অগোচরে কিশোরী মা-সন্তানের স্বাস্থ্য

বাবার দ্বিতীয় বিয়ের পর ঢাকায় পোশাক কারখানায় চাকরি করে দুই মেয়েকে নিয়ে মায়ের টিকে থাকার সংগ্রাম; সেই অবস্থা থেকে ‘একটু ভালোর’ আশায় ১৪ বছরের বড় মেয়েকে বিয়ে দেন মা।

ফয়সাল আতিকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Dec 2015, 05:41 PM
Updated : 2 Dec 2015, 04:40 AM

তবে এতে ভালোর বদলে অপরিণত বয়সে সন্তানের জন্ম দিয়ে এখন নানা রোগে ভুগছেন ওই কিশোরী। জন্মের তিন মাস পরেও মায়ের বুকের দুধ না পেয়ে শিশুটিও যেন দিন দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।

গাইবান্ধা সদর উপজেলার রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নের ওই কিশোরী এক আত্মীয় (ভাবী) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিয়ের দুই বছর পর গত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝিতে একটি হাসপাতালে কন্যাশিশু প্রসব করে মেয়েটি।

“খুব ছোট আকারের বাচ্চাটি এতোদিনে মনে হয় একটুও বাড়েনি। তার মায়ের শরীরও অসুস্থ। বাইরের কোনো খাবার তাকে খাওয়ানো যাচ্ছে না।”

মেয়েটি ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ে মায়ের সঙ্গে কিছুদিন ঢাকায় থাকার পর ২০১৪ সালের শুরুর দিকে গ্রামে ১৯ বছর বয়সী এক মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে তার বিয়ে হয় বলে জানান তিনি।

বাংলাদেশের আইনে বাল্যবিয়ে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও অসংখ্য কিশোরী এর শিকার হচ্ছে। অপরিণত বয়সে গর্ভধারণ করে তারা মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়ছে বলে বিভিন্ন প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ বছরের আগে মেয়েদের বিয়ে হওয়ার প্রবণতা কমে অর্ধেকে নেমে এলেও ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার কমেছে সামান্যই। এখনও ৫২ শতাংশ মেয়ে ১৮ বছরের আগেই স্বামীর সংসারে যেতে বাধ্য হচ্ছে।

অপরিণত বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়ার হার এখনও উদ্বেগজনক রয়ে গেছে।

ইউনিসেফের হিসাবে, ১৯৯৪ সালে যেখানে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী ৩৩ শতাংশ মায়েরা সন্তান জন্ম দিতেন তা এখন কমেছে মাত্র দুই শতাংশ। ২০১৪ সালেও একই বয়সী ৩১ শতাংশ গৃহবধূ সন্তান জন্ম দিয়েছেন বলে তথ্য পাওয়া গেছে।

অপরিণত বয়সে মেয়েদের বিয়ে ও গর্ভধারণ বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার সৃষ্টি করে জানিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সালেহ আহমেদ ভূঁইয়া বলেন, “এক্ষেত্রে মা ও শিশুর মৃত্যু, অপুষ্টি, মায়ের প্রজনন সক্ষমতার ক্ষতি, কম ওজনের সন্তান জন্ম নেওয়া, সন্তানের বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়া, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ার বিষয়গুলো উল্লেখযোগ্য।”

তিনি বলেন, “১৮ বছর পর্যন্ত একজন নারীর নিজের শরীর গঠন পক্রিয়া চলতে থাকে। এই সময় তিনি যদি আরেকটি সন্তান ধারণ করে বসেন তাহলে মা-শিশুর স্বাস্থ্য-ঝূঁকিতে পড়া-ই স্বাভাবিক।”

২০১৩ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশে প্রতিবছর ২৩ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। ২০ থেকে ২৯ বছর বয়সী মায়েদের চেয়ে ২০ বছরের কম বয়সী মায়েদের গর্ভে জন্ম নেওয়া শিশুর মৃত্যুর হার ৫৩ শতাংশ বেশি।

এই বাস্তবতা সামনে রেখে কম বয়সী মা ও তাদের সন্তানদের সুরক্ষায় সরকারের কোনো উদ্যোগ আছে কি না তা জানতে চাওয়া হয় পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের ম্যাটারনাল চাইল্ড হেলথ বিভাগের পরিচালক ডা. মোহাম্মদ শরীফের কাছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বাল্য বিয়ের শিকার কোনো কিশোরী কিংবা তার সন্তানের জন্য সরকারের সরাসরি কোনো প্রকল্প নেই। তবে এই সমস্যার মূল কারণ বাল্যবিবাহ যাতে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, সেজন্য শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, গির্জা-মন্দিরের প্রধানদের দিয়ে প্রচারণা চালানো হয়। গণমাধ্যমেও বিভিন্ন সচেতনতামূলক অনুষ্ঠান প্রচার করা হয়।”

তবে কিশোরী মা ও তার সন্তানের স্বাস্থ্যের বিষয়টি এখন নতুন করে ভাবতে হচ্ছে বলে জানান পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের এই কর্মকর্তা।

“স্বাস্থ্য পরিস্থিতির উন্নতি ও সব জনগোষ্ঠীর কথা চিন্তা করলে কিশোরী বয়সে বিয়ের অভিজ্ঞতা পাওয়া মায়ের কথাও ভাবতে হবে। সেজন্য সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল বা এসডিজিতে এই বিষয়গুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে।

“সম্ভাব্য কয়েকটি প্রকল্প নিয়ে দপ্তরের কর্মকর্তারা আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বিষয়গুলো এখনো আলাপ-আলোচনার পর্যায়ে আছে। ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল মেয়াদে এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হবে,” বলেন তিনি।