স্বাস্থ্যে ‘ব্যতিক্রমী’ বাংলাদেশ

বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র দেশ হওয়ার পরেও গত ৪০ বছরে স্বাস্থ্য খাতে ‘যুগান্তকারী সফলতা’ অর্জন করেছে বাংলাদেশ।

নুরুল ইসলাম হাসিব জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Nov 2013, 06:40 AM
Updated : 22 Nov 2013, 07:27 AM

গবেষকরা বলছেন, এই সময়ে শিশু মৃত্যুর হার কমেছে, গড় আয়ু বেড়েছে এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে দারুণ অগ্রগতি করেছে দেশটি।

বৃহস্পতিবার প্রকাশিত স্বাস্থ্য বিষয়ক এক আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে এই অগ্রগতিকে ‘বিশ্ব স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে অন্যতম বড় রহস্য’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন গবেষকরা।

দরিদ্রতা, প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের কারণে দেশটি যেখানে প্রায়ই আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়, তার মধ্যে এধরণের অগ্রগতিকে বড় ‘ধাঁধা’ হিসেবেই দেখছে স্বাস্থ্য বিষয়ক সাময়িকী দ্য ল্যানসেট।

তবে পরিবর্তনশীল রোগের ধরণ ও অপুষ্টির সঙ্গে দরিদ্রতা অব্যাহত থাকায় কোনো ধরণের আত্মতুষ্টিতে না ভুগতে সতর্ক করে দিয়েছেন গবেষকরা।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এই গবেষণা কাজের সহ-তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুশতাক চৌধুরী।

তিনি বলেন, “দরিদ্রতা হ্রাস ও স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্ট সম্পদ বৃদ্ধি উন্নততর জনস্বাস্থ্যের প্রধান চালিকাশক্তি- বিশেষজ্ঞদের এই মতকে খারিজ করে দিয়ে বাংলাদেশ গত ৪০ বছরে তার প্রতিবেশী এশীয় দেশগুলিকে ছাড়িয়ে গেছে।”

চীন, ভারত, পাকিস্তান ও আফ্রিকার পর প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ নিয়ে এধরণের গবেষণা হল।

সাময়িকীতে বলা হয়েছে, স্থানীয় পর্যায়ে গতিশীলতা তৈরি, লিঙ্গ সমতা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্যসেবার প্রতি বাংলাদেশের প্রতিশ্রুতি পূরণ থেকে অন্যরা ব্যতিক্রমী এই শিক্ষা নিতে পারে।

১৯৮০ সালের পর বাংলাদেশে প্রসূতি মৃত্যুর হার ৭৫ শতাংশ কমেছে যেখানে শিশু মৃত্যুর হার ১৯৯০ সালের পর প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। গড় আয়ু বেড়ে ৬৮ দশমিক ৩ বছরে উন্নীত হয়েছে, যা ভারতের ৬৭ বছর ও পাকিস্তানের ৬৬ বছরের চেয়ে বেশি।

গবেষকদের মতে, স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের ব্যয় কম হলেও স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় সরকারি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ একসঙ্গে চলমান আছে। এর ফলে ডায়রিয়ার চিকিৎসা, পরিবার পরিকল্পনা, ভিটামিন এ সম্পূরক কর্মসূচি এবং রোগ প্রতিষেধকের মতো জরুরি সেবা দেয়ার ক্ষেত্রে দ্রুত অগ্রগতি করেছে বাংলাদেশ।

এর মধ্যে যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণে সবচেয়ে বড় উদাহরণ সৃষ্টি হয়েছে, বাংলাদেশের ধারে কাছেও কেউ নেই। সংক্রামক ও দুরারোগ্য এই রোগটির বিরুদ্ধে বহু বছর লড়াই করেও ভারত সফল হতে পারেনি।

গবেষকরা বের করেছেন, গ্রাম পর্যায়ে বিপুলসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োজিত করায় বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিরাময়ের হার ৫০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৯০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ হারগুলোর মধ্যে অন্যতম।

জন্মনিরোধক ওষুধের ব্যবহার বাড়ানোর লক্ষ্যে ঘরে ঘরে পরিবার পরিকল্পনা সেবা পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ নারী স্বাস্থ্যকর্মী নিয়োগ করায় জন্মনিরোধকের ব্যবহার (৬২ শতাংশ) অনেক বেড়েছে। এ কারনে নারীপ্রতি জন্ম হার ১৯৭১ সালের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ থেকে কমে ২০১০ সালে ২.৩ শতাংশে নেমেছে, যা প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অসমান্তরাল।

উদাহরণস্বরূপ, পাকিস্তানে জন্মনিরোধকের ব্যবহারের হার ৩৫ শতাংশ এবং  নারীপ্রতি জন্ম হার ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।

গবেষণাকাজের অন্যতম তত্ত্বাবধায়ক আইসিডিডিআরবির অধ্যাপক আব্বাস ভুইয়া বলেন, “গবেষণাভিত্তিক উদ্ভাবনের অবাধ সংস্কৃতিকে সহায়তা করায় কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবার ধারণায় বাংলাদেশ অগ্রণী।”

গবেষকরা বলছেন, দরিদ্রতা, মারাত্মক ও অপ্রতিরোধযোগ্য রোগ বৃদ্ধির মতো দ্রুত নগরায়ণের সহগ সমস্যাগুলো এবং জলবায়ুর পরিবর্তনের ঝুঁকি বাড়তে থাকায় এই সমস্ত সফলতার উপর কালো ছায়া পড়ছে।

আব্বাস বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা এখনো সংক্রামক ও মারাত্মক রোগের বোঝা বহন করছি। ল্যানসেট দেখিয়েছে অতীতে আমরা ভালোই করেছি।”

তিনি বলেন,“কঠিন বাস্তবতা হলো বাংলাদেশের অপুষ্টি বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সর্বোচ্চ। প্রায় অর্ধেকের মতো শিশু মারাত্মক অপুষ্টির শিকার। অধিকন্তু প্রায় এক তৃতীয়াংশের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নীচে বাস করে এবং আয় বৈষম্য আরো বাড়ছে।”

এছাড়াও সরকারি স্বাস্থ্যসেবার সার্বিক মান উন্নয়ন এবং চিকিৎসক ও সেবিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধির উপর জোর দিয়েছেন গবেষকরা।