে না। আর গুলিস্তানে আসলেই যেন বাসগুলার মেরামতের প্রয়োজন হয়।”

ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে ফুলবাড়িয়া থেকে পূর্ব দিকের সড়কের বাকি অংশের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, সেখানে হকাররা স্থায়ী বসতি গেড়েছে। রাস্তার দুই ধারও দখল করেছে জুতা বিক্রেতারা।

ব্যবসায়ীদের অনেকেরই অভিযোগ, পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্থানীয় প্রভাবশালীদের মৌন সম্মতিতেই গুলিস্তানের এই দখলদারিত্ব চলে। এ জন্য বড় অংকের টাকারও লেনদেন হয়।

গুলিস্তান এলাকায় ফুটপাত দখলে করে ব্যবসা করছেন এরকম অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। নিয়মিত ‘লাইন চার্জ’ দিয়েই ব্যবসা করছেন বলে জানিয়েছেন তারা।