বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত

‘চিকিৎসক বা বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে দাঁড়িয়ে অনেক পরীক্ষা করে বলছে-এটাই শ্রেষ্ঠ পণ্য, তখন যারা বিষয়গুলো কিছুটা জানে কিন্তু ভালোমতো জানে না তারা বেশি বিভ্রান্ত হয়,’ বাংলাদেশে বিকল্প শিশু খাদ্যের প্রতি অভিভাবকদের ঝোঁকের কারণ ব্যাখ্যায় বিজ্ঞাপনের ভূমিকা নিয়ে একথা বলেছেন একজন বিশেষজ্ঞ।

কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Sept 2014, 12:52 PM
Updated : 28 Sept 2014, 03:19 PM

শিশুর খাদ্য হিসেবে মায়ের দুধই সর্বশ্রেষ্ঠ- বিষয়টি বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত হলেও বিশেষ কিছু পরিস্থিতিতে চিকিৎসকের পরামর্শে শিশুকে বিকল্প শিশুখাদ্য দেয়া যেতে পারে।  তাই বাজারে চাহিদা থাকায় এসব পণ্য প্রস্তুত করছে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান।

এই বিকল্প শিশুখাদ্যের বিপণনে বিজ্ঞাপন ও অন্য যে কোনো ধরনের প্রচারণা আইনে নিষিদ্ধ এবং ভোক্তাদের সামনে তা প্রদর্শনের জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও আইনের বাস্তবায়ন নেই। এ সুযোগে বাংলাদেশে অবাধে চলছে বিকল্প শিশু খাদ্যের বিজ্ঞাপন।

এই বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত হয়েই অভিভাবকরা বিকল্প শিশুখাদ্যের দিকে ঝুঁকছেন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এসব অভিভাবকদের মধ্যে আবার ‘শিক্ষিত’ শ্রেণির অভিভাবকই বেশি।

ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনিস্টিটিউট অব এডুকেশনাল রিসার্চের জেন্ডার অ্যান্ড এসআরএইচআর  (সেক্সুয়াল অ্যান্ড রিপ্রোডাকটিভ হেলথ অ্যান্ড রাইটস) বিশেষজ্ঞ শুচি করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “টেলিভিশন বা পত্রিকার বিজ্ঞাপনগুলোতে যখন দেখানো হয় চিকিৎসক বা বিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে দাঁড়িয়ে অনেক পরীক্ষা করে বলছে -এটাই শ্রেষ্ঠ পণ্য, তখন যারা বিষয়গুলো কিছুটা জানে কিন্তু ভালোমতো জানে না তারা বেশি বিভ্রান্ত হয়।

“যেভাবে ইন্সট্রুমেন্টস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দেখানো হয়, তাতে স্বল্পশিক্ষিত মায়েরা বা অভিভাবকরা মনে করেন, এতো ‘বড় বড়’ মানুষ যখন জিনিসটাকে ভালো বলছে তখন এটাই সবচাইতে ভালো।”

এ প্রবণতা শহর অঞ্চলেই বেশি কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের দেশে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে তাদের আর্থিক অসঙ্গতির কারণেই টেলিভিশন বা পত্রিকা-কোনোটাই খুব সুলভ না। ফলে এই বিভ্রান্তির বিষয়টি শহর এলাকার অভিভাবকদের মধ্যেই বেশি।”

বর্তমানে বাংলাদেশে বিকল্প শিশুখাদ্য পণ্য বাজারজাত করছে অন্তত ছয়টি প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে দুটি- নেসলে বাংলাদেশ ও আরলা ফুডস বাংলাদেশ।

এছাড়া রয়েছে লালমাই গ্রুপ, আবুল খায়ের গ্রুপ,বায়োমিল, বেবিকেয়ারসহ আরো কিছু প্রতিষ্ঠান।

সবচেয়ে জনপ্রিয় বিকল্প শিশুখাদ্য পণ্য ‘সেরেল্যাক’ প্রস্তুত করে  নেসলে বাংলাদেশ। এছাড়া তাদের আরো দুটি বিকল্প শিশুখাদ্য পণ্য রয়েছে বাজারে।

নেসলে বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ডিরেক্টর নকিব খানের দাবি আইন লংঘন করে নেসলের কোনো পণ্যেরই বিজ্ঞাপন দেয়া হয় না।

তিনি বলেন, “আমাদের বিকল্প শিশুখাদ্য পণ্যগুলোর কোনো ধরনের বিজ্ঞাপন কোথাও প্রচার করা হয় না। বাংলাদেশ সরকারের আইন অনুযায়ী  এ ধরনের প্রতিটি পণ্যের মোড়কে লেখা থাকতে হবে, ‘মায়ের দুধই সর্বশ্রেষ্ঠ’। আমরা সেটা করি। এর বাইরে অন্য কোথাও আমাদের পণ্যের কোনো বিজ্ঞাপন করা হয় না। এমনকি এসব পণ্যের ব্র্যান্ডিংয়ের জন্য কোনো ধরনের উপহারও দেয়া হয় না।”

নেসলের পণ্য নিডো ফরটিফাইডের বিজ্ঞাপন টেলিভিশনে প্রচারিত হওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, “আইন অনুযায়ী পাঁচ বছরের নিচে বয়সী শিশুদের জন্য কোনো বিকল্প খাদ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। নিডো ফরটিফাইডের মোড়কের গায়ে লেখাই রয়েছে- এটি পাঁচ বছরের বেশি যে কোনো বয়সীদের জন্য প্রযোজ্য।”

বিভিন্ন দোকান বা সুপার শপে জায়গা ভাড়া নিয়ে সেরেল্যাক প্রদর্শনীর পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নকিব খান বলেন, “নেসলের ব্যবসায়িক নীতি হলো- যে কোনো পণ্য কারখানা থেকে শুরু করে ভোক্তার হাতে পৌঁছানো পর্যন্ত পণ্যটির স্বাস্থ্যসম্মত মান ও গুণাগুণ রক্ষা করা।

“বিদেশে এসব পণ্য বিক্রি হয় ফার্মেসিগুলোতে এবং চিকিৎসকের পরামর্শপত্র ছাড়া এগুলো কেউই কিনতে পারে না। আমাদের দেশে যে কোনো মুদি দোকানেও এসব বিক্রি হয় এবং অভিভাবকরা চিকিৎসকদের পাশ কাটিয়ে দোকানদারদের কাছে পরামর্শ চান।

“কোনো দোকানে যদি অ্যারোসল বা ওই জাতীয় কোনো পণ্যের পাশে শিশুখাদ্য সাজিয়ে রাখা হয় তাহলে শিশুখাদ্যের মান ও গুণাগুণ নিশ্চিত করা কী সম্ভব?”

তিনি বলেন, “পণ্য প্রদর্শনের জন্য নেসলের ভাড়া করা স্থানটি সবদিক দিয়ে স্বাস্থ্যসম্মতভাবে নিরাপদ করে নেয়া হয় এবং রক্ষণাবেক্ষণও নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করা হয়। এর সঙ্গে আমাদের পণ্য বিক্রির কোনো সম্পর্ক নেই।

“পণ্য বিক্রি না হলেও আমরা ওই স্থানের ভাড়া দেই এবং রক্ষণাবেক্ষণ করি। এটা আমাদের প্রতিষ্ঠানের নীতি, এবং আইন লঙ্ঘন না করেই তা করা হয়।”

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিক্রি হওয়া শিশু খাদ্যগুলোতে যেসব পুষ্টিগুণ রয়েছে বলে দাবি করা হয় সেগুলো কৃত্রিম উপাদানের মাধ্যমে তৈরি করা হয়ে থাকে। ফলে শিশুর স্বাস্থ্যগঠন ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতে সেগুলোর সঙ্গে মায়ের দুধের রয়েছে স্পষ্ট পার্থক্য।

বাজারে বিক্রি হওয়া কৃত্রিম পুষ্টিযুক্ত বিকল্প খাদ্যগুলোতে শিশুর শরীরে প্রয়োজনীয় পুষ্টির ঘাটতি যেমন দেখা দেয়, তেমনি প্রাকৃতিকভাবে রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরিতেও ঘাটতি থেকে যায়। ফলে সামান্য অসুখেই শিশুর স্বাস্থ্য অনেক ভেঙে পড়ে। এছাড়া বয়সের সঙ্গে শিশুর ওজন ও উচ্চতা ঠিকমতো বাড়ে না, এমনকি মস্তিষ্কের গঠনও ঠিকমতো হয় না।

সেজন্য জন্মের পর থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ ছাড়া শিশুর মুখে অন্য কিছু দেয়াতে নিষেধ থাকে চিকিৎকদের। ছয় মাস পর্যন্ত শিশুকে শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানোর প্রক্রিয়াটি বিশ্বব্যাপী ‘এক্সক্লুসিভ ব্রেস্ট ফিডিং’ (ইবিএফ) হিসেবে পরিচিত।

সারা বিশ্বে শিশুদের সুষম পুষ্টি নিশ্চিত করতে ১৯৮১ সালে জেনেভায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সদস্য দেশগুলো মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য বিপণন নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা প্রণয়ন করে যা ‘ইন্টারন্যাশনাল কোড অব মার্কেটিং অব ব্রেস্টমিল্ক সাবস্টিটিউটস’ নামে পরিচিত। এরপর ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশে  ‘মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য (বিপণনের নীতিমালা) আইন’ প্রণয়ন করা হয়।

২০১৩ সালের ২২ অক্টোবর এ আইনটি সংশোধন করা হয়। তবে সংশোধিত আইনের বিষয়ে পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ১৯৮৪ সালের আইনটি রহিত করা হয়েছে এই আইনেই। ফলে বর্তমানে দেশে বিকল্প শিশুখাদ্য নিয়ন্ত্রণ বিষয়ে কোনো আইনেরই কার্যকারিতা নেই বলে মনে করছে কর্তৃপক্ষ।

১৯৮৪ ও ২০১৩ সালের উভয় আইনেই মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য ভোক্তাদের সামনে প্রদর্শনের শাস্তি হিসেবে জরিমানা ও কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। তবে রাজধানী ঢাকার সুপার শপগুলো থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যন্ত বিভিন্ন দোকানে অবাধেই বিক্রি হচ্ছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মাতৃদুগ্ধ বিকল্প খাদ্য।