বারডেমে দুর্ভোগের অবসান

‘হামলাকারী’ পুলিশ কর্মকর্তাকে দায়িত্ব থেকে সরানোর পর কাজে ফিরেছেন বারডেম হাসপাতালের ধর্মঘটী চিকিৎসকরা। এর ফলে অচলাবস্থা কেটেছে ডায়বেটিক রোগীদের জন্য বিশেষায়িত এই বেসরকারি হাসপাতালে।

কামাল তালুকদারনুরুল ইসলাম হাসিব, , সুজন মণ্ডলবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 April 2014, 04:05 PM
Updated : 20 April 2014, 10:15 AM

গত রোববার রাতে এক রোগীর মৃত্যুর পর তার স্বজনরা হাসপাতাল ভাংচুর এবং তিনজন চিকিৎসকের ওপর হামলা চালালে তার প্রতিবাদে মঙ্গলবার সকাল থেকে ধর্মঘট শুরু হয়।

হামলাকারী হিসেবে ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে চিহ্নিত করে তার শাস্তি দাবিতে চিকিৎসকরা সড়কে নেমে বিক্ষোভ-মানববন্ধনও করেন।

জরুরি বিভাগ, আইসিইউ ও সিসিইউ ছাড়া অন্য সব সেবা এবং রোগী ভর্তি বন্ধ করে দেয়ায় চরম দুর্ভোগে পড়েন দূর-দূরান্ত থেকে আসা রোগীরা।

চিকিৎসকদের এই ধর্মঘট নিয়ে আলোচনা সরকারি পর্যায়েও গড়ায়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম চিকিৎসক লাঞ্ছনার জন্য দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বলার পাশাপাশি পুলিশকে হুমকিও দেন।

এর মধ্যেই বুধবার বিকালে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাসুদ হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথা জানানো হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা এ কে এম কামরুল আহছান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকা জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এ বি এম মাসুদ হোসেনকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।”

এরপর সন্ধ্যায় বারডেম হাসপাতালের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুন নাহার সাংবাদিকদের জানান, পুলিশ কর্মকর্তাকে প্রত্যাহার করে নেয়ার পর চিকিৎসকরা ধর্মঘট তুলে কাজে যোগ দিয়েছেন।

“চিকিৎসকরা ধর্মঘট প্রত্যাহার করে নিয়েছেন, এখন পুরোদমে চিকিৎসা সেবা শুরু হয়েছে।”

এরপর আন্দোলনকারী চিকিৎসকদের মুখপাত্র হাসপাতালের জ্যেষ্ঠ চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. আনোয়ারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তারা সাময়িকভাবে কর্মবিরতি প্রত্যাহার করেছেন, তবে আন্দোলন চলবে।

বুধবার সকালে শাহবাগ মোড়ে ধর্মঘটী বারডেম চিকিৎসকদের মানববন্ধন।

হামলার শিকার তাদের সহকর্মীদের পোশাক সাংবাদিকদের দেখান চিকিৎসকরা

হামলাকারীদের শাস্তির দাবিতে বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় শাহবাগ মোড়ে মানববন্ধন থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে বলে জানান তিনি।

কী দাবিতে আন্দোলন চলবে- জানতে চাইলে ডা. আনোয়ার বলেন, “বারডেম একটি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান। এখানে ডাক্তারকে লাঞ্ছিত করা হল। এটার প্রতিকার চাচ্ছি।

“যারা কাজটি ঘটিয়েছে, তাদের বিচারের আওতায় আনা নিশ্চিত করতে হবে। সরকারকে ডাক্তারদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।”

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদের শাস্তির দাবিতে ধর্মঘটী এই চিকিৎসকরা বুধবার সকালেও সড়ক আটকে শাহবাগে মানববন্ধন করেছিলেন।

দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে তারা শাহবাগ মোড়ে বিক্ষোভ শুরু করলে ১৫-২০ মিনিটের জন্য সব দিকের যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

রমনা বিভাগের পুলিশের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিকিৎসকরা বিক্ষোভ শুরু করলে যান চলাচলে ব্যাঘাত ঘটে। পরে পুলিশ তাদের বুঝিয়ে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।”

সড়ক থেকে উঠে বারডেমে সংবাদ সম্মেলন করে কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন এই চিকিৎসকরা।

ওই সংবাদ সম্মেলনে ডা. আহমেদ সালাম মীর বলেন, “আমরা চিকিৎসকরা কর্মবিরতি পালন করতে চাই না। রোগীদের সেবা দিতে চাই। কিন্তু নিজেরা নিরাপত্তাহীনতায় থেকে চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব নয়।”

এর মধ্যেই স্বাস্থ্যমন্ত্রী বারডেম ঘুরে রিপোর্টার্স ইউনিটিতে গিয়ে এক সভায় বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উদ্দেশ করে বলছি- অবিলম্বে ওই অ্যাডিশনাল এসপিকে প্রত্যাহার করুন। তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিন।

“তা না হলে সারাদেশে পুলিশ হাসপাতালসহ পুলিশের জন্য যে সব সরকারি স্বাস্থ্য সেবা রয়েছে, সব বন্ধ করে দেয়া হবে, আমি বলে দিলাম।”

বারডেমের বিষয়ে চিকিৎসক নেতারা মঙ্গলবার স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করলে তিনি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালকে টেলিফোন করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করেছিলেন।

রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এই আলোচনা সভায় পুলিশকে হুঁশিয়ার করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী

পুলিশকে উদ্দেশ্য করে নাসিম বলেন,“আপনাদের দায়িত্ব জনগণের সেবা করা, ডাক্তারদেরও তাই। আপনাদের কোনো অভিযোগ থাকলে তা আমাদের জানাতে পারতেন, আমরা অভিযোগ খতিয়ে দেখে দোষী ব্যাক্তির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নিতে পারতাম- ডাক্তারদের পেটালেন কেন?”

গত রোববার রাত ৮টার দিকে বারডেম হাসপাতালে পুরান ঢাকার এক রোগীর মৃত্যু হয়। ওই পুলিশ কর্মকর্তা মৃত রোগীর ভাই।  

চিকিৎসায় অবহেলার কারণে তার মৃত্যু হয়েছে দাবি করে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালে ভাংচুর চালানোর পাশাপাশি লাঞ্ছিত করে তিন চিকিৎসককে।

এর পরদিন বাংলা নববর্ষ হওয়ায় সেদিন কোনো কর্মসূচি দেননি চিকিৎসকরা। পরদিন থেকে ধর্মঘট শুরু করেন তারা।

রোগীদের দুর্ভোগ

চিকিৎসকরা ধর্মঘটে যাওয়ার  পর থেকে বারডেমে রোগী ভর্তি বন্ধ করে দেয়া হয়। ফলে অনেক দূর থেকে এসে অনেককে হতাশ হতে হয়।

বুধবার সকালে হাসপাতালের বহির্বিভাগসহ কয়েকটি ইউনিটের সামনে অপেক্ষারত রোগীদের অসহায়ত্বের পাশাপাশি ক্ষোভও প্রকাশ করতে দেখা যায়।

ভর্তি রোগীদের ছাড়পত্র ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে মঙ্গলবারই কয়েকজন অভিযোগ করেছিলেন। বুধবার বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে শয্যাগুলো খালি দেখা যায়।

সার্জারি ও অর্থোপেডিক্স ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, দুজন রোগী ভর্তি রয়েছে; যদিও ওই ওয়ার্ডের রোগীর ধারণ ক্ষমতা ১৪ জন।

সাততলায় মেডিসিন ওয়ার্ডে ১৪টি শয্যা থাকলেও দুজন রোগীকে পাওয়া যায়, যাদের স্বজনরা চিকিৎসা সেবা না পাওয়ার অভিযোগ জানান।

৬২৮ নম্বর শয্যার রোগী শাহনাজ পারভীনের (৪০) সঙ্গে থাকা স্বপ্না বেগম বলেন, সবগুলো বিছানায় রোগী ছিল। কিন্তু ধর্মঘটের কারণে একে একে সবাই চলে গেছে।

বারডেম হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ধারণ ক্ষমতা সব মিলিয়ে ৫৭৩ জন। তার মধ্যে আইসিইউ ও সিসিইউ রয়েছে ৫৮টি। আর কেবিন রয়েছে ১৪৪টি, বাকিগুলো সাধারণ বেড।

ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসা না পেয়ে বারডেমে হতাশ বসে একজন।

ধর্মঘটের কারণে চিকিৎসা না পেয়ে বারডেমে হতাশ বসে একজন।

হাসপাতাল পরিচালক শহীদুল হক মল্লিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিদিন বহির্বিভাগে আড়াই থেকে তিন হাজার রোগী আসে।

ধর্মঘটের কারণে রোগীও সংখ্যাও কমে গেছে বলে স্বীকার করেন পরিচালক। তবে তিনি বলেন, জরুরি বিভাগ, বহির্বিভাগে চিকিৎসা সেবা দেয়া হচ্ছে।

ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার কথা কর্তৃপক্ষ বললেও বাস্তবে এর প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনেক নতুন রোগীকেও সেবা না পেয়ে ফিরে যেতে দেখা যায়।

সকালে বারডেমের বারান্দায় চেয়ারে মাথায় হাত দিয়ে বসে ছিলেন তোফাজ্জল হোসেন (৫৫)। কুড়িগ্রাম থেকে এসেছেন তার ডায়াবেটিস আক্রান্ত স্ত্রীকে নিয়ে।

তিনি বলেন, সকাল ৯টার দিকে হাসপাতালে পৌঁছার পর থেকে চিকিৎসককে দেখানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কাউকেই পাচ্ছি না।

তোফাজ্জল বলেন, “আমরা দুই মাস আগে এসে একবার চিকিৎসা নিয়েছি। ডাক্তার আবার আমাদের আসতে বলেছিলেন। কিন্তু এখন ডাক্তারকে পাচ্ছি না। এই বৃদ্ধ বয়সে এতা দূর থেকে বাসে আসতেও অনেক কষ্ট হয়। আবার ঢাকা শহরে বাসাভাড়া নিয়ে থাকার মতোও অবস্থা নেই।”

পটুয়াখালী থেকে আসা মো. ইউসুফ আলীসহ অনেককে হাসপাতালের বহির্বিভাগে ঘুরোঘুরি করতে দেখা যায়।

ডায়াবেটিস আক্রান্ত আজিজ হাওলাদার বললেন, “দুই দিন থেকে ডাক্তার দেখানোর জন্য ঘুরতেছি। কাল আইসা দেখি হাসপাতাল বন্ধ। আজকাও তাই দেখতেছি “

চিকিৎসকরা কেন রোগী দেখছেন না, জানেন না কি- প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, “তাদের তো কোন দয়া-মায়া নাই। না দেখলে কারো কিছু করার আছে?”