পৃথক জীবনে তোফা-তহুরা, হাত-পা নেড়ে কান্না

সংযুক্ত শরীরে জন্ম নেওয়া দশ মাস বয়সী তোফা আর তহুরাকে দীর্ঘ সাড়ে ছয় ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে আলাদা করতে পেরেছেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসকরা।

কামাল তালুকদার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2017, 09:16 AM
Updated : 1 August 2017, 05:48 PM

জটিল এই অস্ত্রোপচার শেষে যমজ এই দুই শিশুকে রাখা হয়েছে পোস্ট অপারেটিভ বিভাগে; সেখানে তাদের ২৪ ঘণ্টা পর্যবেক্ষণে রাখা হবে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ডের সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর ইসলাম।

মঙ্গলবার সকাল ৮টায় জরুরি বিভাগের তৃতীয় তলার অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচার শুরুর পর বেলা আড়াইটার দিকে বেরিয়ে এসে শিশু সার্জারি বিভাগের অধ্যাপক কানিজ হাসিনা শিউলি সাংবাদিকদের জানান, তোফা ও তহুরাকে তারা সফলভাবে আলাদা করতে পেরেছেন।

নতুন করে আলাদা জীবনের জন্য দুই শিশুকে প্রস্তুত করতে এরপর আরও প্রায় আড়াই ঘণ্টা তাদের দেহে বেশ কিছু অস্ত্রোপচার চলে। সব কাজ শেষ করে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় পোস্ট অপারেটিভে।

তোফা আর তহুরার অবস্থা স্থিতিশীল জানিয়ে সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর বলেন, “বিকাল ৫টার দিকে ওদের সংজ্ঞা ফিরেছে। হাত-পা নেড়ে কেঁদে উঠেছে ওরা।”

এই চিকিৎসক জানান, দুই শিশুর প্রজননতন্ত্র ঠিক করতে আরও কিছু অস্ত্রোপচার করতে হবে পরে। এতদিন মলত্যাগের জন্য কৃত্রিম ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছিল। পায়ুপথ স্বাভাবিক করতে আরও কিছু কাজ করতে হবে। 

গত বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর জোড়া লাগানো শরীর নিয়ে জন্ম হয় গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলার দহবন ইউনিয়নের কৃষক রাজু মিয়া ও তার স্ত্রী শাহিদা বেগমের এই যমজ সন্তানের।

তোফা আর তহুরার পিঠের দিক থেকে কোমরের নিচ পর্যন্ত মেরুদণ্ডের হাড় সংযুক্ত ছিল। মাথা-হাত-পা আলাদা হলেও তাদের মলদ্বার ছিল একটি।

শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক শাহনূর ইসলাম জানান, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এমন ঘটনাকে ‘পাইগোপেগাস’ বলা হয়।

জন্মের আট দিনের মাথায় শিশু দুটিকে ঢাকা মেডিকেলে নিয়ে আসা হলে প্রথমে অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তাদের মলদ্বার আলাদা করে কৃত্র্রিম ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।

দীর্ঘ পরীক্ষা নিরীক্ষা ও প্রস্তুতির পর মঙ্গলবার সকালে তোফা ও তহুরাকে আলাদা জীবন দেওয়ার অস্ত্রোপচার শুরু করেন চিকিৎসকরা।   

সকালে অস্ত্রোপচার শুরুর পর হাসপাতালের পরিচালক মিজানুর রহমান সাংবাদিকদের  বলেছিলেন, “ঝুঁকি থাকলেও আমরা আশাবাদী। বাচ্চা দুটির মধ্যে তোফা বেশি সক্রিয়, আর তহুরা একটু কম সক্রিয়। আশা করছি অস্ত্রোপচারের পর তারা সুস্থ হয়ে উঠবে।”

বিভিন্ন বিভাগের প্রায় ত্রিশজন চিকিৎসক দুটি দলে ভাগ হয়ে দীর্ঘ এই অস্ত্রোপচারে অংশ নেন। অচেতন করাসহ প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ শেষে একদল চিকিৎসক শিশু দুটির দেহ আলাদা করার কাজ শুরু করেন।

দুপুরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক আশরাফুল হক কাজল সাংবাদিকদের বলেন, তোফা ও তহুরার স্পাইনাল কর্ড ও মেরুদণ্ড আলাদা করতে পেরেছেন তারা।

দুই শিশুর দেহ আলাদা হওয়ার পর দুপুরে চিকিৎসকদের অন্য দলটি শুরু করেন দ্বিতীয় পর্যায়ের কাজ।

এই অস্ত্রোপচারকে কেন্দ্র করে সকাল থেকেই সংবাদকর্মীরা অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন।

ঢাকা মেডিকেলের বার্ন ইউনিটের সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন দুপুরে অপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে এসে সাংবাদিকদের বলেন, কয়েক বছর আগেও বাংলাদেশে এত বড় অপারেশনের কথা ভাবা যেত না।

“আপনারা বেশি করে প্রচার করুন। আমাদের চিকিৎসকরা কত বড় অপারেশন করতে পারে, আপনারা দেখান।”

সকাল ৮টা থেকে শুরু করে বিকাল ৫টা পর্যন্ত অপারেশন থিয়েটারের পাশে একটি কক্ষে বসেছিলেন তোফা-তহুরার মা সাহিদা বেগম। কখনও কান্না করেছিলেন, কখনও স্তব্ধ হয়ে ছিলেন।

তোফা-তহুরার বাবা রাজু বেশিরভাগ সময় ছিলেন অপারেশন থিয়েটারের সামনে। উদ্বিগ্ন দেখালেও ভেঙে পড়েননি তিনি।

শিশু দুটির বাবা রাজু মিয়া

শিশু দুটির মা সাহিদা বেগম

দুপুর আড়াইটা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টার মধ্যে চিকিৎসকরা যখন অস্ত্রোপচারের সফলতা বলছিলেন, সাহিদার মুখের মলিনতাও আস্তে আস্তে দূর হতে লাগলো।

বিকালে সাড়ে ৫টার দিকে যখন চিকিৎসক জানালেন, দুটি শিশুই চিৎকার করেছে, হাত-পা নাড়িয়েছে; তখন সাহিদা আর রাজুর মুখে হাসির ঝলক।

সাহিদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন ভাত খামু, পেট ভইরা ভাত খামু। অনেক খুশি।”

রাজু বলেন, “তোফা আর তহুরাকে আলাদা দেখে প্রাণ আমার জুড়াই গেছে। ওরা যখন চিৎকার আর হাত-পা নাড়াচ্ছিল, তখন খুব ভালো লাগছে।”

অপারেশন থিয়েটারের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন দুই শিশুর নানা শহীদুল ইসলাম ও তাদের পাঁচ বছর বয়সী ভাই শাহাদাত।

শহীদুল সাংবাদিকদের বলেন, “আমার নাতিনদের জন্য দোয়া করবেন। দেশবাসীকে দোয়া করতে বলবেন।”