উন্নয়নের ‘ভোগান্তিতে’ মালিবাগ-মগবাজার

সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত রিকশা চালিয়ে একশ টাকাও তুলতে পারেননি হানিফ আলী।

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Oct 2015, 04:01 PM
Updated : 14 Oct 2015, 04:01 PM

রাজধানীর মগবাজার, মৌচাক, শান্তিনগর এলাকার এ রিকশাচালকের কপালে তাই চিন্তার ছাপ; ‘দিন শেষে রিকশা জমার টাকা দেবেন কীভাবে?’

মঙ্গলবার মগবাজার থেকে মালিবাগ যাওয়ার পথে শহীদ সাংবাদিক সেলিনা পারভীন সড়কে কথা হয় এ রিকশাচালক হানিফের সঙ্গে।

“ফ্লাইওভার হইতেসে, এ কারণে বেবাগ দিন এইহানে জ্যাম লাইগা থাহে। হের উপর দুই দিন থেইক্যা বৃষ্টির মইধ্যে রাস্তায় পানি জমসে। পাঁচ মিনিটের রাস্তায় যাইতে লাগে দেড় ঘণ্টা,” বলেন তিনি।

হানিফ আলীর এ বক্তব্যের মধ্য দিয়েই ফুটে ওঠে এ এলাকার মানুষের প্রতিদিনের দুর্ভোগের চিত্র।

একটু বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এবং উড়াল সেতুর নির্মাণকাজের কারণে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় যানজট।

মৌচাক-মালিবাগ উড়াল সেতুর নির্মাণ সামগ্রী রাস্তায় রেখে দেওয়ায় ওই পথে চলাচলকারী যানবাহনগুলো আটকে থাকে।

বাংলামোটর থেকে মগবাজার এবং মগবাজার থেকে মৌচাক, মালিবাগ মোড় পর্যন্ত সড়কে উড়াল সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের রড, লোহার স্ল্যাবগুলোও ছড়ানো রয়েছে রাস্তার উপরে; যাতে সরু রাস্তা আরও সরু হয়েছে। প্রায় পুরো রাস্তাটি খানাখন্দে ভরা, ফলে সারাদিনই লেগে থাকছে যানজট।

নগরীর অন্যতম ব্যস্ত এলাকা মালিবাগ থেকে বাসে এক কিলোমিটারের মতো পথ মগবাজারে পৌঁছাতে আগেও কিছুটা সময় লাগত মৌচাক মার্কেটের সামনের ভিড়ের কারণে। তবে ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ শুরুর পর এই দূরত্ব পেরোতে কখনও কখনও দুই থেকে তিন ঘণ্টাও লাগছে।

মহাখালীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন ইস্কাটনের বাসিন্দা হাফিজুর রহমান। বাংলামোটর থেকে কারওয়ানবাজার-ফার্মগেইট হয়ে মহাখালীর বাসে যাতায়াত করলেও দুদিন মালিবাগ থেকে বাসে উঠে পড়েন বিড়ম্বনায়।

দুই দিনই দেড় ঘণ্টার মতো বাসে বসে থাকার পর এক পর্যায়ে হেঁটে মগবাজার মোড়ে এসে মহাখালীমুখী বাসে উঠে অফিসে পৌঁছান বলে জানান তিনি।

মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার বাসিন্দা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তন্ময় আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিটি দিন এ এলাকায় চলাচলকারীদের অবর্ণনীয় ভোগান্তির মধ্য দিয়ে পার করতে হয়। বিশ্বের সব দেশেই উন্নয়ন হয়। কিন্তু উন্নয়নের জন্য কোনো দেশে এমন ভোগান্তি হয় তা আমার জানা নেই।”

গুলিস্তান থেকে মালিবাগ, মগবাজার হয়ে গাজীপুরে যাতায়াতকারী বলাকা পরিবহনের চালক মনসুর মিয়া বলেন, “ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে আটকে থাকতে হয়। কোনো দিনই দুইবারের বেশি যাত্রী পরিবহন সম্ভব হয় না। তার উপরে রাস্তা এতো খারাপ দুই দিন পরপর গাড়ির কোনো না কোনো পার্টস বদলাতে হয়।”

নিত্যদিনের এ ভোগান্তি থেকে রেহাই পেতে বিকল্পের খোঁজে আছেন বাসচালকরাও। গুলিস্তান-গাজীপুর রুটের স্কাইলাইন পরিবহন সব সময় মালিবাগ-মগবাজার হয়ে চলাচল করলেও বুধবার বাংলামোটর মোড়ে যাত্রীভরতি তাদের একটি বাস দেখা যায়। কারওয়ান বাজার হয়ে সাতরাস্তায় গিয়ে নিজের রুটের সঙ্গে মিলে গাজীপুরের দিকে যায় বাসটি।

মালিবাগ থেকে মগবাজারের রাস্তায় প্রচুর খানাখন্দ থাকায় বৃষ্টির দিনে সেখানে পানি জমে তা দুর্ভোগ আরও কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। রিকশা উল্টে যাত্রী আহত হওয়ার ঘটনাও প্রায় নিয়মিত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আর ফুটপাতগুলো ‍মূল সড়কের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়ায় পথচারীদের হাটাচলারও জো নেই। কাদা, পানি আর ময়লা মাড়িয়েই হাঁটতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে।

২০১৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি এ উড়াল সড়কের নির্মাণ কাজ উদ্বোধন হয়। দুই বছরের মধ্যে নির্মাণ শেষ করার কথা ছিল। নির্ধারিত সময়ে কাজ শেষ না হওয়ায় পরে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর সময় বাড়ানো হয়েছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের তত্ত্বাবধানে এই উড়ালসড়ক নির্মাণ করছে ভারতের সিমপ্লেক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড ও নাভানার যৌথ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠান ‘সিমপ্লেক্স নাভানা জেভি’ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান দ্য নাম্বার ফোর মেটালার্জিক্যাল কনস্ট্রাকশন ওভারসিজ কোম্পানি (এমসিসিসি) ও তমা কনস্ট্রাকশন লিমিটেড।

প্রকল্পটির নির্মাণ ব্যয়ের সাতশ ৭২ কোটি ৭০ লাখ টাকার মধ্যে সরকার দেবে দুশ কোটি ৪৭ লাখ, সৌদি ফান্ড ফর ডেভেলপমেন্ট তিনশ ৭৫ কোটি ২৫ লাখ এবং ওপেক ফান্ড ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট একশ ৯৬ কোটি ৯৮ লাখ টাকা দেবে।

এ উড়ালসড়ক নির্মাণ নিয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ধরনের বড় প্রকল্প যখন হাতে নেওয়া হয় তখন অবশ্যই বিকল্প চলাচলের ব্যবস্থা করতে হয়।

“যেহেতু এ এলাকাটিতে পর্যাপ্ত বিকল্প রাস্তা নেই সে কারণে যেটুকু সড়কে যান চলাচল হচ্ছে সেটুকুকে যে কোনোভাবেই হোক সচল রাখতে হবে।”

রাজধানীর মৌচাক-মালিবাগ উড়াল সেতু প্রকল্পের সড়কে ড্রেনেজ ব্যবস্থা না থাকায় একটু বৃষ্টিতেই মগবাজার, মৌচাক, মালিবাগসহ আশপাশের এলাকায় পানি জমে যাওয়ায় ভোগান্তির শিকার হন মানুষ। ছবিটি মৌচাকের।

একটু বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এবং উড়াল সেতুর নির্মাণকাজের কারণে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় যানজট।

ওই সড়ক দিয়ে চলাচলের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, “আমি সম্প্রতি যতবারই এ সড়কটি দিয়ে যাওয়া-আসা করেছি, আমার মনে হয়েছে আমার গাড়ি বুঝি ভেঙে যাবে। যে একটি লেনে যান চলাচল করছে সেটিকে সচল রাখার কোনো উদ্যোগ নেই।”

অধ্যাপক নজরুল বলেন, “এ ধরনের প্রকল্পের ম্যানেজমেন্ট ভালো হওয়া উচিত। যেহেতু বিকল্প সড়ক নেই তাই প্রয়োজনে সারা রাত কাজ করে ভাঙা সড়কটি ঠিক করতে হবে যেন পরদিন সকালে এটি দিয়ে চলাচল করা যায়।”

জনগণের ভোগান্তির কথা স্বীকার করেছেন মগবাজার-মৌচাক উড়াল সেতু নির্মাণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) নাজমুল আলম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জনগণের ভোগান্তির যে কথাটি আপনি বলছেন, এর সাথে আমি সম্পূর্ণ একমত। এ প্রকল্পে জনগণের যাতায়াতের জন্য আমরা কোনো বিকল্প ব্যবস্থা করতে পারিনি।

“এখানে আমাদের কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এ উড়ালসেতুটি এমন একটি স্থানে নির্মিত হচ্ছে যে এলাকায় বিকল্প রাস্তা দেওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। এতে জনগণের যেমন অসুবিধা হচ্ছে, যারা কনস্ট্রাকশন করছেন তাদেরও অসুবিধা হচ্ছে।”

তবে নিয়মিত ভেঙে যাওয়া রাস্তাগুলো মেরামত করে যান চলাচল স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন তিনি।

“কিন্তু এ এলাকায় একটু বৃষ্টি হলেই রাস্তায় পানি জমে যায়, আর এতে রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের কন্সট্রাকশনের জন্য কোনো রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি।”

একটু বৃষ্টিতে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা এবং উড়াল সেতুর নির্মাণকাজের কারণে রাস্তা সরু হয়ে যাওয়ায় যানজট।

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে উড়াল সেতুর সাতরাস্তা থেকে হলিফ্যামিলি হাসপাতালের অংশটি উন্মুক্ত করে দেওয়া সম্ভব হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

“কাজ যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে আমরা আশাবাদী, ডিসেম্বরের মধ্যে একটি অংশ যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া যাবে। আগামী বছরের মার্চের মধ্যে মগবাজার-ইস্কাটন ও ওয়্যারলেস গেইট অংশ এবং আগামী বছরের ডিসেম্বর নাগাদ শেষ অংশ রাজারবাগ-শান্তিনগর থেকে রামপুরা অংশটিতে পুরোপুরি যান চলাচল শুরু করা যাবে।”

তিনটি অংশে চার লেনের এ উড়ালসড়কের দৈর্ঘ্য হবে ৮ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। এটি সাতরাস্তা, এফডিসি, মগবাজার, মৌচাক, শান্তিনগর, মালিবাগ, চৌধুরীপাড়া, রমনা থানাসহ মোট আটটি মোড় এবং মগবাজার-মালিবাগসহ দুটি রেলক্রসিং অতিক্রম করবে।

চার লেনবিশিষ্ট এ উড়ালসড়কে ওঠানামার জন্য আটটি লুপ থাকবে। এটি থেকে তেজগাঁওয়ের সাতরাস্তা, এফডিসি, মগবাজার, হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল, বাংলামোটর, মগবাজার, মালিবাগ, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও শান্তিনগর মোড়ে ওঠানামার ব্যবস্থা রাখা হবে।