যক্ষ্মাজয়ের লড়াই: ‘বাংলাদেশকে ধন্যবাদ’

জান তিং তিয়োং এখনো মনে করতে পারেন দুঃসহ সেই ১৮ মাসের কথা, বহু ওষুধপ্রতিরোধী (মাল্টি ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট) যক্ষ্মায় আক্রান্ত হয়ে যে সময়টিতে তাকে কষ্টকর এক দীর্ঘ চিকিৎসার পথ পাড়ি দিতে হয়েছিল।

নুরুল ইসলাম হাসিব লিভারপুল থেকেবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2016, 07:00 AM
Updated : 27 Oct 2016, 10:05 AM

২০১৩ সালে যক্ষ্মার চিকিৎসা শুরুর পর মালয়েশীয় এই নারী চিকিৎসক জানতে পারেন যে, প্রচলিত ওষুধপ্রতিরোধী হয়ে ওঠা যক্ষ্মার চিকিৎসার সময়কে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য গবেষকরা নয় মাসে নামিয়ে আনতে পেরেছেন।

খবর শুনে উচ্ছ্বসিত হলেও অনুমোদন না থাকায় নয় মাসের ওই চিকিৎসা প্রক্রিয়া নিজের জন্য গ্রহণ করতে পারেননি তিনি। 

তিয়োং বলেন, “তখন মাত্রই উদ্ভাবিত হওয়া ওই কোর্স আমার দেশ কিংবা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, কারোরই অনুমোদিত ছিল না। তবু আমি জানতাম, ভবিষ্যতে আমার মতো রোগীদের জন্য নতুন এই চিকিৎসা আশীর্বাদ হয়ে আসবে। ধন্যবাদ বাংলাদেশ।”

দীর্ঘ দেড় বছরের ওই চিকিৎসার অভিজ্ঞতা স্মরণ করে তিনি বলেন, “টানা আট মাস আমাকে ইনজেকশন নিতে হয়েছে, যার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় আমি প্রায়ই বধিরের মতো হয়ে যেতাম।”

যক্ষ্মাভীতি দূর করতে প্রচারণায় থাকা তিয়োং ‘ফুসফুসের স্বাস্থ্য’ বিষয়ে চলমান এক বৈশ্বিক সম্মেলনে যোগ দিতে যুক্তরাজ্যের লিভারপুলে রয়েছেন, সেখানেই তার সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এই প্রতিবেদকের।  

‘মুখোমুখি প্রতিরোধ’ প্রতিপাদ্য সামনে রেখে দ্য ইউনিয়নের আয়োজনে এ সম্মেলনে যক্ষ্মাজয়ী স্বাস্থ্যকর্মীদের সংগঠন ‘টিবি প্রুফ’ এর কয়েক সদস্যকে নিয়ে সম্মেলনে যোগ দিয়েছেন তিয়োং, যিনি নিজেও পুরোপুরি সুস্থ; কাজ করছেন যক্ষ্মা নিরাময়পরবর্তী সমস্যা নির্মূলে।

এক সময় মারণব্যাধি খ্যাত যক্ষ্মায় আক্রান্তরা এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে ওঠেন। ব্যতিক্রম শুধু বহু ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মা, যা প্রচলিত ওষুধ সহনশীল হয়ে উঠছে। এই যক্ষ্মায় আক্রান্তদের নিরাময়ের হারও অনেক কম, প্রায় ৫০ শতাংশ।

সাধারণ যক্ষ্মায় ছয় থেকে নয় মাসব্যাপী চিকিৎসার তুলনায় ওষুধপ্রতিরোধী যক্ষ্মার চিকিৎসা পদ্ধতি দীর্ঘ; দেড় থেকে দুই বছর, চিকিৎসার ব্যয়ও অনেক বেশি।

তবে বাংলাদেশি একটি গবেষণা সহজপ্রাপ্য কিছু ওষুধের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী ওই চিকিৎসাকে নয় মাসে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে। ‘ফ্রাঙ্কোফোনি’ নামে এই উদ্ভাবন পরে ফরাসিভাষী আফ্রিকার নয়টি দেশেও প্রয়োগ করে সফলতা আসে। 

প্রাথমিক ফল দেখে চলতি বছরের মে থেকে নয় মাসের এ চিকিৎসায় অনুমতি দেয় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

বুধবার প্রকাশিত গবেষণার চূড়ান্ত ফলে দেখা যায়, বাংলাদেশি গবেষণা থেকে উদ্ভূত চিকিৎসায় সাফল্যের হার ৮২ শতাংশ, যা ১৮ মাসব্যাপী চিকিৎসার ক্ষেত্রে ৫৫ শতাংশেরও কম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তিয়োং বলেন, কেমন করে ব্যাকটেরিয়াবাহী এ রোগ তাকে আক্রান্ত করল, তা নিয়ে নিশ্চিত নন তিনি। তবে চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে মস্কো যাওয়ার পরই তিনি যক্ষ্মার খপ্পরে পড়েন বলে তার ধারণা।

“২০১৩ সালে আমি মালয়েশিয়ায় ইন্টার্নশিপ করতে ফিরে আসি। ওই সময়ই আমি অসুস্থ বোধ করি, নিয়মিত কফ ও রাতে ঘাম হতে থাকে।”

পরীক্ষায় ওষুধ প্রতিরোধী যক্ষ্মা শনাক্ত হলে চিকিৎসা শুরুর দুই বা তিন মাসের মাথায় তার এক চিকিৎসক এক সাময়িকী পড়ে বাংলাদেশের গবেষণার কথা তাকে জানান।

তিয়োং বলেন, “সেটি তখনও মালয়েশিয়ায় চালু হয়নি, এমনকি ডব্লিউএইচও এটি চালুর সুপারিশ করেনি। এজন্য আমার চিকিৎসক সনাতনী চিকিৎসায় ধারাবাহিক হওয়ার পরামর্শ দেন।”

বহু ওষুধপ্রতিরোধী এই যক্ষ্মার চিকিৎসা মানিয়ে নেওয়াও রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলেও মনে করেন মালয়েশীয় এ চিকিৎসক।

“কোনো কোনো সময় আমার কাছেও ব্যাপারটা কঠিন লাগতো। কিন্ত যেহেতু আমি চিকিৎসক, তাই শেষ পর‌্যন্ত এটি চালিয়ে গেছি। তবে অন্য রোগীদের ক্ষেত্রে পুরো চিকিৎসা শেষ করা বেশ কঠিন ব্যাপার।”

চিকিৎসার সময় বন্ধু ও স্বজনদের পাশে পাওয়ায় নিজেকে ‘ভাগ্যবান’ও মনে করছেন তিয়োং।

“আমি অনেক রোগীকে দেখেছি পরিবারের সদস্যরা তাদের আলাদা রাখে বা বাড়ি থেকে সরিয়ে রাখে।”

যক্ষ্মাকে ‘গরিবের রোগ’ বলা হলেও যে কেউ এতে আক্রান্ত হতে পারে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “আমার আগে কখনোই যক্ষ্মা হয়নি। কিন্তু আমি জানি, স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার ক্ষেত্রে অন্যদের চেয়ে ছয়গুণ বেশি ঝুঁকিতে থাকে।”

পুরোপুরি সুস্থ হওয়ার পর ২০১৫ সাল থেকে তিয়োং নিজেও গবেষণায় মনোনিবেশ করেছেন, পাশাপাশি সংযুক্ত হয়েছেন যক্ষ্মা নির্মূলে চালানো ‘জিরো স্টিগমা, জিরো টিবি’-র প্রচারে।