২০ ওষুধ কোম্পানির লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ

ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ তৈরির অভিযোগে ২০টি কোম্পানির ওষুধ উৎপাদন লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করেছে সংসদীয় কমিটি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 April 2016, 04:42 PM
Updated : 20 April 2016, 04:43 PM

এছাড়া ১৪টি প্রতিষ্ঠানের সব ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক (নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপ) উৎপাদনের অনুমতি বাতিল, ২২টি কোম্পানির পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়েটিক উৎপাদনের অনুমতি স্থগিত করার সুপারিশ করা হয়েছে।

বুধবার জাতীয় সংসদ ভবনে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এ সুপারিশ আসে।

সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক আ ব ম ফারুকের নেতৃত্বে গঠিত তদন্ত দলের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে এ সুপারিশ করে সংসদীয় কমিটি।

পাঁচ সদস্যের ওই বিশেষজ্ঞ তদন্ত দলে আরও ছিলেন- জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মো. সাহাবুদ্দিন কবীর চৌধুরী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক মো. আনোয়ারুল ইসলাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওষুধ প্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক সীতেশ চন্দ্র বাছার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল ফার্মেসি অ্যান্ড ফার্মাকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মো. শওকত আলী।

স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিনা বেগম সাংবাদিকদের বলেন, “সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ তদন্ত কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়কে বলা হয়েছে। বিশেষ করে জীবনহানিকর ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”

ভেজাল ওষুধ উৎপাদনের পাশাপাশি যারা বিক্রি করবে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রণালয় দ্রুতই এবিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

নবম সংসদেও এই বিশেষজ্ঞ দল সংসদীয় কমিটির তত্ত্বাবধানে কারখানা পরিদর্শনের কাজ করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় দশম সংসদেও তারা কারাখানা পরিদর্শনের কাজ শুরু করে।

বিশেষজ্ঞ দলের প্রতিবেদনে মানসম্পন্ন ওষুধ উৎপাদনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়ায় ২০টি কোম্পানির উৎপাদনের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে।

কোম্পানিগুলো হলো- এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যাল, এভার্ট ফার্মা, বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল, ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল, ড্রাগল্যান্ড, গ্লোব ল্যাবরেটরিজ, জলপা ল্যাবরেটরিজ, কাফিনা ফার্মাসিউটিক্যাল, মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ড্রাগ, নর্থ বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল, রিমো ক্যামিকেল, রিদ ফার্মাসিউটিক্যাল, স্কাইল্যাব ফার্মাসিউটিক্যাল, স্পার্ক ফার্মাসিউটিক্যাল, স্টার ফার্মাসিউটিক্যাল, সুনিপুন ফার্মাসিউটিক্যাল, টুডে ফার্মাসিউটিক্যাল, ট্রপিক্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল এবং ইউনিভার্সেল ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।

নন-পেনিসিলিন, পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশ করা ১৪টি কোম্পানি হচ্ছে- আদ-দ্বীন ফার্মাসিউটিক্যাল, আলকাদ ল্যাবরেটরিজ, বেলসেন ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল ড্রাগস, ব্রিস্টল ফার্মা, ক্রাইস্ট্যাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ইন্দ-বাংলা ফার্মাসিউটিক্যাল, মিল্লাত ফার্মাসিউটিক্যাল, এমএসটি ফার্মা, অরবিট ফার্মাসিউটিক্যাল, ফার্মিক ল্যাবরেটরিজ, ফনিক্স ক্যামিকেল, রাসা ফার্মাসিউটিক্যাল এবং সেভ ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।

পেনিসিলিন ও সেফালোস্পোরিন গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিল করার সুপারিশ করা ২২টি কোম্পানি হচ্ছে- আমিকো ফার্মাসিউটিক্যাল, অ্যাজটেক ফার্মাসিউটিক্যাল, বেঙ্গল টেকনো ফার্মা, বেনহাম ফার্মাসিউটিক্যাল, সেন্ট্রাল ফার্মাসিউটিক্যাল, ডিসেন্ট ফার্মা, ড. টিআইএম’স ল্যাবরেটরিজ, গ্লোবেক্স ফার্মাসিউটিক্যাল, গ্রিনল্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল, ইনোভা ফার্মাসিউটিক্যাল, মাকস ড্রাগস, মেডিম্যাট ল্যাবরেটরিজ, মডার্ন ফার্মাসিউটিক্যাল, মাইস্টিক ফার্মাসিউটিক্যাল, ন্যাশনাল ল্যাবরেটরিজ, অর্গানিক হেলথ কেয়ার, ওয়েস্টার ফার্মা, প্রিমিয়ার ফার্মাসিউটিক্যাল, প্রাইম ফার্মাসিউটিক্যাল, সীমা ফার্মাসিউটিক্যাল, ইউনাইটেড ক্যামিকেল অ্যান্ড ফার্মাসিউটিক্যাল এবং হোয়াইট হর্স ফার্মাসিউটিক্যাল লিমিটেড।

এছাড়া দুটি প্রতিষ্ঠানের মানবদেহে বাহ্যিকভাবে ব্যবহার্য ওষুধ, একটিকে প্রাণিসম্পদে ব্যবহার্য ওষুধ এবং অপর একটিকে সেফালোস্পোরিন বাদে অন্যান্য গ্রুপের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি অব্যাহত রাখার সুপারিশ করা হয়েছে।

বিশেষজ্ঞ দলের ১৭১ পৃষ্ঠার দীর্ঘ প্রতিবেদনে ময়মনসিংহের বিসিক-এ অবস্থিত এক্সিম ফার্মাসিউটিক্যালস সম্পর্কে বলা হয়, কারখানাটি আগের মতোই জিএমপি নীতিমালা অনুসরণ করে ওষুধ উৎপাদনে ব্যর্থ। গত পাঁচ বছর ধরে কারখানার সংস্কার ও উন্নয়নের সুযোগ থাকলেও তা করা হয়নি। বরং কারখানা সাসপেন্ডেড ঘোষণা করে গোপনে ওষুধ তৈরি করছে। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় তাদের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হলো।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, সাভারের ব্যাংক কলোনি এলাকায় অবস্থিত এভার্ট ফার্মা সংস্কারের নামে ওষুধ তৈরি বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলেও গোপনে তাদের বিপুল পরিমাণ ওষুধ তৈরির আলামত স্পষ্ট। এদের ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যšø ঝুঁকিপূর্ণ। তাই এটি বাতিলের সুপারিশ করা হলো।

রাজধানীর মিরপুরের ৭৯৭ মনিপুরে অবস্থিত বিকল্প ফার্মাসিউটিক্যাল ওষুধ কারখানা বন্ধ রাখার ঘোষণা দিলেও বাজারে তাদের কিছু নিম্নমানের ওষুধ পাওয়া গেছে। কারখানা পরিদর্শনের চেষ্টা করা হলেও কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতার কারণে তা সম্ভব হয়নি। এই কোম্পানির সব ধরনের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করা হয়।

রাজধানীর ৮২/২, উত্তর যাত্রাবাড়ীর ডলফিন ফার্মাসিউটিক্যাল সম্পর্কে প্রতিবেদনে বলা হয়, এতো নিম্নমানের এবং জিএমপি সুবিধাহীন একটি কারখানা কিভাবে ওষুধ প্রশাসন থেকে নন-পেনসিলিন ও পেনিসিলিন গ্রুপের অ্যান্টিবায়েটিকসহ গুরুত্বপূর্ণ ওষুধ তৈরির অনুমতি পেল তা বোধগম্য নয়। পাঁচ বছরের বেশি সময় পাওয়ার পরেও এই কোম্পানি জিএমপি সক্ষমতা অর্জনে ব্যর্থ হওয়ায় এর প্রকাশ্য ও গোপনে উৎপাদিত ওষুধ জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ । তাই এর লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হলো।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে মিজমিজি মাদ্রাসা রোডে অবস্থিত ড্রাগল্যাফ্ফ লিমিটেড ঠিকানায় কোনো কারখানার অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। তবে বাজারে এদের ওষুধ পাওয়া যায়, যা অত্যন্ত নিম্নমানের।  তারা অন্যত্র কারাখানা বসিয়ে গোপনে ওষুধ তৈরি করছে কী-না তা ওষুধ প্রশাসনও জানে না। তাই এই কোম্পানিরও লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশ করা হয়।

মুন্সিগঞ্জের মিরকাদিমের পাইকপাড়া এলাকায় অবস্থিত গ্লোব ল্যাবরেটরিজের উৎপাদন বন্ধ ঘোষণা করা হলেও বছরের পর বছর বেআইনিভাবে ওষুধ উৎপাদন করে চলছে। লোকালয় থেকে দূরে এবং অজপাড়াগায়ে এর কারখানার অবস্থান হওয়ায় র‌্যাব-পুলিশ সঙ্গে নিয়েও মোবাইল কোর্ট তাদেরকে কাউকে আটকাতে পারেনি।

সিলেটের গোটাতিকার এলাকায় থাকা জালফা ল্যাবরেটরিজের বিরুদ্ধে কারখাণা বন্ধের ঘোষণা দিয়ে গোপনে ওষুধ উৎপাদনের প্রমাণ পায় তদন্ত দল। তাদের ওষুধ ব্যবহারে রোগী ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে ও বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তাদের সবধরনের ওষুধ উৎপাদনের অনুমতি বাতিলের সুপারিশ করা হয়।

এছাড়া নোয়াখালীর চৌমুহনী বিসিকে অবস্থিত কাফমা ফার্মাসিউটিক্যালস কারখানা বন্ধ ঘোষণা করলেও তাদের নামে বাজারে প্রচুর মানহীন ওষুধ পাওয়া যায়।

রংপুরের সূত্রাপুরের দর্শনা মোড়ে মেডিকো ফার্মাসিউটিক্যালও উৎপাদন বন্ধের ঘোষণা দিয়ে গোপনে ওষুধ তৈরি করে বাজারে ছাড়ছে। নকল কাঁচামাল দিয়ে নিয়মিতই তারা ওষুধ তৈরি করে যাচ্ছে।

ঢাকার ধামরাইয়ের আটিপাড়ার ন্যাশনাল ড্রাগ ফার্মার কারখানায় ওষুধ তৈরির পদ্ধতি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয় জানিয়ে তা জনস্বাস্থ্যের জন্য তা মারাত্মক ক্ষতিকর বলে জানায় তদন্ত দল।

কমিটির সভাপতি শেখ ফজলুল করিম সেলিমের সভাপতিত্বে বৈঠকে কমিটির সদস্য স্বাস্থ্য মন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ মালেক, আ ফ ম রুহুল হক, ইউনুস আলী সরকার ও সেলিনা বেগম অংশ নেন।

বৈঠকে বিশেষ আমন্ত্রণে অংশ নেন ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি সংসদ সদস্য নাজমুল হাসান পাপন।