‘খরচ ও সেবার মান স্তন ক্যান্সার চিকিৎসায় চ্যালেঞ্জ’

সচেতনতা, নতুন প্রযুক্তি বা রোগ নির্ণয়ে পরীক্ষার অভাব নয়; চিকিৎসার সুযোগ, ব্যয় বহনের সামর্থ্য ও মানের ঘাটতিকে বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রে বড় বাধা বলে মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের এক ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকনূরুল ইসলাম হাসিববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 Oct 2015, 04:08 PM
Updated : 12 March 2021, 01:10 PM

শুক্রবার রাজধানীতে স্তন ক্যান্সার নিয়ে এক সম্মেলন চলাকালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটমকের কাছে এই মত তুলে ধরেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক এক অধ্যাপক ড. রিচার্ড লাভ, যিনি বাংলাদেশে স্তন ক্যান্সার চিকিৎসা নিয়ে প্রায় এক দশক কাজ করেছেন।

তিনি বলেন, “চিকিৎসার মানের সঙ্গে কর্মক্ষমতার বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে। তিনটি উদারহণ দিচ্ছি- বাংলাদেশে অনেক অপ্রয়োজনীয় টেস্ট করা হয়, মেডিকেল অনকোলজিতে দক্ষতা খুবই সীমিত এবং হরমোনাল থেরাপিও ব্যবহার করা হয় না।”

স্তন ক্যান্সার নিয়ে সচেতনতা তৈরির জন্য অক্টোবর মাসে বিশ্বজুড়ে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়, যার অংশ হিসেবেই ঢাকায় এই সম্মেলন হচ্ছে।

শুক্রবার সম্মেলন উদ্বোধন করে স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, ডিসেম্বরে বিজয়ের মাসে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনাম্যূল্যে স্তন ক্যান্সারের পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে।

‘চিকিৎসাকেন্দ্রের অপ্রতুলতা, সেবাগ্রহণের ব্যয় বহনের সামর্থ্য না থাকা ও সেবার মান প্রায়ই ভাল না হওয়ায়’ বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর হার বাড়ছে বলে মনে করেন ড. লাভ।

যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই শিক্ষক খুলনার রামপাল উপজেলায় ‘আমাদের গ্রাম ক্যান্সার কেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টারের’ পরামর্শক হিসেবে বছরে তিন বার বাংলাদেশে আসেন।

সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ড. লাভ বলেন, খুলনা বিভাগে প্রতিবছর অন্তত ১০ হাজার ক্যান্সার রোগী পাওয়া যাবে, যারা রেডিয়েশন থেরাপি নিতে পারতেন। কিন্তু সারা খুলনা বিভাগে রেডিয়েশন থেরাপির একটি কেন্দ্রও নেই।

“আপনাদের ৩০টি রেডিওথেরাপি শাখা চালু আছে, যেখানে দরকার ৩০০টির।”

ক্যান্সার নিয়ে নারীদের মধ্যে অসচেতনতা রয়েছে বলে ধারণা প্রচলিত থাকলেও এই চিকিৎসকের অভিজ্ঞতা উল্টো। তিনি দেখেছেন, বাংলাদেশের নারীরা নিজেদের স্তনে কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখলেই খুব সচেতন হয়ে যান।

“ধনী ও দরিদ্র নির্বিশেষে বাংলাদেশের নারীরা যখন এই সমস্যার সম্মুখীন হন তখন তারা বুদ্ধিদীপ্ত ও যৌক্তিক আচরণ করেন। বড় সমস্যা হল- চিকিৎসার ব্যয় বহনের সামর্থ্য।”

Dr Richard Love

রামপালের অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন, যে কোনো স্তন ক্যান্সারের রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে তারা প্রথম যে বাধা মোকাবেলা করেন তা হল- রোগীদের চিকিৎসার ব্যয় বহনে অসমার্থ্য।

“তারা যখন চিকিৎসার অর্থ যোগাড় শুরু করেন, তখন বড় যে সমস্য সামনে আসে তা হল- হাসপাতালগুলো ব্যয়বহুল এবং তারা অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা করতে বলে।

“সামর্থ্যের আওতার মধ্যেও চিকিৎসার ব্যবস্থা আছে। এমন বিশেষ পদ্ধতি আছে যাতে খরচের রাশ টেনে ধরা যায়। কিন্ত এটা বাংলাদেশে ঘটছে না। এই বিষয়গুলির দিকে আমাদের নজর দিতে হবে।”

তিনি বলেন, মূলত মানবসম্পদের সীমাবদ্ধতা থাকায় চূড়ান্ত পর্যায়ের ক্যান্সার রোগীরা ব্যথা নিরাময়ে প্রয়োজনীয় প্রশমন সেবাও (প্যালিয়েটিভ কেয়ার) পাচ্ছেন না।

“তাছাড়া রোগীদের যখন প্রশমন সেবার প্রয়োজন হয়, তখন ব্যয় বহনের সামর্থ্য থাকে না।”

তিনি জানান, ক্যান্সারের বিষয়ে তথ্য জানতে তারা একটি মোবাইল অ্যাপ তৈরি করেছেন। এর মাধ্যমে ঘরে বসেই প্রশ্নের জবাব দিয়ে রোগীরা নিজেদের রোগের তথ্য জানাতে পারে। ওই তথ্য তাদের সার্ভারে যাওয়ার পর কারও খারাপ কিছু দেখা গেলে ব্যথা প্রশমনে তারা উদ্যোগ নিতে যান।

“এটার জন্য মাসে খরচ পড়ে প্রায় এক হাজার টাকা। কিন্তু রোগীরা বলেন, তাদের কাছে কোনো টাকা নেই। কারণ এর মধ্যেই তারা ব্যয়বহুল সিটি স্ক্যান, পেট সিটি স্ক্যানসহ অন্তত ২০ ধরণের অপ্রয়োজনীয় রক্ত পরীক্ষা করে সব টাকা খরচ করে ফেলেছেন।

“বাংলাদেশে বিরাজমান থেরাপির সুবিবেচনামূলক ব্যবহারের ঘাটতি রয়েছে।”

হৃদরোগের চিকিৎসায় হার্ট ফাউন্ডেশন ও ডায়াবেটিসের জন্য বারডেমের মতো ক্যান্সারের চিকিৎসার ক্ষেত্রেও সরকারের পক্ষ থেকে এ ধরনের ব্যবস্থা তৈরির পরামর্শ দেন তিনি।

বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত নারীদের মধ্যে বেশিরভাগই স্তন ক্যান্সারের রোগী। এই রোগের প্রকৃত সংখ্যা কত- তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে কোনো তথ্য নেই।

তবে প্যারিসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সারের হিসাবে, বাংলাদেশে প্রতিবছর অন্তত ১৫ হাজার নারী স্তন ক্যান্সারে আক্রান্ত হন।

দেরিতে বিয়ে, দেরিতে সন্তান জন্ম দেওয়া ও শিশুকে মায়ের বুকের দুধ না দেওয়ার প্রবণতাকে স্তন ক্যান্সারের ঘটনা বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয়।